ভাতের হোটেল

টিং করে মেসেজটা ঢুকল। রিয়া আড়চোখে একবার মোবাইলে চোখ রেখেই পাশ ফিরে শুল। একনজরে যা বুঝেছে এটা সেই আঠারোর মেসেজ।

Must read

সোমা কুশারী: টিং করে মেসেজটা ঢুকল। রিয়া আড়চোখে একবার মোবাইলে চোখ রেখেই পাশ ফিরে শুল। একনজরে যা বুঝেছে এটা সেই আঠারোর মেসেজ। এখন একদম চেপে যেতে হবে কথাটা! একদম চুপ! মা ক’দিন ধরে খোঁচাচ্ছিল বাসন্তী, তিথি, অপর্ণা ওদের নাকি সব কবেই ঢুকে গেছে। তারটা কেন ঢুকছে না? মা তো ইস্কুলেও ফোন করেছিল, বড়দিকে কী সব বলেছে যেন! তাই শুনে বড়দিও ছেড়ে কথা বলেনি, রামঝাড় দিয়েছে! রাগে একটু আগেও গরগর করছিল মা, ভিক্ষে করছি নাকি? হকের টাকা। সবাই পেল, আর আমার মেয়েটাই পাবে না? মামদোবাজি নাকি?

আরও পড়ুন-প্রস্তুতি তুঙ্গে, শহরে অভিষেক

ভাইটা মাস ছয়েক হল বটতলার মিত্তিরদের মশারি কারখানায় কাজ নিয়েছে। এবার তো আর করোনা করোনা করে ইস্কুল-ফিস্কুল নেই, তাই বাবাই ওকে ঢুকিয়ে দিল। বাবার গাছ ঝুড়োনোর কাজ-টাজও আজকাল ভাল আয় দিচ্ছে না, টের পায় রিয়া। হাই রোডটা চওড়া হতেই এত ঘরবাড়ি উঠছে এ-গ্রামে যে নারকেল-সুপুরির বাগান সব সাফ হয়ে যাচ্ছে। গাছ কোথায় যে গাছ ঝুড়বে!
হাই রোডের মুড়োটা সোজা এ-গ্রামের ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। চার লেনের জন্য মাটিকাটা শুরু হতেই প্রথম লপ্তে মায়ের মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া পুঁচকে দোকানটা ভাঙা পড়ল। তার আগে অবধি দু’বেলা চা আর বেকারির বিস্কুট বেচে খারাপ আয় হত না। তখন অবশ্য রিয়ার কাজের শেষ ছিল না, সক্কাল সক্কাল বাসন মেজে ঘর মুছে রাঁধতে হত। তাতেই তো নাইনে দু-বচ্ছর ঝুলে ছিল। টেনে উঠতেই কী যে হল মা সন্ধেবেলা দোকানে নিয়ে যেতে শুরু করল, বাবা অবশ্য জোর আপত্তি তুলেছিল, সমর্থ মেয়ে, দুকানে নে-যাচ্ছো যে বড়!
—চুপ যাও! ব্যবসার বোঝোটা কী? মেয়েটা গেলে ভিড় বাড়বে!
—লজ্জা করছে নে? অ্যাঁ? মা তুমি?
—ওই গাছঝুড়ে পেটভরে না! চার-চারটে পেট! মনে রেখ।

আরও পড়ুন-‘শহীদদের স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধা’ ২১শে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ মুখ্যমন্ত্রীর

