আইসক্রিমের রূপকথা

প্রচণ্ড দাবদাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এইসময় শরীর ও মনকে এক নিমেষে শীতল করে তোলে আইসক্রিম। বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম রাজত্ব করছে। যেগুলো অত্যন্ত প্রিয় আট থেকে আশির কাছে। গরমের দিনে আইসক্রিম-কথায় কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

আমাদের বাড়ির পাশে একটা আইসক্রিমের কল ছিল। স্কুলের গরমের ছুটির দিনগুলোর দুপুরবেলা মানেই ছিল আমাদের আইসক্রিম খাওয়ার বায়না। সেই সময় আজকের দিনের মতো এত বাহারি আইসক্রিম পাওয়া যেত না। তৈরি হত বরফ আইসক্রিম। আর সেটাই ছিল আমাদের একান্ত প্রিয়। আইসক্রিমের আবিষ্কার কিন্তু বহু যুগ আগেই হয়েছিল। আইসক্রিম আবিষ্কার নিয়ে বহু প্রচলিত কাহিনি আছে…।

আরও পড়ুন-আগামীর পড়ুয়াদের অতীত, না-চেনাতে এবার বইয়ে বদল

রোমের সম্রাট ছিলেন নিরো ক্লাউডিস। তার একবার ঠান্ডা কিছু খাবার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। তার ইচ্ছার মান রাখতে রাজ হেঁশেলের বাবুর্চি এক কর্মচারীকে বরফ আনার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় পাঠায়। বরফ আসার পর, সেই বাবুর্চি বরফের সঙ্গে মধু এবং ফল মিশিয়ে সম্রাটকে খেতে দেন। সম্রাট নিরোর ফল আর মধু মিশ্রিত বরফ খেয়ে খুব ভাল লাগে। আর এর পরেই মধু ফল মিশ্রিত বরফের তৈরি খাবারটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বরফকুচির সঙ্গে মধু, ফল প্রভৃতি মিশিয়ে তৈরি হতে থাকা ভিন্ন স্বাদের ঠান্ডা রঙিন মিষ্টি পানীয়টি বাগদাদের খলিফাদের কাছে এসে পৌঁছল তখন এর মধ্যে বাদামকুচি, পেস্তা সহ বিভিন্ন ধরনের শুকনো ফলের ব্যবহার হতে শুরু করল। এই বাগদাদের খলিফারাই এই বরফ মিশ্রিত মিশ্রণে প্রথম চিনির ব্যবহার শুরু করে।

আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা

তবে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের বাজারে এক রকমের খাবার পাওয়া যেত, বরফকুচির সাথে আর মধু আর ফল মিশিয়ে তৈরি হত সেই খাবার। আবার বাইবেল থেকে জানা যায় যে রাজা সোলায়মান ফসল কাটার মরশুমে বরফ-পানীয় খেতে ভালবাসতেন, আবার আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধুর সঙ্গে বরফ মিশিয়ে খেতে ভালবাসতেন। আর এই কারণে মনে করা হয় যে আইসক্রিম তৈরির ধারণা বহু প্রাচীন। কারণ এইগুলোই আইসক্রিম তৈরির রেসিপির সূত্র বলে মনে করা হয়।
কিন্তু সেই সময় আইসক্রিমে দুধ ব্যবহার হত না।

আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ

তবে মনে করা হয় দুধ দিয়ে তৈরি আইসক্রিমের জন্মস্থান হচ্ছে চিন। চিনের শাং সাম্রাজ্যের রাজা টাঙের রাজত্বকালে বরফ দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবারের প্রচলন ছিল। টাঙের নিজস্ব ৯৪ জন লোক মিলে এই খাবারটি বানাত। তারা এই খাবারটি মহিষের দুধ, আটা এবং কর্পূর মিশিয়ে বানাত। চিনের ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সম্রাট কুবলাই খানের লোকেরা এক ধরনের জমাট বাধা বরফের মতো ঠান্ডা দুধের খাবার ঠেলাগাড়ি করে বিক্রি করত। ইতালিয়ান অভিযাত্রী মার্কোপোলোর সেই জমাটবাঁধা দুধের খাবারটা খুব পছন্দ হয়, আর তখন তিনি দুধ দিয়ে তৈরি জমাটবাঁধা ঠান্ডা খাবারটি বানানোর কৌশল শিখে নেন। আর মার্কোপোলোর হাত ধরেই চিনে প্রস্তুত এই খাবারটি ইউরোপে প্রবেশ করে। এই খাবারটিই পরবর্তীকালে আইসক্রিম নামে পরিচিতি লাভ করে।

