সুবর্ণরৈখিক

সাহিত্যিক নলিনী বেরা। গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি লিখেছেন নাগরিক জীবন নিয়ে। পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সহ বেশকিছু পুরস্কার। গেছেন দেশের বাইরে। এই মুহূর্তে ব্যস্ত পুজোর লেখা নিয়ে। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে?
আমার জন্ম বাংলা-ওড়িশার সীমান্তবর্তী বাছুরখোয়াড় গ্রামে। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার অন্তর্গত। গ্রামটি সুবর্ণরেখা নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী। আমাদের পরিবার ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত। গ্রামে সাহিত্যচর্চা তো দূর, লেখাপড়ার চলও খুব একটা ছিল না। আমার বাবা গিরিশচন্দ্র বেরা ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছেন। তবে ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা গ্রামের হরিমন্দিরে কথকতা করতেন। নাম সংকীর্তনের পরে পাঠ করে শোনাতেন রামায়ণ-মহাভারত শাস্ত্রাদি। তাঁর পাঠ মুগ্ধ করত গ্রামবাসীদের। বাড়িতেও ভোরবেলায় লম্ফ জ্বেলে পাঠ করতেন বাবা। পাঠ শুরুর আগে গুনগুন করে সুর ভাঁজতেন। শৈশবেই সেই সুর এবং পাঠের গভীর প্রভাব পড়েছিল আমার মনে। এখনও বাবার সেই সুর আমার কানে ভাসে। সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রাথমিক পরিচয় এই ভাবেই।

আরও পড়ুন-স্বাধীনতা-৭৫ আর জাতীয় পতাকা

লেখালেখির সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল?
ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমার হাতে আসে পি কে দে সরকারের গ্রামার বই। সেখানে ছিল অনুবাদের একটি অংশ। ইংরেজি থেকে বাংলা করতে হত। পাশাপাশি ছিল কিছু কিছু কথাংশ। সূত্র কী, জানতাম না। তবে পড়তাম। খুব ভাল লাগত। মাঝেমধ্যে অন্তর্ব্রহ্মাণ্ড আলোড়িত হয়ে উঠত। একটা সময় মনে হল, চেষ্টা করলে আমিও এইরকম লিখতে পারি। একদিন হাতে তুলে নিলাম কলম। প্রকাশ করতে শুরু করলাম নিজেকে। এভাবেই হয়েছিল আমার লেখালিখির সূত্রপাত।
প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে কোথায়?
ছাত্রজীবনে আমরা প্রতিমাসে একটি দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতাম। সেখানেই প্রকাশ পায় আমার প্রথম লেখা। আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলেও ছিল দেওয়াল পত্রিকা। লিখতাম সেখানেও। সেই দেওয়াল পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি পাঠ করেন আমাদের পাশের গ্রামের লাইব্রেরিয়ান অমর ষড়ঙ্গী। তিনি লেখালিখি করতেন। ‘দেশ’ পত্রিকার প্রকাশিত হত তাঁর কবিতা। তিনি আমার লেখাটা পড়ে বলেছিলেন, ‘‘তুমি একজন জাত কবি।” এই ‘জাত’ কথাটা শুনে আমার মনে ধাক্কা লেগেছিল। কারণ তখন আমাদের অঞ্চলে স্বমহিমায় ছিল জাতিভেদ প্রথা। আমিও হয়েছিলাম তার শিকার। মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল রাগ। যাই হোক, সেইসময় থেকেই অমর ষড়ঙ্গী আমাকে লেখালিখির ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকেন। সুযোগ করে দেন লাইব্রেরিতে নানারকমের বই পড়ার। পরে বুঝেছিলাম জাত কবি বলতে উনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-সীমান্তে শক্তি বাড়াতে অত্যাধুনিক রুশ বোমারু বিমান কিনছে ভারত

ছাপার অক্ষরে প্রথম লেখা?
ছাপার অক্ষরে আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। পরবর্তী সময়ে আমি ভর্তি হই মেদিনীপুর কলেজে। তবে বিশেষ কারণে একটি বছর আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। পরে নাম লেখাই ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঝাড়গ্রামে থাকার সময় কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি লিখতে শুরু করি। মূলত কবিতা। কলকাতায় আসার পর বৃহত্তর লেখক সমাজের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। আমার কবিতা ছাপা হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায়। তারপর বেরোয় আমার দুটো কবিতার বই ‘সে জানে শুশনি পাতা’ এবং ‘কত দূরে আছ সুবর্ণরেখা’।

