রাজনৈতিক বিরোধীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে নির্বিঘ্নে এসএসসি অর্থাৎ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (SSC) পরীক্ষা সুসম্পন্ন হল। বিরোধীরা বিশেষ করে বামপন্থীরা তথা সিপিএম আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল যাতে এই পরীক্ষাটি না হয়। আইনের আশ্রয় নিয়ে এবং নানাবিধ কূটকৌশল-মিথ্যাচার করে এমন একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে পরীক্ষাটি গ্রহণ করা সম্ভব না হয়। তাহলে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে বেকাদায় ফেলা যায়। ২০১১-তে বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ধরে ভেসে উঠবার মরিয়া চেষ্টা করেছিল সিপিএম। কাজ হল না। তরাপর ২০১১-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আমাদের রাজ্যে সিপিএম শূন্যে পৌঁছল। জোটসঙ্গী কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। সারাদা, নারদা, আরজিকর যা সামনে পাওয়া গেল, ব্যর্থ মিছিল করে এবং টিভি চ্যানেলে গলা ফাটিয়ে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার জোর চেষ্টা হল। অবশেষে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আন্দোলনের পরিবর্তে কোর্টে ছোটাছুটি আরম্ভ হল। অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন, সিপিএম ‘উকিলের পার্টিতে’ পরিণত হয়েছে। তবে পরীক্ষা আটকানো গেল না। একটা বিষয়ে আশঙ্কার কথা লিখছি। কিছু সূত্রের খবর (সূত্রের উৎস প্রকাশ করা সম্ভব নয়) পরীক্ষা দুর্নীতি অভিযোগ সংক্রান্ত একাধিক মামলায় অনেক সরকারি ও কমিশনের গোপন তথ্য বিরোধী পক্ষের বিশেষ করে সিপিএমের হাতে চলে এসেছিল। ২০১১-এর পর এবং বিশেষ করে ২০১৬-এর পর বন্যার স্রোতের মতো ওয়েবকুপার এবং সরকারি কলেজের ক্ষেত্রে নিখিল বঙ্গ রাজ্য সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতিতে (যেটি আমাদের হাতে তৈরি) লোক ঢুকে গেল। ঝাড়াই-বাছাইয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। অনিবার্য ফল হিসাবে, যে-সমস্ত অধ্যাপিকা-অধ্যাপক বামফ্রন্ট আমলে চুটিয়ে সিপিএমের অধ্যাপক সংগঠন করতেন বা যাঁরা ছাত্রজীবনে চুটিয়ে এসএফআই করতেন, শুধু তাই নয়, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মীদের পিটিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছেন, আজ তাঁদের এক বড় অংশ আমাদের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ, এমনকী শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এই সমস্ত ব্যক্তিই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। সিপিএমের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ নেই, কেউ গ্যারান্টি দিতে পারেন? সিপিএম দলটিকে ৫৭ বছর ধরে দেখছি। এই সমস্ত সিপিএম ও এসএফআই থেকে আগত মহান নব্য শিক্ষক নেতা-নেত্রীদের কেউ কেউ যে সিপিএমের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছেন না, কেউ তাল ঠুকে বলতে পারবেন কি? তৃণমূল কংগ্রেসের পুরোনো একাধিক সক্রিয় কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করে এ-কথা মনে হয়েছে। যদি আমার মনে করাটা ভুল হয়, আমি নতমস্তকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে রাজি আছি। আমি রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করব, কলকাতা পুলিশের এবং রাজ্য পুলিশের দুটি দক্ষ সংগঠনের কাছ থেকে গোপন রিপোর্ট চাইতে। সংগঠন দুটি স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক শাখা) দফতরের অধীন। কথাগুলি বললাম, সিপিএম কীভাবে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্য সরকারকে বিপর্যস্ত করবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে।
আরও পড়ুন-দিল্লির স্বঘোষিত ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ! মুখ খুললেন ১৭ নির্যাতিতা
