সে প্রথম প্রেম আমার

মে মাসের কাঠফাটা রোদ্দুরের সঙ্গে বহুদিন কোনও সম্পর্ক নেই। আমেরিকায় এই সময় মোলায়েম রোদ গায়ে মেখে জনগণ মৌজ করে।

Must read

দোয়েল নাগ
মে মাসের কাঠফাটা রোদ্দুরের সঙ্গে বহুদিন কোনও সম্পর্ক নেই। আমেরিকায় এই সময় মোলায়েম রোদ গায়ে মেখে জনগণ মৌজ করে। দিন কেন, প্রায় যুগ বয়ে গেছে, দেশে আসেনি সুনন্দা। হয়তো কোনওদিন ফেরাও হত না।
বম্বে থেকে মাকে ফোন করেছিল যখন, মা বলেছিল— আর কোনওদিন মুখ দেখব না তোর!
একটা চাপা ক্ষোভ পুষে রেখেছিল এতকাল। তাই ফেরার তাগিদ অনুভব করেনি কখনও। বাকিরাও যোগাযোগ রাখেনি। এতকাল বাদে হঠাৎ দাদা ভিডিও কল করেছিল। সেই কবেকারের তরুণ দাদার মুখে বার্ধক্যের ঘনঘটা দেখে মনে হয়েছিল সময়টা বড় তাড়াতাড়ি বুকে হাঁটা সরীসৃপের মতো নিঃশব্দে সরে গেছে।

আরও পড়ুন-মন-ভাল-করা এক সম্প্রীতির সুর বই জুড়ে

—রুকু একবারটি আয়, বাড়িটা বিক্রি হচ্ছে। তোর সই লাগবে।
দায়ে পড়ে এসেছে সুনন্দা। সম্পত্তির ভাগীদার হওয়ার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় তার ছিল না। কলকাতা, এ-পাড়ার প্রতি অন্তর থেকে কোনও আকর্ষণ অনুভব করে না আর। আমেরিকায় এক নিটোল সংসার যাপন করে সে। শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে যে অতীত তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, তার ডাকে মনের আগল খুলতে চায়নি সে। তবে শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিরা এখনও বুকের গভীরে শাণিত ফলার মতো গেঁথে রয়েছে। নাড়া পড়লেই রক্তক্ষরণ হয়।
দাদা-বউদির অনেক অনুরোধেও ও বাড়িতে জলস্পর্শ করেনি সে, যে বাড়ির দাওয়ায় একসময় মা গ্রাস করে ভাত খাইয়ে দিত, বাবাকে স্টেটসম্যান পড়ে শোনাত, সে লোকগুলোই তো আর নেই! সে দাদাও তো আর নেই, যে কথা নেই বার্তা নেই, বিনুনি ধরে টান দিত। বাড়ির লাল মেঝেতে তাই রুকুর পা আটকে গেলেও সুনন্দা সেদিনের মতো বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

আরও পড়ুন-চিন্নাস্বামীতে আজ রোহিত-বিরাট ম্যাচ

কয়েক দিনের জন্য ভাড়া করা ইনোভা গাড়ির ড্রাইভারটা কোথাও খেতে গেছে। গলি পেরিয়ে চৌরাস্তার বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে সুনন্দা। রাস্তার দু’ধারের দোকানগুলো সব পাল্টে গেছে, রাস্তাটাও হয়তো পাল্টেছে। পুরনো মানুষজনের পায়ের ধুলো ঢেকেছে নতুন গলা পিচে বেশ কয়েকবার। তবে পথটা বদলায়নি। বাস স্ট্যান্ডটা আগে লোহার ভাঙা রেলিং-ঘেরা ছিল। পাশেই একটা হরিণঘাটা দুধের গুমটি ছিল। সাদা কাচের বোতলে দুধ আনতে আসত দাদা। বউদির সঙ্গে দেখা করার ছুতোয়।
এখন বেশ কেতাদুরস্ত হয়েছে। স্টিলের চেয়ার, কাচ-ঢাকা, ছাউনি দেওয়া। রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ঘিয়ে রঙের কুকুরগুলো কেন্নোর মতো গুটিয়ে শুয়ে আছে। কাকপক্ষীরও দেখা নেই, যানবাহন তো দূর অস্ত।
এই বাসস্ট্যান্ড থেকেই এক সময় স্কুল-কলেজ যেতে বাসে উঠত। সহেলী-সুতপারাও আসত। কলকল হাসিগুলো যেন এখনও শুনতে পাচ্ছে। সেই বন্ধুরা এখন কোথায় কে জানে! সুনন্দার এখন মধ্য-পঞ্চাশ। শরীরের খাঁজে চর্বির আধিক্য। নীলরঙা লং স্কার্টের সঙ্গে স্লিভলেস সাদা টপ পরেছে সে। একসময় তার রক্ষণশীল বাড়িতে এ-সকল পোশাকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তার চেহারায়, কথার চলনে বিদেশি ছাপ পড়েছে। দেশ-কাল-সময়ে সুনন্দা অভিযোজিত হয়েছে নিরন্তর।

