পুজোতে শিশামারা নদীর সঙ্গে গল্প

শুধু হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল সাফারি নয়, রাতে রিসর্ট থেকে বেরিয়ে হাতি তাড়াতে হবে আপনাকে। সন্ধে নামার আগেই শিশামারা নদীর চরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবে হরিণ, গন্ডার, বাইসন। ভোরে একঝাঁক শরতের মেঘ অপেক্ষা করবে এই শিশামারা নদীর উপর আপনার সঙ্গে গল্প করবে বলে। নদীবাঁধের অন্য পাড়ে জঙ্গলে রয়েছে পাখিদের পাঠশালা। পুজোর ছুটিতে এসে এখান থেকেই করতে পারেন পাখিদের গানের সার্টিফিকেট কোর্স। আদি জনপদ জলদাপাড়ার শালকুমারের এই প্রকৃতি-প্রেমে মুগ্ধ হতে গেলে এবার পুজোয় আপনার ঠিকানা হতে পারে ভুটান সীমান্তের এই নতুনপাড়া গ্রাম। গ্রাম ভ্রমণের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

সকালবেলা খালি পায়ে মাটির বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবেন ভুটান সীমান্তে। ডানদিকে শিশামারা নদী। নদী পার হলেই ভুটানের গ্রাম। শরৎকালে নদীর দু’পাড় সাদা হয়ে আছে কাশফুলে। কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার মনে হবে আপনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন গভীর জঙ্গলে। পাখিদের কোলাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন প্রকৃতির মধ্যে। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগেই এক কাপ গরম চা নিয়ে যখন বাঁধের উপরে এসে বসবেন তখন হয়তো আপনার অবিশ্বাস্য মনে হবে শিশামারা নদীকে। জঙ্গল থেকে বন্যপ্রাণীরাও বেরিয়ে এসেছে জল খাওয়ার জন্যে। জলদাপাড়া জঙ্গল সাফারিতে যাওয়ার আগেই প্রকৃতির মাঝে তাদের দেখা পাবে।

আরও পড়ুন-বস্ত্র বিতরণ থেকে ডান্ডিয়া, মণ্ডপ মাতালেন মুখ্যমন্ত্রী

অন্য জলদাপাড়ার গল্প
ভাবছেন এগুলো কল্পনা। একেবারেই না। এবার পুজোর ছুটিতেই নিজের চোখে দেখে আসতে পারেন ভুটান সীমান্তের শালকুমারের নতুন পাড়া গ্রাম। এখানে ভুটান থেকে নেমে এসেছে শিশামারা নদী। শিশামারা আক্ষরিক অর্থ খরগোশকে মারা। এই নদীতে খরগোশের মৃত্যু নিয়ে নানারকম লোকস্মৃতি রয়েছে। এই নদীর উপরে রয়েছে মাটির তৈরি বাঁধ। ঠিক নদীর এক পাড়ে রয়েছে নিরিবিলি সব হোমস্টে। শালকুমারের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খবর রাখে না জলদাপাড়া ন্যাশনাল ফরেস্টের পর্যটকরা। তারা শুধু জঙ্গল সাফারি করেই ফিরে যায়। কিন্তু শালকুমার আর নতুন পাড়ায় রয়েছে প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার।
নদীর সঙ্গে গল্প
সকাল-সন্ধে রূপবতী এই শিশামারা বদলে ফেলে নিজেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই রিসর্টের বারন্দায় দাঁড়ালে দেখতে পাবেন শিশামারা নদীর ঠিক উপরে পরতে পরতে মেঘ জমেছে। সে যেন নিভৃতে বলছে যাব যাব। কিন্তু সে যাওয়ার আগেই সূর্যের ঝলমলে রোদে হাসতে থাকে কাশবন শিশামারা নদীর বাঁধের পাশে। সকালে বাঁধের উপর হাঁটতে হাঁটতে একদিকে যেমন দূর থেকে ভেসে আসা পুজোর বাদ্যি শুনতে পারেন তেমনই দেখা পেতে পারেন গ্রামের মানুষের সঙ্গে যারা ভোর থেকে শিশামারাতে মাছ ধরছে। তাদের ঝুলিতে রয়েছে নদীর সাডি মাছ, বোরোলি মাছ, শিলাচাটা মাছ।
সকালের শিশামারার রূপ পাগল করে দেয়। একটু এগোলেই শিশামারার উপর জেগে উঠেছে চর আর ডানদিকেই সকাল সকাল জঙ্গলের মধ্যে শুরু হয়েছে পাখিদের পাঠশালা। জঙ্গলের মাঝে বাঁধের পথ ধরে হাঁটলেই নানান হোম স্টে হোম রিসর্ট। তার যেকোনওটাই হয়ে উঠতে পারে এবার পুজোয় আপনার সেরা ঠিকানা।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর তৈরি শিশু বিভাগেই জন্ম নিল টেস্টটিউব বেবি, বিনা খরচে হল পুরো প্রক্রিয়া

