এক নারী, যাঁর জীবনকথা, জীবনচর্যা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। শেখায় জীবনে যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন লক্ষ্যে স্থির থাকলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ সম্ভব। জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে নিজের কর্মকাণ্ড দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন যিনি তিনি হলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখিকা সোফিয়া কিনসেলা
‘তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার’—
ঠিক সেরকমটাই দেখা যায় সোফিয়ার জীবনী দেখলে, শুনলে।
আরও পড়ুন-বিয়ের ফাঁদে
লন্ডনের অক্সফোর্ড কলেজে শুরু করেছিলেন মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল হয়তো অন্যরকম এক বছর বাদে তিনি তাঁর পড়াশোনার পুরো স্ট্রিমটা চেঞ্জ করে পলিটিক্স, ফিলোসফি আর অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করার আগে ফিনান্সিয়াল জার্নালিস্ট হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ওয়ান্ডসওয়ার্থে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিনসেলার আসল নাম কিন্তু ম্যাডেলাইন সোফিয়া উইকহ্যাম। উইকহ্যামের যখন ২৪ বছর বয়স তখন তিনি তাঁর নিজের নামেই প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টেনিস পার্টি’ (The Tennis Party) লেখেন যা প্রকাশিত হয় যখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। তাঁর লেখা ওই সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু উপন্যাস হল— ‘আ ডিজায়রেবল রেসিডেন্স’, ‘সুইমিং পুল সানডে’, ‘দ্য,ওয়েডিং গার্ল’, ‘ককটেল ফর থ্রি’, ‘স্লিপিংল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ ইত্যাদি। এরপরেই পাঠকের দরবারে ২০০০ সালে ম্যাডেলাইন সোফিয়া উইকহ্যাম ‘সোফিয়া কিনসেলা’ ছদ্মনামে নিয়ে এলেন তাঁর বিখ্যাত শপাহলিক সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সিক্রেট ড্রিমওয়র্ল্ড অফ আ শপাহলিক’ (The Secret Dreamworld of a Shopaholic) যা পাঠক মহলে ভীষণভাবে সাড়া ফেলল ও বেস্টসেলারের তকমা পেল। সবথেকে মজার বিষয় হল উইকহ্যামের শপাহলিক উপন্যাসটি সোফিয়া কিনসেলা ছদ্মনামে তাঁর প্রকাশকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি প্রথমবারের মতো তাঁর আসল পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন ‘ক্যান ইউ কিপ আপ এ সিক্রেট?’ (Can You Keep a Secret?) প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাঁর শপাহলিক সিরিজের আটটি উপন্যাসের প্রথম দুটি উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ২০০৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল বিখ্যাত এক সিনেমা ‘কনফেশন অফ এ শপাহলিক’ (Confessions of a Shopaholic) ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও এবং মোশন পিকচার্স নিবেদিত এই চলচ্চিত্র দর্শক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। একবার একটি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে এই সিরিজের আইডিয়াটি তাঁর মাথায় এসেছিল তখন যখন তিনি একদিন কেনাকাটা করছিলেন। ব্যস ওই শুরু এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কিনসেলাকে। একের পর এক বেস্টসেলার দিয়ে গেছেন পাঠককুলকে। ষাটটিরও বেশি দেশে তাঁর উপন্যাসের ৪৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। এমনকী তাঁর রচিত উপন্যাস ৪০টির বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু বিধি বাম জীবন তাঁর জন্য অন্য কিছুই সাজিয়ে রেখেছিল। ২০২২ সালে এসে, সোফিয়ার গ্লিওব্লাস্টোমা ধরা পড়ে, যা একধরনের মস্তিষ্কের ক্যানসার। গ্লিওব্লাস্টোমা মস্তিষ্কের সাপোর্টিভ টিস্যুতে উদ্ভূত হয়, যা গ্লিয়াল কোষ নামে পরিচিত। এটি একধরনের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যাতে বয়স্করাই খুব বেশি আক্রান্ত হয় এবং ম্যালিগন্যান্ট বলে দ্রুত হারে এই ক্যানসার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আরও পড়ুন-২৩ ডিসেম্বর থেকে রাজ্য জুড়ে শুরু প্রক্রিয়া, পঞ্চায়েতেও অনলাইনে সম্পত্তি কর
