ভারতীয় জাতীয় ক্যালেন্ডারের নেপথ্যে

নানা ভাষা, নানা মত, নানা প্রচলিত আঞ্চলিক প্রথা, একই দিনপঞ্জির নিচে সমস্ত প্রাদেশিক নিয়মকানুন মেনে জাতীয় ক্যালেন্ডার প্রচলনের কিছু কৌশল নিয়ে লিখেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের অ্যাটমস্ফিয়ারিক সায়েন্সের অতিথি অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

ক্যালেন্ডার হচ্ছে কোনও বিশেষ পদ্ধতিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পর পর দিনগুলোকে একটি সুবিধামতো চক্রাকার সময়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ করা। এই চক্রাকার সময়কে বলে বছর। বছর মাপা হয় সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য অবস্থান এবং চন্দ্রের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে নিজের অক্ষ উলম্ব রেখে আবর্তন করে না, একটু বাঁকা হয়ে লাট্টুর মতো ঘোরে। আবার পৃথিবী সম্পূর্ণ গোলাকার না এবং এর চারিদিকে চাঁদ আবর্তন করে, ফলে পৃথিবীর দুই ধরনের আবর্তনগতি, একটি সূর্যের চারিদিকে এক বছরের এবং আরেকটি ২৫৮০০ বছরের। এই দ্বিতীয় আবর্তন গতির জন্য প্রথমত, যেমন, প্রত্যেক বছর ঋতু পরিবর্তন বা শীত, গ্রীষ্ম ইত্যাদির আরম্ভর এবং শেষ হওয়ার সময় বিঘ্নিত হয় তেমনি সূর্যের সাপেক্ষে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৃথিবী ফিরে আসতে পারে না। তাই বছরের দিন গণনায় ত্রুটি এসে যায়। সেই জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে ক্যালেন্ডার প্রস্তুতিতে দিনগণনা ত্রুটিমুক্ত করা হয়। নানা ধরনের ক্যালেন্ডারে নানাভাবে এই সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। যদি বছরের দিনগণনায় ত্রুটিমুক্ত করা না হত তবে হয়তো ২৫ ডিসেম্বর নাগাদ কখনও কখনও উত্তর গোলার্ধে গরমকাল পড়ত! উল্লেখ্য, দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর ২৫৮০০ বছরের আবর্তন গতির জন্য পৃথিবীর উত্তর মেরু সূর্য থেকে ২৫৮০০ বছর বাদে বাদে অন্তিম দূরে চলে যায়। উত্তর গোলার্ধে বরফ শীতল অবস্থার আগমন হয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় আবর্তন গতির জন্য (বিশ্ব উষ্ণায়ন বাদে) পৃথিবী এখন শৈত্যের দিকে যাচ্ছে। আর ১০০০ বছর বাদে এর প্রভাব বোঝা যাবে। এখন থেকে ১৩০০০ বছর বাদে বা তার কিছু পূর্বে মানবসভ্যতা এক বরফ-কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হবে।