যাই হোক, ৭ সেপ্টেম্বর এবং ১৪ সেপ্টেম্বর (২০২৫) দু’দফায় পরীক্ষা হল। ৭ সেপ্টেম্বর নবম এবং দশম শ্রেণির জন্য, ১৪ সেপ্টেম্বর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হল। দু’দফা মিলে ৫ লক্ষ ৮৬ হাজার (আনুমানিক) প্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছেন। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রসঙ্গক্রমে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরিকাঠামো সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। কমিশনের সদর দফতর বিধাননগরের ‘আচার্য সদন’। একে বলা হয়, কেন্দ্রীয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। চেয়ারম্যান অধ্যাপক সিদ্ধার্থ মজুমদার। এই ধরনের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির মানুষ খুব কম দেখা যায়। আমি সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে কলেজ সার্ভিস কমিশনে কাজ করেছি। তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, আমি সদস্য ছিলাম। অত্যন্ত পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও সৎ মানুষ। শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসুকে ধন্যবাদ, এই ধরনের শিক্ষাবিদকে অত্যন্ত কঠিন সময়ে কমিশনের দায়িত্ব দেবার জন্য। কেন্দ্রীয় কমিশন ছাড়াও কাজের সুবিধার জন্য ৫টি রিজিওনাল কমিশন গঠিত হয়েছে। ১. পূর্ব রিজিয়ন চেয়ারম্যান ড. অরিন্দম চক্রবর্তী। ২. উত্তর রিজয়ন চেয়ারম্যান অধ্যাপক পিয়াল বসু রায়। ৩. দক্ষিণ রিজিয়ন— চেয়ারম্যান ড. মণিকান্ত পাড়িয়া। ৪. পশ্চিম রিজয়ন— চেয়ারম্যান ডক্টর সাধনা খাওয়া। ৫. দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন— চেয়ারম্যান ডক্টর সৌমি দাশ। এইভাবে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পুরো প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। সমস্ত রিজিয়নের চেয়ারম্যানরা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির শিক্ষাবিদ। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে ভেবেচিন্তে নিয়োগ করেছেন। ফলস্বরূপ এতবড় পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। দু’দিনের পরীক্ষায় কোনও গোলমাল হয়নি। দু-একটা অতি সামান্য, বলতে গেলে নগণ্য সমস্যা হয়ছিল। যেমন, একটি বিষয়ের প্যাকেটে যত সংখ্যক প্রশ্নপত্র ছিল, সেই বিষয়ের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তার তুলনায় বেশি। কিছুক্ষণ পর প্যাকেটটি ভালভাবে পরীক্ষা করে জানাল, সব ঠিক আছে। কম প্রশ্নপত্র নেই। অপর একটি কেন্দ্র থেকে একই ধরনের সমস্যার কথা জানানো হল। সেখানে সমস্যাটা ঠিক ছিল। কালবিলম্ব না করে কাছাকাছি একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অতিরিক্ত প্রশ্ন সশস্ত্র নিরাপত্তা নিয়ে পর্যবেক্ষক ঐ কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছিলেন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার অন্তত আধঘণ্টা আগে। রিজিওনাল কার্যালয় থেকে পুরো ব্যাপারটা সরাসরি তত্ত্বাবধান করা হয়েছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর ১২টা থেকে ১-৩০ পর্যন্ত সারা রাজ্যে কোথাও কোনও সমস্যা বা অসুবিধা হয়নি। পরীক্ষার্থীরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। অবশ্য যৎসামান্য কয়েকজন অসৎ উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে এবং পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা এবং সমস্ত শিক্ষক, অধ্যাপক ও শিক্ষাবন্ধু সফল করতে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিশনের ও রিজিওনাল কমিশনগুলির চেয়ারম্যানরা ছাড়াও সমস্ত স্তরের আধিকারিক ও কর্মচারীরা ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করেছেন। অবশ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনের অসহযোগিতার মনোভাব শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
একটি বাংলা দৈনিকে দেখলাম, মডেল উত্তরপত্রে কিছু ভুল আছে। এটা কোনও অস্বাভাবিক বিষয় নয়। MCQ-ভিত্তিক পরীক্ষার মডেল উত্তরপত্রে এই ধরনের ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। এমনকী Indian Civil Service পরীক্ষাতেও থেকেছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এ-কথা লিখছি। মনে রাখতে হবে, এই প্রথম এসএসসি পরীক্ষার ওয়েমার শিটের ডুপ্লিকেট কার্বন কপি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে এসএসসি-র সাইটে এই প্রথম মডেল উত্তর প্রকাশিত হয়েছে। ভুল থাকলে প্রতিকার রয়েছে। একইসঙ্গে সঠিক উত্তর যেটা মনে হয়, উল্লেখ করতে হবে। কমিশনের বিশেষ কমিটি যাচাই করে দেখবে। ভুল থাকলে সংশোধন করা হবে। এটা নিয়ে এত হইচই করার কী আছে!
উল্লেখ্য, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এবং বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগের অকুণ্ঠ সহযোগিতা, সর্বোপরি সমগ্র রাজ্য প্রশাসনের আন্তরিকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে সফল করে তুলেছে।