১৭ লাখি হীরে আর একজন ‘ফকিরে’র কিস্সা

জো বাইডেন পরিবার ২০২৩-এ যেসব ‘সরকারি’ উপহার পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি উপহার একটি হীরের আংটি। নরেন্দ্র মোদির দেওয়া সেই উপহার আখ্যান লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

এমনটা হতে পারত রূপকথার গল্পে। কিংবা কোনও লোককথার আখ্যানে। বহুকালাগত উপকথায়।
এমনটা হয়েছে একুশ শতাব্দীতে। আমাদের চেনা আন্তর্জাতিক পরিসরে। এই তো সেদিন। বিগত বছরের জুন মাসে।
এক ফকির এক গরিব দেশের রাষ্ট্রনায়কের পদে বসেছেন। তিনি গিয়েছিলেন আর এক ধনী দেশে। ধনী দেশটির প্রধান রাষ্ট্রনায়কের পত্নীকে দরিদ্র দেশটির নিজেকে ফকির বলে জাহির করা রাষ্ট্রনায়ক একটি উপহার দিয়েছেন। উপহারের যা দাম সেই অর্থ দিয়ে অপুষ্টিতে ভোগা অন্তত তিন হাজার শিশুকে কমপক্ষে ৮৩ দিন দুবেলা পেট পুরে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো যেত। ওই অর্থ দিয়ে হাজার হাজার গ্রামবাসীর মনরেগায় একবেলা কাজের মজুরি দেওয়া যেত। ওই অর্থ দিয়ে লাখ লাখ স্কুলপড়ুয়ার মিডডে মিলের ব্যয় নির্বাহ করা যেত। কিন্তু সেসব না করে তথাকথিত এক ‘ফকির’ রাষ্ট্রসেবী বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির পত্নীকে ওই অর্থ দিয়ে একটা হীরের আংটি উপহার দিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন-সাংসদ তহবিলে তৈরি প্রকল্পের সূচনায় কল্যাণ

‘আচ্ছে দিন’-এর ‘আচ্ছা কিস্‌সা’। ১৭ লাখি হীরের আংটি উপহারের কিস্‌সা। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন একজন যিনি রোজ নিজেকে ‘ফকির’ বলে প্রচার করতে ভালবাসেন। কোন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ওই উল্লিখিত ‘ফকির’?
বলতে দ্বিধা নেই, ওই ‘ফকির’ তাঁর শাসনকালে দেশটাকে প্রায় ফকিরসম নিঃস্ব করে ছেড়েছেন। রেকর্ড বেকারত্বে ভুগছে সেই দেশ। জ্বলছে খিদের জ্বালায়। অপুষ্টিতে ধুঁকছে সেই দেশের শিশুরা।
দেশটার নাম ভারত। আর ওই ‘ফকির’ আর কেউ নন। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আইএলও এবং ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট কৃত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, এদেশে ২০০০-এ মাধ্যমিক বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে অথচ বেকার, কাজ নেই, এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩৫.২ শতাংশ ছিল। ২০২২-এ মাধ্যমিক বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্নদের মধ্যে বেকারের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫.৭ শতাংশ। ভারতে কর্মহীন বেকারদের ৮৩ শতাংশের বয়স ৪০-এর নিচে। উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলিতে বেকারত্বের মাত্রা এবং শ্রমিকের মজুরি, দুটোই বকি দেশের চেয়ে যথাক্রমে বেশি ও কম। অর্থাৎ, যেসব রাজ্যে বেকারত্ব বেশি, সেসব রাজ্যে শ্রমিকের মজুরি কমছে। অথচ, জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে।
২০২১-এ ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ ছিল যুব সম্প্রদায়ভুক্ত। হিসাব বলছে, ২০৩৬-এ সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়াবে ২৩ শতাংশে। গড় বয়সের নিরিখে এখনও বিশ্বের যুবতম দেশ ভারত। অথচ মোদি জমানার সৌজন্যে সেই দেশ নিজের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। দেশের ৬০ শতাংশ যুবক এখনও একাধিক ফাইল অ্যাটাচ করে ই-মেল পাঠাতে পারেন না। প্রায় সমসংখ্যক যুবক কপি-পেস্ট করতে জানেন না। অর্থাৎ ডিজিটাল প্রযুক্তি-নির্ভর কাজের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ যুবক এখনও সড়গড় নন।