ম্যালিগন্যান্ট বলেই এই রোগে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা বেশ কঠিন। গ্লিওব্লাস্টোমার সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, দুর্বলতা এবং স্নায়বিক ঘাটতি। এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে নানারকম, যেমন— সার্জারি, রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি। তা সত্ত্বেও, গ্লিওব্লাস্টোমা আবার ফিরে আসে এবং সম্পূর্ণ ভাবে সেরে ওঠার সুযোগ কমতে থাকে। এতে স্মৃতিশক্তি ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। কিনসেলার স্বামী উইকহ্যাম জানিয়েছেন যে এই মেমরি লস খুব দ্রুততার সঙ্গে হয় ফলে তিনি স্ত্রীকে বারবার সবকিছু মনে করাতে থাকেন। এই হ্রাস পেতে স্মৃতির মাঝে যে ফাঁক তা আর কোনওদিন ভরবে না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হল, এই ক্যানসারে বেঁচে থাকার রেশিও সর্বাধিক পাঁচবছর। এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধি থাকা সত্ত্বেও সোফিয়ার কলম কিন্তু থেমে থাকেনি। ছদ্মনামে লেখা তাঁর স্বতন্ত্র উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘মাই নট সো পারফেক্ট লাইফ’, ‘সারপ্রাইজ মি’, ‘দ্য পার্টি ক্রাশার’, ‘লাভ ইওর লাইফ’ ইত্যাদি। তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা তিনি বর্ণনা করেছেন তার সর্বশেষ বইতে, যার নাম ‘হোয়াট ডাজ ইট ফিল লাইক??’ এই ১৩৩ পৃষ্ঠার উপন্যাসের পরতে পরতে ব্রেন ক্যানসারের সঙ্গে সোফিয়ার যন্ত্রণাদায়ক লড়াইয়ের বর্ণনা পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সোফিয়া জানিয়েছেন যে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ‘ক্যানসার’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারেননি ভয়ে, শঙ্কায় ও শারীরিক যন্ত্রণায়।
আরও পড়ুন-শাশুড়িদের বউমারা
উপন্যাসটির মুখ্য চরিত্র ইভ মনরো যিনি একজন সফল ঔপন্যাসিক এবং পাঁচ সন্তানের মা যার ক্যানসার ধরা পড়েছে। মারণ-রোগের থাবায় আক্রান্ত মনরো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকে জানতে পারেন তিনি স্টেজ ফোর গ্লিওব্লাস্টোমায় আক্রান্ত এবং তাঁর বেঁচে থাকার গড় সময় মাত্র ১২ থেকে ১৮ মাস। এর কোনও নিরাময় নেই। এমনকী তিনি কীভাবে এই হাসপাতালে এসে পৌঁছলেন সেই ধারণাও ইভের ছিল না। তাঁর স্বামীর থেকে তিনি জানতে পারেন তাঁর আসলে কী হয়েছে— কীভাবে একটি বড় ম্যালিগন্যান্ট টিউমার তাঁর মস্তিষ্ক থেকে অপারেশন করে বের করা হয়— আসলে এই বইটিতে সোফিয়া তাঁর শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। আসলে ইভ মনরোর গল্প সোফিয়ার নিজের জীবনেরই ঘটনা— যেখানে হতাশা, দুঃখ, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার যাপন চিত্রের পাশাপাশি একটা আশির আলোর খোঁজও রয়েছে। কিনসেলা নিজে দুরারোগ্য ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন -অপারেশন হয়েছে তাঁর সম্ভাব্য যাবতীয় চিকিৎসা হয়েছে। টিউমারটি বাদ দেওয়ার পরে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি সব কষ্টই ভুগেছেন তিনি অর্থাৎ ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ে যে যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সবটাই তাঁকে হতে হয়েছে। না, সোফিয়ার জীবনকাহিনি, মারণ রোগের সঙ্গে তাঁর সংগ্রাম আর পাঁচটা সাধারণ ক্যানসার সারভাইভালের মতো নয়। কিনসেলার ঘটনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে কারণ তিনি এক অনন্য লড়াই চালিয়েছেন, জীবনযুদ্ধে হেরে যাননি বরং তাঁর জীবনের গল্পকে উপন্যাসের আকারে আমাদের কাছে তুলে ধরে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আগামী দিনেও জীবনের জয়গান গেয়ে তিনি আপামর পাঠককুলকে সমৃদ্ধ করবেন, এটাই আশা এবং প্রার্থনা হোক সবার।