শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে সংগ্রামের বীজ বপন করেছিলেন তাঁর বাবা, প্রমিলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা প্রমিলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তখন সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোঝার বয়স হয়নি কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে যাতায়াত করতে করতে মনে অল্প অল্প করে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
বাবা ও মায়ের সহজ-সরল জীবনযাত্রা ও সততার শিক্ষা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনকে প্রভাবিত করে। স্কুল জীবনে পড়ার সময় বাবার কাছে দেশের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীদের লড়াই ও আত্মত্যাগের কথা ও মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন তাঁর মনকে প্রভাবিত করেছিল। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যোগমায়া দেবী কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই আন্দোলনের জমি পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে মমতা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন। আবেগপ্রবণ না হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কার্যত জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে লড়াই করতে পারতেন না মমতা। জীবনের শুরু থেকেই যারা অঙ্ক কষে লাভ-লোকসানের হিসাব করে চলা শুরু করে তারা কোনওদিন মানুষের জন্য সংগ্রাম করবে না। দরিদ্র নিম্নবিত্ত মানুষের অসহায় জীবন তাদের মনে রেখাপাত করে না। মমতা এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের এবং তাঁর লড়াকু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ প্রথম ঘটে কলেজ জীবনে। কলেজে ভর্তি হয়ে মমতা লক্ষ করে ছাত্র সংসদ ডিএসও-র হাতে এবং ওদের ভয়ে অধ্যাপকরাও তটস্থ থাকত। কোনও ছাত্রীর সরাসরি অধ্যক্ষ বা সহ-অধ্যক্ষের ঘরে প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। ডিএসও-র দখলে থাকা ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে ডিএসও-র কোনও প্রতিনিধিকে নিয়ে যেতে হবে। মমতা বুঝতে পেরেছিলেন যে ইউনিয়নের শিকড় বেশ গভীরে, সেই জন্য সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ছাত্রীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেন। ওঁর তেজী মনোভাবকে ডিএসও সমীহ করতে শুরু করে। মমতা বুঝতে পারেন এটাই সুবর্ণ সুযোগ এবং ঝাঁপিয়ে পড়েন সংগঠিত ছাত্রীদের নিয়ে। সংগ্রামের এই পর্যায়ে মমতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দ্বারা প্রভাবিত হন। নেতাজি সুভাষ বলেছিলেন, ‘‘ক্রীতদাসত্ব জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ আর অন্যায়ের সঙ্গে আপস সবচেয়ে বড় অপরাধ।’’ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিম্নলিখিত কথাগুলি মমতার মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেটা হল— ‘‘সংসারে যারা শুধু দিলে কিছু পেলে না, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, যারা নিরুপায়, দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেল না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই কোন অধিকার নেই, এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে নালিশ জানাতে।’’
আরও পড়ুন-২৮ অগাস্ট আমাদের সেন্টিমেন্ট
ডিএসও কলেজে মৌরসিপাট্টা চালিয়েছিল, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ওদের সংযত হতে বাধ্য করেছিলেন মমতা। আমি আশুতোষ কলেজের ছাত্র ছিলাম। ডিএসও-র স্বৈরাচারী কার্যকলাপ দেখেছি কিন্তু ইউনিয়ন ভেঙে ছাত্র পরিষদের ইউনিয়ন করতে পারিনি যা অসীম সাহসী মমতা করে দেখিয়েছিলেন এবং যোগমায়া দেবী কলেজে গড়ে উঠেছিল ছাত্র পরিষদের প্রথম সংগঠন। মমতার জীবনে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগ্রামের চারাগাছটি ডালপালা মেলতে শুরু করে। কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কিন্তু প্রথম বছর মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর জন্য ক্লাস করতে পারেননি। কারণ ওরা জানত মমতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন করতে দিলে বিপদ হবে। রাজ্যে তখন ওদেরই সরকার আর সেই জন্য পুলিশ প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সহযোগিতায় মমতাকে ব্যারিকেড করে আটকায়। এক বছরও ভাল করে পড়াশোনা করতে পারেননি সেই জন্য পরের বছর পরীক্ষা দিয়ে ভালভাবে পাশ করেন। এরই মধ্যে মমতার রাজনীতির পরিধি অনেক বড় হয়েছে। জাতীয় ও রাজ্য-রাজনীতির বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা তখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মমতা এমএ, বিএড ও এলএলবি পাশ করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি, লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মমতা হয়ে উঠেছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’।