আরও পড়ুন-নির্লজ্জ! বিজেপি পার্টি অফিসে আইএসএফ বৈঠক

গরমে দাঁড়িয়ে সুনন্দার মনে হচ্ছিল এতটা রূঢ় হয়তো না হলেও হত। অন্তত ড্রাইভার না আসা পর্যন্ত বাড়িতে বসে এলেই হত। বউদি অনেক করে অনুরোধ করেছিল, দুপুরে খেয়ে যেতে। সুনন্দা রাজি হয়নি। ও-বাড়িতে বেশি সময় কাটানো মানেই, ঘন দুধের ননীর মতো পুরনো অবাঞ্ছিত কথারা ভেসে উঠত। যা কারওরই অভিপ্রেত নয়। যতই সুনন্দা মনে করুক, জ্ঞানত কোনও অন্যায় সে করেনি, কিন্তু বাড়ির মেয়ে কাউকে না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হলে বাড়ির মানুষকে যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনার শিকার হতে হয়, সে অপরাধবোধ এ-বাড়ির সোঁদা বাতাসে মিশে আছে। তাই সুনন্দার মনে হয়, এ-বাড়ির বাতাস বড় ভারী। দম বন্ধ হয়ে আসে তার।
হঠাৎ লাঠির ঠকঠক আওয়াজে সুনন্দা ঘুরে তাকাল। এক ভদ্রলোক তার পাশে একটি চেয়ার ছেড়ে বসলেন। একপলক তাকে দৃষ্টিপথে জরিপ করে সুনন্দা। শীর্ণ দেহ, বয়স আনুমানিক তারই মতো। মাথা কেশশূন্য। লাঠির মাথায় দু-হাত রেখে মুখ নামিয়ে বসেছেন। ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে মাথার বিস্তৃত টাক ও মুখ মুছতেই সুনন্দার সঙ্গে চোখাচোখি হল। এ-দৃষ্টি সুনন্দার বড় চেনা।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় শিশু কমিশনের অসভ্যতা-গুন্ডামি, সঙ্গে বিজেপি নেতা, গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ

ক্ষণিকের জন্য সুনন্দার মনে হল সময় যেন পিছনে চলতে শুরু করেছে। চারপাশে বড় কোলাহল, বাসস্ট্যান্ডটাও পাল্টে গেছে। সুনন্দার ক্লাস নাইন। কমলা-পাড় শাড়ি, মাথার দু’পাশে এলানো বেণীর প্রান্তে কমলা ফিতে বাঁধা। সুনন্দা রোজ পনেরো মিনিট আগে বাসস্ট্যান্ডে আসে। ফাঁকা নাইন-বি বাসটাও ছেড়ে দেয়। উল্টোদিকে কালো প্যান্ট-সাদা শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে। ছেলেটা দৃষ্টির আঁকশিতে ওকে গেঁথে রাখে। সুনন্দা এদিক-ওদিক তাকায়, বিনুনি দোলায়, আঁচলের খুঁট পাকায়, কিন্তু জানে, ছেলেটার দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ। প্রথমদিকে বেশ বিরক্ত হত, অস্বস্তি হত। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সে-দৃষ্টির সম্মোহনে পড়েছে সে। ওর শরীরে জেগে ওঠা সদ্য-যৌবন স্বেচ্ছায় সে দৃষ্টি খোঁজে।
সহেলী বলেছিল একদিন,
—দেখ, ছেলেটা তোকে ঝাড়ি মারছে। বেপাড়ার ছেলে, কড়কে দিবি?
সুনন্দা ছোট্ট উত্তর দিয়েছিল, না।

আরও পড়ুন-লেভির লোভী সিপিএম, দলের হিসাবরক্ষকের রহস্যমৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন

ও অপেক্ষা করত, কবে ছেলেটা মাঝের রাস্তা পার করে এপারে আসবে— চিঠি হাতে। কিন্তু ছেলেটার চোখের নীরব ভাষায় শব্দতরঙ্গরা খেলা করত, তারা প্রতিফলিত হত না।
দিন কেটে বছর গড়াল। সুনন্দা স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠল। ঝড়-বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে ছেলেটা রোজ আসত। একদিন দাদা ছেলেটার কলার চেপে ধরেছিল। ভয়ে সুনন্দার সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। রাগলে দাদা রাবণ।
ও ভেবেছিল ছেলেটা হয়তো পরের দিন আসবে না। পরের দিন উল্টোদিকে শূন্য ফুটপাতে তাকিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। তারপর নাইন-বিতে উঠে জানলার ধারে বসতেই দেখতে পেয়েছিল, ছুটতে ছুটতে আসছে ছেলেটা।
কলেজে আলাপ হল মেহেবুবের সঙ্গে। বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হতে সময় লাগেনি। সেদিন সারা শহর ভিজছিল বৃষ্টিতে। কলেজ-ফেরত এক জনহীন গাড়িবারান্দার নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জন অপেক্ষা করছিল বৃষ্টি থামার। হয়তো-বা দু’জনেই চাইছিল এ-বৃষ্টি প্রলম্বিত হোক। তারপর কখন যেন সুনন্দার আঙুলের খাঁজে প্রশ্রয় পেয়েছিল মেহেবুবের আঙুল, ওদের ঠোঁটের কোলাজে সুনন্দার মনে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল নিভৃত কোণে এক যুবকের প্রতীক্ষা। তখন তো গোটা পৃথিবীটাই রঙিন হয়ে গেল। পিছনের সবকিছু ধূসর হয়ে গেল সুনন্দার কাছে। বাড়িতে যে এ-সম্পর্ক কেউ মানবে না, তা তো জানাই ছিল। সুনন্দা তাই একদিন কলেজ যাবার নাম করে কলকাতাকে বিদায় জানাল মেহেবুবের হাত ধরে। এরপর বম্বেতে সংসার পাতা, সেখান থেকে আমেরিকা। জীবন আর ফিরে তাকানোর সুযোগ দেয়নি।

