উওরবঙ্গে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চা-শিল্পের আধিপত্য। এই আধিপত্যের কারণ হল ভারতবর্ষ বিশ্বের বৃহত্তম চা- উৎপাদক দেশ। তার থেকেও বড় কথা উত্তরবঙ্গের মধ্যে অসম, দার্জিলিং, তরাই ও ডুয়ার্স এবং জলপাইগুড়ি মূলত চা-বলয়ের অন্যতম জোগানদার। বর্তমানে ভারত চা উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে, শুধু বর্তমানে নয়, অতীতেও দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষস্থানে ছিল, তার অন্যতম কারণ উওরবঙ্গের এই চা-বলয়। আরও যদি স্পষ্ট করে বলা হয় তবে বলতেই হবে দার্জিলিং-এর সুগন্ধী চা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবী-বিখ্যাত।
চা-শিল্পের কিছু ইতিহাস না বললে এ-বিষয়ে কথা বলার কোনও মানে নেই। বিভিন্ন তথ্য সূত্র অনুসারে, ভারতবর্ষে চা-এর ইতিহাস কম-বেশি ৪০০ বছরের পুরোনো। আনুমানিক ১৬৬২ সালে জার্মান ভ্রমণকারী মেন্ডেলস্লো ভারতে চা-পাতা ঔষধি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। আবার ১৬৮৯ সালে আমেরিকান সাংবাদিক ওভিংটনও রোগ নিরাময়ের জন্য চা-পাতার ব্যবহার করেছিলেন। গবেষকদের মতে ঔষধিরূপে ব্যবহারের জন্য চা-পাতা চিন থেকে আনা হত বলে ধারণা করা হয়।
১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস চিন থেকে কিছু চা-এর বীজ এনে ভুটানে পাঠিয়েছিলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য, কিন্তু এই বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৭৮০ সালে রবার্ট কিড পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে চা চাষ শুরু করেছিলেন, কিন্তু কিছু দশক পর রবার্ট ব্রুস ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকায় প্রথম চা-গাছের সন্ধান পান। তখন থেকেই ভারতে চা চাষের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। ১৮২০-এর দশকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা-উৎপাদন শুরু করলে আসাম বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে নেয়। যাই হোক ইংরেজরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনসরণ ভালই বুঝত, তাই খুব অল্প সময়ে তারা ভারতের মাটি ব্যবহার করে ১৮২৬ সালে ইয়ান্ডাবু সন্ধির মাধ্যমে অহোম রাজাদের থেকে মূল চায়ের অঞ্চলটি দখল করে নেয়। চায়ের গুণগতমান ও ব্রিটিশদের অর্থবলে ভর করে প্রথম থেকেই ভারতে উৎপাদিত চা ব্রিটেনে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এরপর ব্রহ্মপুত্রে বহু জল বয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে দার্জিলিং, তরাই, ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের আর্থসামাজিক দিকটি অনেকটাই এই চা-বাগানের অস্তিত্বের উপর টিকে আছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স, দার্জিলিং, তরাই অঞ্চলে কমবেশি ৩০০টির মতো চা-বাগান রয়েছে। কিন্তু ছোট-মাঝারি মিলিয়ে হাজারেরও বেশি চা-বাগান রয়েছে। শুধু উত্তরবঙ্গে কম করে ২০-২৫ লক্ষ মানুষ এই চা-শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যার মধ্যে ৭০ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। তবে ইদানীংকালে চা-শিল্পের সমস্যা সংবাদ শিরোনামে। পুরনো যন্ত্রপাতি, উৎপাদনব্যয়ে আধিক্য, পুরনো বাগিচা, সুষ্ঠু পরিচালনার অভাব তো ছিলই, বর্তমানে বড় সমস্যা হল শ্রমিক অসন্তোষ।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অতি-যত্ন সহকারে চা-শিল্পের সমস্যাগুলি দূরীকরণে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হন। ২০১১ সালে যখন তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তখন চা-শ্রমিকদের মজুরি ছিল মাত্র ৬৭ টাকা যা বর্তমানে ২৩২ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। চা-বাগানের শ্রমিকদের বিনামূল্যে চাল, গম এবং রেশনের সামগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, আমরা আগে দেখেছি চা- শ্রমিকরা শুধু ন্যূনতম মজুরি পান না তা নয়, অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশে বাস করার জন্য নানারকম শারীরিক সমস্যায় ভোগেন ছোট থেকেই। তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘চা সুন্দরী প্রকল্প’ সঞ্জীবনী ঔষধের মতো কাজ করা শুরু করেছে। এই প্রকল্পে চা-শ্রমিকের জন্যে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে শুধু তাই নয়, তারা যাতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় সেইজন্য চা-বলয়ে উন্নতমানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রও গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চা সুন্দরী প্রকল্প’র জন্য স্কচ পুরস্কারও চলে এসেছে সরকারের ঝুলিতে।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবার মামলা: সিবিআই তদন্তের উপর স্থগিতাদেশ আদালতের
মানবিক মুখ্যমন্ত্রী শুধু এখানেই থেমে থাকেননি, বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য ১৫০০ টাকা ভাতারও বন্দোবস্ত করেছেন। এখানেই শেষ নয়, উত্তরবঙ্গের চা-বলয়কে কেন্দ্র করে শিল্প ও বাণিজ্যকে পাখির চোখ করে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর জন্য ব্লুপ্রিন্টও তৈরি করে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। চা-অধিদফতরকে শ্রমদফতরের অধীনে এনে তাকে আরও শক্তিশালী কার্যক্ষেত্রে পরিণত করা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে একটা সময় ভোট রাজনীতির ওপর উন্নয়ন নির্ভর করত। কিন্তু সেই সময় বদলেছে, ২০১১ সালের পর থেকে উওরবঙ্গে তৃণমূলের ঝুলি শূন্য থাকলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও হিংসার রাজনীতির আশ্রয় নেননি, সকলকে সমান চোখে দেখে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গকে এক সুতোয় বেঁধে গেছেন চিরকাল। তাই পাহাড়ের মানুষ যখনই বিপদে পড়েছেন তখনই ছুটে গেছেন সেখানে।
আরও যদি বলি দার্জিলিং-এর চা-পাতা পৃথিবী বিখ্যাত কিন্তু তার প্রক্রিয়াকরণ বাইরে হওয়ার দরুণ তা চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। সেই চা যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয় তার জন্য কলকাতা বা হলদিয়া বন্দরের নিকট চা-শিল্পের জন্য পার্ক তৈরি করার পরিকল্পনাও করা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তার বাস্তবায়নের রোড ম্যাপও তৈরি করে ফেলেছেন। দার্জিলিং-চা পৃথিবী বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি এই রকম মনোনিবেশ হয়তো আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী করেননি সুদূর অতীতে। শুধু বাণিজ্য নয়, যে মানুষগুলোর জন্য এই বাণিজ্য সেই মানুষগুলো যাতে দুধে-ভাতে থাকে তার বন্দোবস্ত করে যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— এটাই বাস্তব এবং শুধু ভোট ব্যাঙ্ক নয়, মানুষ বাঁচুক এই ধর্মে দীক্ষিত আমাদের স্নেহের মুখ্যমন্ত্রীকে দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন উওরবঙ্গের মানুষ— এটাই এখন একমাত্র সত্য।