বিকেলে আগে এক জায়গায় টিউশন পড়ত রিয়া। সেসব চুলোয় গেল। বিকেল হলেই সেজেগুজে সোজা দোকানে, চা মা-ই করত, রিয়া নড়বড়ে দুটো টেবিলে চা আর বিস্কুট পৌঁছাত। মা টোস্ট-অমলেট শুরু করতেই ভিড় বাড়ল। হাই রোডের অনেক গাড়িওলা, ভ্যানো-টোটোর চা তেষ্টা বাড়ল, পাড়ার বেশ কিছু ছেলে-ছোকরাও জুটে গেল। মা-র ‘ফালতু চা’-এর পাশেই বহুদিন ধরে নবীনকাকার চায়ের দোকান, মায়ের দোকানে ভিড় বাড়তেই শুরু করল নোংরা কথা বলা। মা-মেয়ের ঢলানিগিরির জন্যেই নাকি এত খদ্দের! বোঝো কাণ্ড! রিয়ার প্রথম প্রথম খুব রাগ হত তারপর সেই বিশেষ ঘটনাটা ঘটল। নবীনকাকার ছেলে লালটুদা বেশ দেখতে, লম্বা দোহারা চেহারা একেবারে যেন সিনেমার ‘অক্ষয়’! ভাই বলে লালটুদা নাকি নৈহাটিতে রোজ জিম করতে যায়। তা, দুগ্গাপুজোর সময় লালটুদা রিয়াকে গোপন কথাটা বলেই ফেলল…
—মাইরি বলছি! বিশ্বাস কর।
রিয়া আঙুলে ওড়না জড়াতে জড়াতে বলল…
—তোমাকে কত কে চায়… ডলিদি, পূর্ণা, নবরূপা…।
—আমার মনটা দেখবি না?
—তোমার বাবা তো আমাকে ছেনাল বলে…।
—রাখ বাবা! আমি শুধু তোকে চাই!
রিয়া দোকানে যতক্ষণ থাকে লালটুও বাপের দোকান ছেড়ে নড়ে না। চা দেয়, চেয়ার মোছে, ডিম ফেটায়। নবীনকাকার দোকানেও আয় মন্দ নয়! অবশ্য নবীনকাকি নাকি মাকে শুনিয়ে বলেছে, আমার রাজপুত্তুরের পাশে ওই হাড়হাভাতে চা-উলির মেয়ে? রামোঃ!
হঠাৎ-ই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল! রাস্তাটা অজগরের মতো এগোতে এগোতে সব গিলে নিল। নবীনকাকার দোকান খেল, মায়ের ‘ফালতু চা’ মাটিতে মিশে গেল…।

আরও পড়ুন-উচ্চবর্ণের মত পোশাক পরায় মোদীরাজ্যে দলিত যুবককে বেধড়ক মারধর

মোটে মাসখানেক হল আবার মাটির স্তূপ সরানো শুরু হয়েছে। রোলার দিয়ে মাটি সমান করছে লোকজন, মায়ের তাই ইচ্ছে রিয়ার টাকাটা ঢুকলেই আবার দোকান দেবে। রিয়া অবশ্য রাজি নয়। লালটু তাকে বলেছে টাকাটা পেলেই ওরা পালাবে। তারপর, নিজেরাই একটা ভাতের হোটেল খুলবে। এই হাই রোডের ধারেই একটা জায়গাও দেখা আছে, নগদ দশহাজার বায়নাও নাকি দিয়ে ফেলেছে লালটু। ওই টাকাটা হাতে এলেই আগে দু’জনে শ্যামনগর কালীবাড়ি গিয়ে বিয়ে করবে, তারপর দু’-তিনটে কড়া-হাঁড়ি পাতিল থালা-গেলাস কিনেই শুরু করে দেবে দোকান। রিয়া রাঁধবে, মাটনকষা, আলুরদম, ডাল, চাটনি গামলা গামলা ভাত… আর খদ্দের সামলাবে লালটু! রাতে দু’জনে পাশাপাশি বসে পয়সা গুনবে… অনেক পয়সা!
রিয়ার পাশবইটা মা ওই কোণের দিকের আলনা কাম ড্রেসিংটেবিলটার ড্রয়ারে ভরে তালা মেরে রেখেছে, পাছে হারিয়ে যায়! মেসেজ পেলেই মেয়েকে নিয়ে ব্যাঙ্কে ছুটবে— এই মতলব। বিছানায় শুয়ে এসব সাত সতেরোই ভাবছিল রিয়া। পঁচিশ হাজার টাকা! কম নাকি? ওই পাড়ার সুমনার তো ওটাকার জোরেই বিয়ে হয়ে গেল, বিয়ের যৌতুকে একটা ভ্যান কিনে দিয়েছিল ওর বাবা বরকে। সুমনা বেশ ভালই আছে, এই তো ক’দিন হল ছেলেও হয়েছে। আর যত পোড়াকপাল রিয়ার! বিয়ে দেওয়ার কথা তো এরা মুখেও আনে না, উল্টে টাকা ক’টা লুটে নিতে চায়!
মা মাটিতে চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছে, নাক ডাকার ঘোঁত ঘোঁত শব্দ হচ্ছে। বাবা আর ভাই এখনও ফেরেনি। ফিরলে মা ওদের খেতে দেবে। রিয়া উঠে বসে মোবাইল থেকে একটা মিস কল দিল, লালটু এখুনি ফোন করবে। মায়ের বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের ওদিক দিয়ে ঘুরে কুয়োতলায় গাছগাছালি ঘেরা ঝুপসি জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ায় রিয়া।
চাবির থোকাটা হাতে নিয়ে লালটু দাঁত বের করে হাসে, মুখ গোমড়া কেন মেরি জান? এ চাবি আমি ডুপ্লিকেট একটা বানিয়ে বিকেলেই তোকে এনে দেব। আর তারপর পাসবইটা সরাতে পারলেই…
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই রিয়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে চকাত করে একটা চুমু খেয়ে ফেলে লালটু। রিয়া নাক কুঁচকোয়, ছিঃ! কী পচা গন্ধ! বাবা মাঝেমাঝে তাড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকলে এমন দুর্গন্ধ ওঠে। লালটু মাল টানে— ভাই একদিন বলছিল বটে… তবে এই ভরা বিকেলেও কি গিলেছে? পায়ে পায়ে ঘরে ফেরে রিয়া টের পায় মা গজগজ করছে, এখনও ফিরল না! বেলা পাঁচটা বাজতে চলল লোকটার আক্কেল বলতে কি কিছু আছে? যা সুবোধ একটু সাইকেল নিয়ে যা দেখে আয় গে বাবার কী হল!

