রবিবারের গল্প: জন্মদিন

একটা উপন্যাস পড়ছিল আলোলিকা। হুমায়ূন আহমেদের লেখা। দারুণ লেখা। কিন্তু খুব যন্ত্রণা করছে মাথা। বইটা পাশে রেখে শুয়ে পড়ল আলোলিকা। 

Must read

দেবদাস কুণ্ডু  
একটা উপন্যাস পড়ছিল আলোলিকা। হুমায়ূন আহমেদের লেখা। দারুণ লেখা। কিন্তু খুব যন্ত্রণা করছে মাথা। বইটা পাশে রেখে শুয়ে পড়ল আলোলিকা।
 মনে পড়ল মৈনাকের কথাগুলি।
—লকডাউন উঠে গেলে তুমি বাপের বাড়ি চলে যাবে। তোমার বাবাকে বলে দিয়েছি।
—কেন, কী অন্যায় করেছি আমি?
—তোমার জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছে না?
—আমি তো লজ্জার কোনও কাজ করিনি।
—এই নিয়ে তিনবার তুমি একই কাজ করে আসছ।
—আমার অপরাধটা কী সেটা তো বলবে?
—তুমি নিজে বুঝতে পারছ না?
—বুঝেছি, আমি ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি সেটা তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু এতে অন্যায়টা কোথায়? ওরা আমার স্কুল-বন্ধু, কেউ কলেজের বন্ধু, কিছু ফেসবুক-বন্ধু আছে। এ ছাড়া হোয়াটসআপে নতুন নতুন বন্ধু হয়। এগুলি নিয়ে তোমার আপত্তি। তাই তো?
—প্রতিবার এই নিয়ে অশান্তি হয়। তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও। কিছুদিন পর বলো, আর কোনও ছেলে বন্ধু তোমার থাকবে না। ফিরে এসে যথারীতি সেই এক গল্প।
—তুমি চাও আমি বাপের বাড়িতে পড়ে থাকি? আমার বাবার কষ্ট হোক? তাই তখনকার মতো আমি ওই কথা বলি।
—এই নিয়ে তিনবার হল।
—এখানে অন্যায়টা কোথায় সেটা তো বলবে?
—স্বামী থাকতে তোমার অন্য পুরুষবন্ধু থাকবে কেন?
—থাকলে অসুবিধাটা কী? তুমি তো সারাদিন বাড়ি থাকো না। সেই রাতে ঢোকো। বিছানায় শোয়া ছাড়া তো তোমার আর কোনও ভূমিকা নেই। আমি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে আনন্দ পাই। ক’টা মানুষের এত বন্ধু আছে বলতে পারো? এই তোমার কথাই ভাবো না, একটাও সেই অর্থে তোমার বন্ধু নেই। আমার বাবা কী বলেন জানো তো? টাকা দিয়ে তুমি সব পাবে। বন্ধু পাবে না। ভাগ্যবানরা বন্ধু পায়।
—আমি তা মনে করি না।
—তুমি না বিএ পাশ করেছ?
—কেন সন্দেহ হচ্ছে নাকি তোমার? সার্টিফিকেট এনে দেখাব?
—তাহলে এই সময় দাঁড়িয়ে তুমি সেকেলে কথা বলো কেন?
—তুমি বিয়ের আগে একবছর একটা স্কুলে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করেছ বলে আমায় তোমার ছাত্র ভাবছ নাকি?
—তোমার মতো কনজারভেটিভ মাইন্ডের ছাত্রদের আমি পড়ব না। এখন বুঝতে পারছি বাবার কথার কতখানি গুরুত্ব আছে। বাবা বলেছিল, আজ পার্ট টাইম টিচার আছিস, বিএডটা করে রাখ, একদিন পারমানেন্ট টিচার হতে পারিস। চাকরিটা ছাড়িস না। মেয়েদের অর্থনৈতিক জোর থাকার দরকার আছে। তোমার কথা শুনে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বড় ভুল করেছি। এখন বুঝতে পারছি।
—আমি তোমার এত কথা শুনতে চাই না। ফ্যাক্টরি যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। লকডাউন উঠে গেলে তুমি সোজা বাপের বাড়ি চলে যাও।
      বাথরুম থেকে বের হল মৈনাক। এখন এক ঘণ্টা পুজো করবে। এখন ফোন ভাইব্রেন্ট মুডে থাকবে।
       এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে মিসকলগুলির উত্তর দেবে। তারপর ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাবে।
এখন মৈনাক সকালের খাবার খাচ্ছে। আলোলিকা টেবিলের কাছে এসে কপালের চুল সরিয়ে বলল— ‘আমি যে সারাদিন একা থাকি। কীভাবে আমার সময় কাটে, তা তুমি ভাববে না?’
—আমি কি সব কাজ ফেলে তোমার কাছে বসে তোমার মুখ দেখব?
—এক সময় তো আমার মুখ দেখতে ছটফট করতে।
—বিয়ের আগে এমন করে সব পুরুষ।
—সব পুরুষকে কেন ডেকে আনছ? তোমার কথা বলো।
—আমার অত সময় নেই তোমার সঙ্গে গল্প করার।