আরও পড়ুন-সীমান্তে শক্তি বাড়াতে অত্যাধুনিক রুশ বোমারু বিমান কিনছে ভারত

গল্প, উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন কখন?
কবিতার পাশাপাশি টুকটাক গল্প লিখতাম। একটি গল্প পাঠিয়েছিলাম ‘কৃত্তিবাস’-এ। তারপর ‘বাবার স্মৃতি’ নামে গল্প পাঠাই ‘দেশ’ পত্রিকায়। গল্পটা ছাপা হয়। ১৯৭৯-র অগাস্ট মাস। তখন আমি থাকি হলদিয়ায়। তারপর গল্প লেখার পরিমাণ বেড়ে যায়। পরে শুরু করি উপন্যাস লেখা।
নাগরিক জীবন কতটা প্রভাবিত করেছে?
আগেই বলেছি, আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত গ্রামে। তবে গত চার দশক বসবাস করছি হাওড়া শহরে। আমার লেখায় গ্রামীণ জীবন যেমন বারবার ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন লেখায় ধরা পড়েছে নাগরিক জীবনের ছবিও। তাই স্বীকার করতেই হয়, নাগরিক জীবন আমাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। হাওড়া শহর নিয়ে লিখেছি পাঁচ খণ্ডের দীর্ঘ উপন্যাস। সাত আট বছর আগে বেরিয়েছে প্রথম খণ্ড ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’। দ্বিতীয় খণ্ড শীঘ্রই বেরোবে। হাওড়া শহরকে নিয়ে লিখেছি আরও একটি উপন্যাস ‘যৌথখামার’। কয়েক বছর আগে ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন ছিলাম। ওখানকার প্রেক্ষাপটেও আমি উপন্যাস লিখেছি। মনে রাখতে হবে, আমার লেখালিখির সিংহভাগ শহরে এসেই। তবে আমি গ্রাম জীবনকে এবং নিজের মাটিকে ভুলতে পারিনি। আমার লেখায় বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী আদিবাসী সম্প্রদায়ের কথা।

আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বাড়ি থেকে পরমাণু অস্ত্রের নথি উদ্ধার, দাবি সংবাদমাধ্যমের

পুরস্কার কি একজন লেখককে অনেক বেশি দায়িত্বশীল করে তোলে?
অবশ্যই। পুরস্কার পাওয়ার পর লেখকের দায়িত্ববোধ অনেক বেড়ে যায়। তবে জীবনযাপন এবং লেখালিখির মধ্যে পুরস্কার তেমন একটা প্রভাব ফেলে না।
সম্পাদনা করেছেন?
ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে পড়ার সময় সম্পাদনা করেছি ‘শালপাতা’ পত্রিকা। কলেজের ছেলেমেয়েরা সেই পত্রিকায় লিখতেন।
আপনার প্রিয় সাহিত্যিকদের কথা বলুন…
আগেকার দিনের বেশিরভাগ লেখক গ্রামজীবন নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। সেই সমস্ত লেখা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে আমার মনের মধ্যে। অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়ে আমার মন আলোড়িত হয়েছিল। অসম্ভব ভাল লেগেছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ পড়েও বিমোহিত হয়েছিলাম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ভাল লেগেছিল ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র তুলনায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ এক অসাধারণ লেখা। এঁরাই আমার প্রিয় লেখক।

আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় আসছে চিনা নজরদারি জাহাজ

‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ আপনার বিখ্যাত বই। এই লেখার জন্মকথা জানতে চাই…
সুবর্ণরেখা তীরবর্তী গ্রামের মানুষদের জীবনযাপন নিয়ে লেখা উপন্যাসটি। শৈশব থেকেই অঞ্চলটি আমার মনে রেখাপাত করেছে। মানুষগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। বলা যায়, তাঁদের সঙ্গেই বড় হয়েছি। উপন্যাসের অধ্যায়গুলো কিন্তু একসঙ্গে লিখিনি। দীর্ঘ সময়ের ফসল। বিভিন্ন সময় বেরিয়েছে টুকরো টুকরো ধারাবাহিক হিসেবে। অবশেষে দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। পেয়েছে আনন্দ পুরস্কার। দারুণ বিক্রি। অখণ্ড মেদিনীপুরে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। লেখায় যে ভাষা ব্যবহার করেছি, সেটাকে বলা হয় হাটুয়া ভাষা। শুদ্ধভাবে বলা হয় সুবর্ণরৈখিক ভাষা। আমার বইটা ওই ভাষার জাগরণ ঘটিয়েছে। বিপুল পরিমাণে চর্চা হচ্ছে, ভাষা এগিয়ে চলেছে। অথচ একটা সময় ভাষাটাকে অবজ্ঞা করা হত। দূরে সরিয়ে রাখা হত।

আরও পড়ুন-লেখকের উপর হামলার নিন্দায় বিশ্ব

নতুনদের লেখালিখি সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
সময়ের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে জীবন যাপন। পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। এইগুলো মানবিক জীবনে প্রভাব ফেলে। প্রভাব ফেলে লেখকের মনেও। যে জীবন চোখের সামনে ধরা পড়ে, সেটাই তো লেখায় উঠে আসে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের পরিবর্তন এই সময়ের লেখকদের লেখায় চমৎকার ভাবে ফুটে উঠছে। ঘটছে বাঁক বদল। যতটা সম্ভব পড়ার চেষ্টা করি। আমি যথেষ্ট আশাবাদী নতুনদের লেখালিখি নিয়ে। সম্পাদক-প্রকাশকরা তাঁদের লেখা ছাপছেন। বই বিক্রি হচ্ছে। এইসব দেখে আনন্দ হয়। একটা বিষয় পরিষ্কার, মানুষ কিন্তু বই পড়ে।
এই মুহূর্তে কী লিখছেন?
সামনে পুজো। শারদ সংখ্যার লেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি। অনেক লেখাই দেওয়া হয়ে গেছে। কিছু বাকি। বিভিন্ন পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হবে আমার উপন্যাস, গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখা। আশাকরি পাঠকদের ভাল লাগবে।

Latest article