আরও পড়ুন-কর্মসৃষ্টি করে স্বনির্ভর দক্ষিণ দিনাজপুরের মহিলারা

সোলার ক্যালেন্ডার
কোনও একটি নির্দিষ্ট তারার সাপেক্ষে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তনের ফলে একই স্থানে পৃথিবীর ফিরে আসবার সময়কে এক সোলার বছর বলে। তারপর এই এক বছর সময়কে ৩৬৫ (লিপ ইয়ার হলে ৩৬৬) দিনে বিভক্ত করা হয়। তারপর ১২ মাসে (৩০ ডিগ্রি করে) বিভক্ত করা হয় (রাশি ভাগের মতো)।
লুনার ক্যালেন্ডার
জ্যোতির্বিদ্যায়, সংযোজন বলতে যখন দুটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বস্তু বা মহাকাশযান আকাশে একে অপরের কাছাকাছি বলে মনে হয়। বিরোধিতা হল পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিদ্যাতে ব্যবহৃত একটি শব্দ। এটি ব্যবহার করা হয় যখন পৃথিবী থেকে দেখলে আকাশের দুটি বস্তু আকাশের বিপরীত দিকে থাকে। চাঁদের দুটি পরপর সংযোজন অবস্থায় বা বিরোধিতা অবস্থায় আসার সময়কে এক চান্দ্রমাস বলে। অর্থাৎ দুটি পূর্ণিমার বা অমাবস্যার মধ্যের সময়কে এক চান্দ্রমাস বলে। এবং ১২টি চান্দ্রমাস নিয়ে এক চান্দ্রবছর ধরা হয়। এটাই লুনার ক্যালেন্ডারের মূল বিষয়।
লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার
চান্দ্রবছর সূর্যবছরের থেকে ১১ দিন ছোট। তাই তিন বছরে ৩৩ দিন ছোট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বর্ষাকাল, গরমকাল, শীতকাল ইত্যাদি আর সমন্বয়ে থাকবে না। শুদ্ধ লুনার ইসলামিক হেজিরা ক্যালেন্ডার প্রণয়নে কালের সমন্বয় আনা হয়নি। কিন্তু ভারতীয় লুনার ক্যালেন্ডারে প্রতি তিন বছর বাদে একটি মলমাস সংযুক্ত করে ঋতুবিন্যাসের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এটাকে বলে লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার একটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার রোমান ক্যাথলিকদের এবং প্রটেস্টান্ট চার্চসমূহের উৎসবের ঘটনাচক্রের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সোলার ক্যালেন্ডার। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে পরিবর্তন করে প্রস্তুত করা হয়েছে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার খ্রিস্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে রোমান সম্রাট জুলিয়াস কাইসার প্রণয়ন করেন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন করে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যবহার হয়। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ৩৬৫ দিনের এবং প্রতি চতুর্থ বছর ৩৬৬ দিনের হয়। অর্থাৎ জুলিয়ান বছর ৩৬৫ দশমিক ২৫ দিনের। প্রকৃত পর্যবেক্ষণের পর জানা যায় প্রকৃত সোলার বছর ৩৬৫ দশমিক ২৪২২ দিনের। কাজেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের ইস্টারডেতে বছরে শূন্য দশমিক ০০৭৮ দিনের ত্রুটি ধরা পড়ে। ১৫৮২ সালে এই ত্রুটি-সমষ্টিগত দিনের সংখ্যা ১০ দিন। সেইজন্য ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ গ্রেগরি XIII ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করেন এবং ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর, শুক্রবার পরিবর্তন করে হয়েছিল ১৫ অক্টোবর শুক্রবার ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ। (অর্থাৎ ওখানে ওই বছরে যে শিশু ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিল, পরের দিন তার বয়স ১০ দিন হয়ে গিয়েছিল!)। এখানেও ৪০০ বছর বাদে বাদে লিপইয়ারগুলো নিয়ে ত্রুটি ধরা পড়ে। এই ত্রুটি ১১ দিনের। তাই গ্রেট ব্রিটেনে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ১৭৫২, পরিবর্তন করে হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বৃহস্পতিবার ১১ সেপ্টেম্বর ১৭৫২।

আরও পড়ুন-কিছুই যেন ঠিক হচ্ছে না, হতাশ রোহিত, অবসর জল্পনার মধ্যেই হিটম্যানকে খোঁচা অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার

জাতীয় ক্যালেন্ডার
তখন সবে ভারত স্বাধীন হয়েছে, নানা ভাষা, নানা মত, নানা প্রচলিত আঞ্চলিক প্রথা। একই দিনপঞ্জির নিচে সমস্ত প্রাদেশিক নিয়মকানুন মেনে এইসময় জাতীয় ক্যালেন্ডার প্রচলনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু একটি ঐক্যবদ্ধ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান তথ্যসম্মিলিত জাতীয় ক্যালেন্ডার প্রণয়ন অনুভব করেন। এই জন্য ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে প্রফেসর মেঘনাথ সাহার তত্ত্বাবধানে একটি জাতীয় ক্যালেন্ডার সংস্কার সমিতি গঠন করেন। এই সমিতি সমস্ত ভারতে ব্যবহারের জন্য সোলার ক্যালেন্ডারের অনুমোদন করেন। এই সমিতি সামাজিক ধর্মীয় কার্যকলাপের জন্য লুনি-সোলার ক্যালেন্ডারের অনুমোদনও করেন। তদানীন্তন সরকার জাতীয় ক্যালেন্ডার সংস্কার সমিতির সুপারিশ অনুযায়ী ২২ মার্চ ১৯৫৭ তারিখে সোলার ক্যালেন্ডার জাতীয় ক্যালেন্ডার হিসাবে গৃহীত হয়। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সময়কালকে শক যুগ বা শক ইরা বলে। প্রথম মাস চৈত্র ৩০ দিনের। আর লিপ ইয়ার হলে চৈত্র ৩১ দিনের। তারপর বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এবং ভাদ্র মাস ৩১ দিনের আর আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ৩০ দিনের। জাতীয় ক্যালেন্ডারে লিপইয়ারের শুরু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো। প্রসঙ্গত, পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেন্টার কলকাতা থেকে রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ প্রতি বছর প্রস্তুত করা হয়।

Latest article