—বিয়ের পরে পরে সারারাত কথা বলতে।
—হ্যাঁ বলতাম। এখন সময় নেই। কারখানা আছে। ব্যবসা আছে।
—তখন কারখানা ছিল না?
—তোমার অত কথার জবাব আমি দিতে পারব না।
—তুমি যখন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পাও না, তাহলে আমি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে তোমার এত রাগ কেন?
—এটাকে আমি ব্যভিচার মনে করি।
—বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে ব্যভিচার হয় বলে আমি মনে করি না।
।।  দুই।।
—সোমবার লকডাউন উঠে যাচ্ছে, আপনি এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন। মৈনাক বলল তার শ্বশুরকে।
—কিন্তু আমার একটা কথা ছিল। সমর পাল বললেন। মৈনাকের শ্বশুরমশাই।
—কী কথা বলুন?
—ছেলে, মানে আমার দাদুভাইয়ের কী হবে?
—মায়ের কাছে থাকবে। আমি খরচ দেব।
—সে ভাল কথা। তারপর?
—কোর্টে ডিভোর্স চাইব।
—কোন গ্রাউন্ডে?
—ব্যভিচার।
—শব্দটার মানে জানো তুমি? কোনওদিন তুমি ডিভোর্স পাবে না।
—দেখা যাক।
—আমি একটা পরামর্শ দিতে পারি তোমায়।
—কী পরামর্শ শুনি?
—মেয়ে আমার, সে তো আমার কাছে থাকবে। তুমি ফেলতে পার, আমি তা পারব না। আমি বাবা। কিন্তু নানা লোক নানা প্রশ্ন তুলবে। সেটা হবে আমার কাছে যন্ত্রণার। তাই তুমি আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ যদি রাখ, তাহলে—
—বলে ফেলুন।
—তুমি, আমি, এমনকী আলোলিকা পর্যন্ত মুক্তি পাবে। দাদুভাইয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সে আমি দায়িত্ব নেব।
—বলুন আপনার অনুরোধ?
—তুমি তো ওকে তিন বছর ভালবেসে বিয়ে করেছিলে। তোমাকে ভালবেসে আজকের দিনেও আমার মেয়ে শিক্ষকতার চাকরিটা ছেড়ে ছিল। তাই তুমি যদি ওকে ভালবেসে বিয়ে করতে পার, তাহলে একটা ছোট্ট কাজ তুমি করতে পারবে না?
—কাজটা কী সেটা তো বলবেন?
—তুমি ওকে ভালবেসে হত্যা করো।
মৈনাক সহসা একটা ধাক্কা খেল। জীবনে এই রকম কথা শুনতে হতে পারে এটা সে ভাবেনি। ভালবেসে সব কিছু করা যায়। ভালবেসে সময় কাটানো যায়, বিয়ে করা যায়, একটা সম্পর্ক তৈরি করা যায়। ভালবেসে চুমু খাওয়া যায়, সন্তান উৎপাদন করা যায়। ভালবেসে  কাউকে হত্যা করা যায়? হত্যা করতে গেলে নিষ্ঠুরতা দরকার হয়। যা ভালবাসার বিপরীত মেরু। তাহলে তার শ্বশুর কী করে এই কথাটা বলল?
—হ্যালো কিছু বল? চুপ করে গেলে কেন? শ্বশুরমশাই জিজ্ঞেস করলেন।
মৈনাক তার কারখানার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। জবাব কী দেবে ভেবে পাচ্ছে না। লেবাররা কাজ করছে। তাদের ঠাট্টা-ইয়ার্কির শব্দ কানে ভেসে আসছে। কিন্তু স্বামী থাকতে আলোলিকা পরপুরুষের সঙ্গে গল্প করে যাবে, সেটাও সহ্য করা যায় না। তখন নিজের কোনও পৌরুষত্ব আছে বলে মনে হয় না।
—কী হল মৈনাক? আমার কথার জবাব দিলে না তো? শ্বশুরমশাই আবার জিজ্ঞেস করলেন।
মেশিন অপারেটর রতন মৈনাকের কাছে এসে দাঁড়াল। মৈনাক ফোনটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল— কিছু বলবি তুই?
—আজ আমি পাঁচটায় বেরিয়ে যাব।
—কেন? কী দরকার। আজেন্ট অর্ডার রয়েছে। মাল তুলে দিয়ে তবে তো যাবি।
—কাল সেটা করব। আজ পারব না। পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।
—কেন? কী এমন এমারজেন্সি দরকার পড়ল?
—আজ শিউলির জন্মদিন।
—কে শিউলি?
—আমার বউ। বাড়িতে ওর জন্মদিনটা সেলিব্রেট করব।
মৈনাক থম দিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। আমার একজন লেবার, সে তার বউয়ের জন্মদিন সেলিব্রেট করবে! আর আমি আমার বউয়ের জন্মদিনটা কবে জানি না!
আবার ফোনটা বেজে উঠল। শ্বশুরমশাই বললেন— কী ঠিক করলে মৈনাক?
—আপনার মেয়ের জন্মদিনটা কবে বলুন তো?
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article