আরও পড়ুন-তুমি অনেকেরই প্রেরণা, কার্তিককে হার্দিক

১৫৩৩ সালে ইতালি থেকে ফ্রান্সে আসে আইসক্রিম, তবে এর পেছনে আছে একটি মজাদার ইতিহাস। কথিত আছে, ইতালির রাজকন্যা ক্যাথরিনের বিয়ে হয় ফ্রান্সের রাজা অরির। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দিন ক্যাথরিন বায়না করে তার প্রিয় রাঁধুনি রগেরিকে নিজের সঙ্গে ফ্রান্সে নিয়ে যান। এই রাঁধুনির কাছেই অনেকরকম আইসক্রিমের সিক্রেট রেসিপি ছিল, মনে করা হয় এভাবেই ফ্রান্সে আইসক্রিমের প্রবেশ ঘটে। আর ফ্রান্স থেকে আইসক্রিম ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। কথিত আছে, আইসক্রিম যখন প্রথম ইংল্যান্ডে এসেছিল তখন ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন প্রথম চার্লস। তিনি তার বাবুর্চিকে ৫০০ পাউন্ড করে উপহার দিতেন, যাতে তাঁর রন্ধনশালা থেকে আইসক্রিমের রেসিপি ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে না পড়ে।
রাজা প্রথম চার্লসের খাবারের টেবিলে রোজ যিনি আইসক্রিম তৈরি করে সরবরাহ করতেন তাঁর নাম ছিল ডি মার্কো। সেই ডি মার্কো প্রথম চার্লসের নির্দেশ অমান্য করেন আর তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীকালে আইসক্রিমের রেসিপি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথমদিকে আইসক্রিম কেবলমাত্র রাজা-বাদশা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষজনদের জন্যই তৈরি হত। ভিক্টোরিয়ান যুগে নরওয়ে ও আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে আইসক্রিম আমদানি করা হত। আর সেই কারণে এর দাম ছিল অনেক বেশি।

আরও পড়ুন-পেট্রাপোল সীমান্তের পার্কিং লটে তিন পণ্যবোঝাই গাড়িতে আগুন

১৬৬০ সালের পর থেকে এই বরফ দিয়ে তৈরি খাবারটি দেশের সাধারণ মানুষজনদের জন্য সহজলভ্য হয়ে যায়। আঠারোশো শতকে আইসক্রিমের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় আমেরিকার হাত ধরে। ম্যাংগো, চকোলেট, দুধ, ক্রিম, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি প্রভৃতি ফ্লেভার মিশিয়ে আধুনিক আইসক্রিম তৈরি হওয়া শুরু হয়। ১৭৪৪ সালে আমেরিকায় আইসক্রিমের প্রথম সংস্করণ আসে।
১৭৬৮ কিংবা ১৭৬৯ সাল নাগাদ প্রথম আইসক্রিমের রেসিপি নিয়ে একটি বই বার করা হয়। বইটির নাম ছিল দ্য আর্ট অফ মেকিং ফ্রজেন ডেজার্ট (The art of making frozen desserts)। ২৪০ পৃষ্ঠার বইটিতে শুধুমাত্র রেসিপি ছিল না, তার সাথে ছিল দার্শনিক এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যা।
১৭৭৭ সালের ১২ই মে নিউইয়র্ক গেজেটে আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। ১৭৯০ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আইসক্রিমের জন্য ২০০ ডলার খরচ করেন। আঠারোশো শতকের পরেই আইসক্রিম একটি শিল্প হয়ে ওঠে এবং আমেরিকার অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির মতো আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিতেও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হতে শুরু করে।

আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় আক্রান্ত তৃণমূল কংগ্রেসের দুই মহিলা প্রার্থী

ন্যান্সি এম জনসন ১৮৪৩ সালে হ্যান্ড আইসক্রিম তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং ১৮৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই যন্ত্রটির পেটেন্ট করেন তিনি। এখনও এই যন্ত্রের মূল নকশা ব্যবহৃত হয়। এই যন্ত্রটি সাহায্যে ঘরে বসে সহজেই আইসক্রিম তৈরি করা হত। ১৮৫১ সালে মেরিল্যান্ডের জ্যাকব ফুসেল প্রথম নিজের কারখানায় বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরি করেন। জ্যাকব ফুসেলের আগে অর্থাৎ আগের বছর কার্ল গাতি পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন এবং তিনি আইসক্রিমের গাড়ি করে আইসক্রিম বিক্রি করতেন এবং এই আইসক্রিমের গাড়িকে তিনি জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। আর সেই প্রথম মানুষের কাছে আইসক্রিম পৌঁছে যায়।
এরপরে ১৯০০ সাল থেকে আইসক্রিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারাবিশ্বে আইসক্রিম সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

আরও পড়ুন-ব্যাটিং ব্যর্থতায় হার, রঞ্জি বিদায় বাংলার

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাধারণ মানুষের কাছে আইসক্রিম অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এই সময় থেকেই সুপার মার্কেট এবং বিভিন্ন আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম বিক্রি হতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে প্রথম ভাসমান আইসক্রিম পার্লার তৈরি হয় পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নাবিকদের জন্য।
আস্তে আস্তে যখন আইসক্রিমের চাহিদা বাড়তে থাকে তখন আইসক্রিমকে আরও সুস্বাদু করার জন্য বিভিন্ন ফ্লেভার যোগ করা শুরু হতে থাকে। আর এরপরে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে আর এই বাড়বাড়ন্তর জন্যই ১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন পুরো জুলাই মাসটাকেই ন্যাশনাল আইসক্রিম মান্থ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-বিভাজনের রাজনীতি বরদাস্ত নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম রাজত্ব করছে। প্রায় সব দেশেই তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের আইসক্রিমকে বিভিন্নরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আরও সুস্বাদু করার চেষ্টা করছে। মধ্য পশ্চিম আমেরিকার ব্লু-মুন নামের নীল রঙের আইসক্রিম বেশ জনপ্রিয়। আরও একটি আইসক্রিম যেটাকে আমরা কোন বলে থাকি, সেই কোন আইসক্রিম যথেষ্ট বিখ্যাত একটি আইসক্রিম, এই কোন আইসক্রিম আবিষ্কারের পেছনে আছে একটি মজার ঘটনা। ১৯০৪ সাল, সেন্ট লুই-এর ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে একজন আইসক্রিমওয়ালা প্লেটে করে আইসক্রিম সার্ভ করছিলেন, কিন্তু সেখানে এত চাহিদা ছিল যে তিনি আর প্লেটের জোগান দিতে পারছিলেন না। তখন সেই আইসক্রিমওয়ালা ওয়াফল অর্থাৎ এখন যাকে আমরা ওয়েফার বলি তার কাছ থেকে ওয়াফরের কোন নিয়ে সেটার মধ্যে আইসক্রিম ভর্তি করে আইসক্রিম দিতে থাকেন। আর ওয়াফরের কোনের মধ্যে আইসক্রিম ক্রেতাদের মুখে এতটাই মুখরোচক লাগে যে সেখান থেকেই আবিষ্কার হয় আজকের কোন আইসক্রিম।
বর্তমানে আমাদের দেশেও নানা ফ্লেভার, নানা ব্র্যান্ডের আইসক্রিম পাওয়া যায়। যেগুলো আট থেকে আশি সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। আজকালকার দিনে সব ধরনের অনুষ্ঠানেই আইসক্রিমের উপস্থিতি লক্ষণীয়। মন-প্রাণ-শরীর, সব কিছুকেই এক নিমেষে শীতল করার অদ্ভুত জাদু আছে এই আইসক্রিমের মধ্যেই।

Latest article