সিবিআই ও ইডি তদন্তের নামে রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করছে, এই মর্মে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল, এবং কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সেই মামলা দায়ের করার অধিকার নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। সেই প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে বিচারপতিদের বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে রাজ্যের তরফে অন্তত মামলা দায়ের করার অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। মাননীয় বিচারপতিরা বলেছেন, অতিরিক্ত রাজনৈতিক রেষারেষি দিয়ে আদালতের বিচারপ্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত না করে একেবারে নীতির প্রশ্নটিকে পাখির চোখ করাই বেশি জরুরি। এটা রাজনীতির প্রশ্ন নয়, নীতির প্রশ্ন। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে রাজ্য সরকার আপত্তি তোলা সত্ত্বেও ইডি কোনও বাধা মানেনি, কেন্দ্রীয় সরকার তাকে সম্পূর্ণত ব্যবহার করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য বলেই রাজ্যে সিবিআই প্রবেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে ইডি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। বিচারপতিরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কথাটা রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের নয়, বরং একেবারেই পদ্ধতিগত, এবং সেই সূত্রে, নীতিগত।
এই নীতির সঙ্গে যুক্ত একটি জরুরি রাষ্ট্রদর্শন, যার নাম যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সিবিআই অনুসন্ধানের বিষয়ে রাজ্যের তরফে স্বীকৃতি সরিয়ে নিলেও সিবিআই পর পর ১২টি মামলা দায়ের করেছে রাজ্যের বিরুদ্ধে— যা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা নীতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে যায়। এর ফলে রাজ্য সরকারের দুর্নীতির দিকে কেন্দ্রীয় সরকার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন্দ্রের তরফে এই ‘কনস্টিটিউশনাল ওভাররিচ’ বা সাংবিধানিক অধিকারের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কে? সেই ভার দেশের বিচারবিভাগের উপরেই বর্তায়। বাস্তবিক, গত দশ বছরে— কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়, নানা প্রদেশে নানা বিষয়ে— কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের অধিকার সীমিত করে গিয়েছে, রাজ্যকে অবজ্ঞা করে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা আর কোনও নতুন কথা নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যটি বিশেষ জরুরি ও সময়োপযোগী। এই বক্তব্যসূত্রে যে ভর্ৎসনা কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে ধাবিত হল, তার প্রভাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও, আশা করি, অনুভূত হবে। নির্বাচনের পর নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় এনডিএ সরকারের ক্ষমতা পরিচালন ও প্রদর্শন বিষয়ে অনেক হিসাবই নতুন করে করতে হচ্ছে : এই ক্ষেত্রটিতেও তৃতীয় দফার মোদি সরকার অবিলম্বে পথ-সংশোধন করুক।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে মোদি শাহের কর্তৃত্ব এখন রাজ্যে রাজ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে। মানুষের সমর্থন কিন্তু ক্রমেই কমছে। ক্ষোভ-বিক্ষোভও বাড়ছে নিচুতলার নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের দল পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে দলের অন্দরেই সমালোচনা, আপত্তি এবং ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। আর তার আঁচ মিলছে একের পর এক রাজ্যে হওয়া লোকসভা ভোটের রিভিউ বৈঠকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সামনেই রাজ্যের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। রাজস্থান থেকে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র অথবা গোয়া। প্রতিটি রাজ্যের এক বার্তা— এভাবে চলতে থাকলে এটাই বিজেপির শেষের শুরু। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্ব আতঙ্কিত। কারণ, সাম্প্রতিক রিভিউ বৈঠকে যোগী আদিত্যনাথ অতি আত্মবিশ্বাস এবং অন্তর্ঘাতকে দায়ী করে আদতে দিল্লির দিকেই আঙুল তুলেছেন। আবার যোগী সরকারেরই উপ মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য কর্মিসভায় নিজের সরকারকেই আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, ‘সংগঠনকে দায়ী করে কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্য সিদ্ধ হবে না। দলকে কাছে টানতে হবে। দলের নেতা-কর্মীরা যাতে অপমানিত না হন, সেটা দেখতে হবে।’ টার্গেট যোগী আদিত্যনাথ। মোদি-শাহকে ইঙ্গিত করে হিমাচল প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের বাবা প্রেমকুমার ধুমলের আক্রমণ, ‘হিমাচল প্রদেশের নির্বাচিত কংগ্রেস সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য এত তাড়া কীসের? আগে দলের শক্তি ছিলেন কর্মীরা। অটলজি, আদবানিজি সিদ্ধান্ত নিতেন কর্মীদের কথা শুনেই। এখন?’ মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে বলা হয়েছে, ‘অন্য দল ভাঙাতে গিয়ে কংগ্রেসের থেকেও পিছিয়ে পড়েছে বিজেপি। সামনেই ভোট। কীভাবে এগতে হবে, তা রাজ্য বিজেপি ঠিক করুক।’ মানেটা পরিষ্কার, দিল্লির নেতৃত্ব যেন বেশি হস্তক্ষেপ না করে।
মোদ্দা কথা, একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই মোদি-শাহের। সেজন্যই জগৎপ্রকাশ নাড্ডার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও, মোদি-শাহ পরবর্তী সভাপতি বেছে নিতে পারছেন না। বঙ্গেও অবলাকান্তকে সরিয়ে সভাপতি পদে বসানো হচ্ছে না কাউকেই। দলের রাশও আর হাতে থাকছে না টিম মোদির।
এই আবহে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য বুঝিয়ে দিচ্ছে, সর্বস্তরে যথেচ্ছাচার চালানোর দিন শেষ। অনেক নোংরামি করেছেন মোদি-শাহ। এবার নিজেদের সংবরণ করুন। নইলে দেশের আইন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আপনাদের হিসাব বুঝিয়ে দেবে।
সর্বস্তরে ব্যর্থ এই মোদি-শাহ-র সরকার। দেশের রফতানি বেড়েছে ২.৫ শতাংশ। ওদিকে আমদানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। সুতরাং কার্যক্ষেত্রে আমদানি ও রফতানির ফারাক গত বছরের তুলনায় নয় শতাংশ বেড়েছে। আপাতত রাজকোষ ভরানোর জন্য একমাত্র টার্গেট সেই আমজনতাই। বছরের শুরুতেই প্রত্যক্ষ কর আদায় আশাতীত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত এবং উৎসাহিত অর্থমন্ত্রক এবার আসন্ন বাজেটে ট্যাক্স সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি বাড়াতে চলেছে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি ট্যাক্স আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে মোট ট্যাক্স আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল ৩৪ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। যে লক্ষ্যমাত্রা চলতি বছরের অন্তবর্তী বাজেটেই বাড়িয়ে করা হয় ৩৮ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। জানা যাচ্ছে, এরপরও অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি ট্যাক্স আদায় হওয়া সম্ভব মনে করছে অর্থমন্ত্রক। পূর্ববর্তী বাজেটে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৯ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এরপর অন্তর্বর্তী বাজেটে সেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২২ লক্ষ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ করের অর্থ হল, ব্যক্তিগত আয়কর এবং কর্পোরেট কর। পরোক্ষ করের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরের বাজেটে ছিল ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। আর এই বছরের অন্তর্বর্তী বাজেটে করা হয়েছিল ১৬ লক্ষ কোটি টাকা। সভা-সমাবেশে আত্মনির্ভরতার স্লোগান ক্রমবর্ধমান হলেও, কার্যক্ষেত্রে রফতানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে। পেট্রোপণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অথচ রফতানি বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ১৮ শতাংশ!
মোটেই ভাল নেই দেশের স্বাস্থ্য, বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চিত্র ও মোদি সরকারের হাল। বেশিদিন চালাতে পারবেন না মোদি-শাহ, একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সুতরাং এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়ার নোংরা খেলা বন্ধ হোক। অবিলম্বে।
আরও পড়ুন- শিল্প-কর্মসংস্থানে জোয়ার এসেছে ২০২৪-এর প্রথম দু’মাসেই