আরও পড়ুন-স্মরণে সত্যেন

এরই মধ্যে শ্রমশক্তিতে আদিবাসী ও তফসিলি অংশের মানুষদের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে জাতিগত বিদ্বেষ আর বর্ণবাদ। বিষয়টা এমন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে জাত-বৈষম্য চলছে, তা অস্বীকার করছে না সুপ্রিম কোর্টও। রোহিত ভেমুলা মামলায় সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সূর্যকান্ত ও উজ্জ্বল ভুখাইয়ার বেঞ্চ তাঁদের পর্যবেক্ষণে একথা ব্যক্ত করেছেন। সেইসঙ্গে এই বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে সতর্ক করে ইউজিসি যাতে নোটিশ পাঠায়, সে-নির্দেশও প্রদান করেছে।
এরকম একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গায়ে যে স্যুট চাপান, তাতে সুতো দিয়ে তাঁর নাম লেখা থাকে। দাম দশ লাখ টাকা। এরকম একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য যে বিমান কিনতে হয় সরকারকে তার দাম ৮৫০ কোটি টাকা। এরকম একটা দেশের ‘প্রধান সেবক’ নরেন্দ্র মোদি ঘুরে বেড়ান ৮৫টি দেশে। আর তাঁর নিমুজিন কিনতে সরকারকে খরচ করতে হয় ১২ কোটি টাকা।
আর এরকম একটা দেশের ‘ফকির’ ‘প্রধান সেবক’ নরেন্দ্র মোদি আমেরিকায় তাঁর বন্ধু বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে গিয়ে যে আংটি উপহার দিয়ে এসেছেন ২১ জুন ২০২৩-এ, সেটির মূল্য ১৭ লক্ষ টাকা (২০ হাজার ডলার)। হীরের ওজন ৭.৫ ক্যারেট। সুরাটের কারখানায়, কৃত্রিম হীরে দিয়ে বানানো ওই আংটি ‘কার-এ-কলমদানি’ নামে এক বিশেষ কাশ্মিরী বাক্সে করে ওয়াশিংটন সফরের সময় বাইডেন-পত্নীকে দেন মোদি। করদাতাদের টাকায় এই বদান্যতা। আর সেটা জানা গেল, কারণ খোদ হোয়াইট হাউস উপহারের তালিকা প্রকাশ করেছে। আর উপহারের মূল্য সমেত তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে। বাইডেনের মেয়াদের শেষবেলায় যদি না এই তালিকা প্রকাশিত হত, তবে গোদি মিডিয়ার সুচারু কৌশলে এসব খবর বাইরে আসতই না। তা নিয়ে হইচইও হত না।
মনে রাখতে হবে, যে দেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষের দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার সামর্থ নেই, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টের পত্নীকে এমন একটা উপহার দিয়েছেন, যা দামের নিরেখে অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া বহুমূল্য উপহারগুলোকে হার মানিয়েছে।

আরও পড়ুন-উড়ে যাই দূরে যাই

বাইডেনের মেয়াদ ফুরোতে আর দিন দুয়েক বাকি। তারপর এই হীরের আংটি কোথায় যাবে? বিলেত থেকে কোহিনুর ভারতে ফেরত আনার ব্যাপারে যে তৎপরতা দেখা গিয়েছিল, তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। যদি মোদি ভারত সরকারের তরফে এই উপহার দিতেন তবে ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে আমেরিকার বিদেশ দফতরের বার্ষিক অডিট রিপোর্টে তা উঠে আসত। হোয়াইট হাউসের নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশ থেকে পাওয়া কোনও উপহারের মূল্য ৪৮০ ডলারের বেশি হলে (মোদির দেওয়া হীরের আংটির দাম ২০ হাজার ডলার) সেটাকে জাতীয় মহাফেজখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বার্ষিক অডিট রিপোর্টে হীরের আংটি অনুল্লিখিত। ফলে মহাফেজখানায় প্রেরণ নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। বাইডেন-দম্পতি বাইডেনের মেয়াদকাল শেষ হলে আংটিটা নিজেদের খরচে কিনে নিয়ে নিজেদের কাছে রাখতে পারেন। এখনও পর্যন্ত তাঁরা সেরকম কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। আর আমাদের ‘দেশসেবক ফকির’ যদি মার্কিন ফার্স্ট লেডিকে হীরের আংটিটি ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন, তবে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী মোদি ও বাইডেন-পরিবার— উভয় পক্ষই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন।
কী হয়, সেটাই এখন দেখার।

Latest article