আরও পড়ুন-অভিনেত্রী পল্লবীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লোপাট

—আচ্ছা, আপনি কি—
—হ্যাঁ আমিই সে, যাকে শুধুই দেখেছেন। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারেননি।
চেনা দৃষ্টিতে প্লাবন এল।
—ভাল আছ? এতদিন পর এখানে?
—একটা সম্পর্কের সুতো আলগা বাঁধনে বাঁধা ছিল, সেটুকুও কেটে গেল আজ।
সুনন্দার মনে বহুকাল আগের হাজারো প্রশ্নেরা হুটোপুটি করতে লাগল। মনের কোন সিন্দুকে যে এত কৌতূহল বন্দি ছিল, তা সে নিজেও জানত না।
ওর বারবার মনে হচ্ছিল, কী দরকার, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলোকে এত আহ্লাদ দেওয়ার। উত্তর না জানলেই বা কী এমন বড় ক্ষতি হবে তার? তবে হঠাৎ জেগে ওঠা কৌতূহলকে সারাজীবন ঘুম পাড়িয়ে রাখার মতো ঘুমপাড়ানিয়া গান যে তার জানা নেই! তাই প্রশ্নটা করেই ফেলল।
—কখনও মনে হয়নি আপনার, রাস্তা পেরিয়ে এসে ভালবাসার প্রস্তাব দেওয়ার কথা। ভয় পেতেন?

আরও পড়ুন-প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর লড়াই রুখতে চক্রান্ত চলছে, দাবি ট্রাম্পের

ভদ্রলোক অন্যদিকে তাকিয়ে বাঁকা চাঁদের মতো হাসি হাসলেন। যেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই বসেছিলেন এতদিন।
—না মনে হয়নি। তোমাকে বিয়ে করে ঘরনি করব, সংসার করব, এমন ইচ্ছা কোনওদিন তো আমার ছিল না। তুমি আমার স্বপ্নচারিণী, যে আমার কল্পনায় আসে রোজ, যে চাল-ডালের হিসেব মনে করিয়ে দেয় না। বছর শেষে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরে না। একাকী অন্ধকারে যে মোহময়ী রূপে আসে। হাসির জোৎস্নায় ভাসিয়ে দেয় আমার লোনাধরা স্যাঁতসেঁতে ঘর। সেসময় সকাল হলেই কীসের অমোঘ টানে চলে আসতাম বাসস্ট্যান্ডে। প্রাণভরে, আশ মিটিয়ে দেখতাম তোমায়। আমার কল্পনার খাঁচায় এতদিন আটকে রেখেছিলাম এক একুশ বছরের রুকুকে।
ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে একটা বাস এসে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর হাঁকল, ‘ধর্মতলা ধর্মতলা’।
তবে বাসটা দাঁড়িয়েই রইল।
—আসি।
লাঠিতে ভর দিয়ে অতি কষ্টে পা টেনে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।

আরও পড়ুন-এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি-ইতিহাস

—আপনার পায়ে কী হয়েছে?
তোমাকে খুঁজে না পাওয়ায় তোমার দাদা আর কয়েকজন ছেলে এসে মেরে আমার পায়ের হাড় গুঁড়ো করে দিয়েছিল। অপারেশন হলেও আর ভাল করে হাঁটতে পারি না।
ভদ্রলোক কিছুটা এগিয়ে পিছনে ফিরে বললেন, তোমার সঙ্গে দেখা না হলেই বোধহয় ভাল ছিল। তোমার যে ছবি মনে গেঁথেছিলাম, আজ তা চিরকালের মতো মুছে গেল। যেদিন তুমি নিরুদ্দেশ হয়েছিলে, সেদিনও নিজেকে এত নিঃস্ব মনে হয়নি।
বাসটা আর দাঁড়াল না। একরাশ কালো ধোঁয়া উড়িয়ে সুনন্দাকে নিঃসঙ্গ করে হারিয়ে গেল।

অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article