হাতি তাড়ানোর গল্প
অনেক পর্যটক জলদাপাড়ায় যায় হাতি পিঠে চড়ে জঙ্গলসাফারি করতে কিন্তু শিশামারার পাড়ে এই রিসর্টগুলোতে থাকলে হাতি দেখতে আপনাকে জঙ্গলে যেতে হবে না। বরং চকোলেট বোমা দিয়ে হাতি তাড়াতে জঙ্গলের রিসর্টের বাইরে আসতে হতে পারে। পুজোর দিনে হাতি তাড়ানোর অভিজ্ঞতা সারাজীবন মনে রাখার মতো। নদীর পাড়ে বনান্ত রিসর্ট-এর মালিক রণবীরের কথা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। রণবীর তখন ছোট। তাঁদের পাড়ায় হাতি ঢুকে পড়ে গ্রামের মানুষ এবং রণবীরের চোখের সামনে এক মিনিটের মধ্যে শুঁড় দিয়ে আছাড় মারে রণবীরের বাবাকে। আজও সন্ধেবেলা চাঁদের আলোয় যখন রণবীরের মতো মানুষেরা হাতির গল্প শোনায় তখন চোখের কোনা চিকচিক করতে থাকে। রণবীর অবশ্য এই রিসর্টে গ্রামের মানুষদের এনে নতুন পাড়া শালকুমার জলদাপাড়ার গল্প শোনান। নদীর পাড়ে বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে নিয়ে যান। রণবীর ছাড়াও এখানে রয়েছে মলয় বিজয় মিঠুনদার রিসর্ট। পুজোর কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে চাইলে যেকোনও কেউ আসতে পারে শালকুমারের এই নতুন পাড়াগ্রামে। এখন থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে পৌঁছানো যায় জলদাপাড়া গেট নং ২-তে।
খাইসে রাইনো আইসে
এই নদীর পাড়ে মিঠুনের রাইনো রিসর্ট সবচেয়ে পুরনো। ঘরগুলো প্রকৃতির বৈচিত্র্যে ঠাসা। লগ দিয়ে তৈরি। ওয়াচটাওয়ারের কাজ করে। এর নাম ওয়াচটাওয়ার লগ হাউস। যেহেতু গাছের লগ চারিদিকে গাছ দিয়ে ঘেরা তাই এটা ওয়াচটাওয়ার লগ হাউস। আর একটা বাড়ি সবুজ রঙের। এটি ডুয়ার্সের ট্র্যাডিশনাল রুম। আজ থেকে অনেক দিন আগে ডুয়ার্সের যে-বাড়িগুলো যে ট্র্যাডিশন মেনে হত সেগুলোতে দুটো রুম আছে।
শেষ প্রান্তের বাড়িটি ওয়েস্টার্ন প্যাটার্ন ট্রি হাউস। এটি একটি ফ্যামিলি হাউস। এখানে ৮-১০ জন থাকতে পারে। এটি বড় একটি বিল্ডিং। এখানে একটা গাছকে স্পাইরাল করে সিঁড়ি ওঠানো হয়েছে। নতুন ঘরের নাম— টং ঘর। এগুলো সাধারণত বন্যপ্রাণী তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ওখানে দুটো রুম রয়েছে। এর ব্যালকনিতে বসেই আপনি হাতি তাড়াতে পারবেন।

আরও পড়ুন-জেলের আবাসিকদেরও উৎসবের ছোঁয়া, পাতে পড়ছে বিরিয়ানি-চিংড়ি

এভারেস্টের জেলখানায়
এই পুজোতে দোষ না করেও জেলখানায় আটক থাকতে চান! প্রকৃতির কোলে আটক হতে এক অদ্ভুত জেলখানার খোঁজ, জলদাপাড়া গ্রামের শালকুমার অঞ্চলের এভারেস্ট রিসর্টে।
পেয়ে যেতে পারেন ৫০% ছাড়, শুধুমাত্র একটি দিন আপনাকে থাকতে হবে কয়েদিদের জীবনে। জেলখানার কয়েদিদের পোশাক আর লকআপ রুমে একরাত কাটিয়ে বিনা দোষে জেলের ভাত খেয়ে দেখতে পারেন একবার।
এই রিসর্টেই রয়েছে কোচবিহার রাজবাড়ির আদলে আরও একটি কটেজ ও তাজমহলের আদলে একটি কটেজ, এই দুই কটেজে রাজকীয় মেজাজে রাজকীয় পোশাকে আতিথেয়তা উপভোগ করতেই পারেন পুজোর ছুটিতে।
মাটির নিচের রুমে রাত কাটিয়ে সকালে এই রিসর্ট থেকেই যেতে পারেন জলদাপাড়া সাফারিতে। বিকেলের সন্ধ্যা নামার আগে রিসর্টে বসেই শুনতে পারেন ময়ূরের ভেসে আসা ডাক।
শালকুমারে বেড়াতে এলে গ্রিন টি-র ছুটি। ক’দিন চেখে দেখতে পারেন তেলানি চা। প্রকৃতি আর গ্রামের মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর সেরা ঠিকানা হয়ে উঠেছে শালকুমার।

Latest article