আরও পড়ুন-চিকিৎসার অজুহাতে তরুণীর মাথায় ১৮টি সুচ গাঁথলেন তান্ত্রিক

ক’দিন যেন ঝড় বয়ে গেল বাড়িতে, গাছ থেকে পড়ে বাবার তো এই যায় সেই যায় অবস্থা। ভাটপাড়ার হসপিটাল থেকে সোজা পাঠিয়ে দিল কলকাতায়। মা আর ভাইয়ের সাথে বাবাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রিয়াও যেতে চেয়েছিল, মা-ই রাজি হয়নি। বলল, ঘরদোর কে দেখবে? তুই থাক। আমি লতার মাকে বলে যাব রাতে নজর রাখবে।
সারাটা রাত জেগে বসেছিল রিয়া। মদখোর বিড়িখেগো বাবাটার জন্য কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল। সেই যে প্রতিবার পুজোয় ঠিক মেয়ের জন্যে জামা কিনে আনত লোকটা আর মার এক কাঁড়ি মুখঝামটা শুনত, বড্ড মনে পড়ছিল সে সব কথা…
— পেটে ভাত নেই ধম্মের উপোস! মেয়ের জামা আনতে গেলে কোন মুখে? ও ক’টা টাকা থাকলে যে পুজোগন্ডার দিন দুটো মাছভাত জুটত, সে খেয়াল আছে?
বাবা মিনমিন করে বলত, মেয়ে মানেই পরঘরো, আজ আছে কাল কার বাড়ি যাবে… কী পাবে না পাবে! পরুক না একটা নতুন জামা!
—হ্যাঁ গো! তোমার কি একটাই সন্তান? ছেলেটাকে দেখতে পাও না না চোখে? ওর একটা জামার কথা তো মনে পড়ে না!
—ও তুমি ঠিক কিনবে। দোকান করে পয়সা তো কম জমাওনি।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই ধড়মড় করে উঠে বসে রিয়া, কে ফোন করল? মা নয় তো? অবশ্য মার কাছে ফোন নেই। মেয়ে একা আছে বলে ফোনটা মেয়ের কাছেই রেখে গেছে মা। না! এ তো লালটুর নম্বর। এত রাতে? বাবার খবর পেয়েছে নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে রিয়া, ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে লালটুর জড়ানো গলা ভেসে আসে, জানেমন! যাব নাকি একবার? দরজা খুলে রাখো সোনা! আজ রাতে চুপিচুপি ফুলশয্যাটা হয়ে যাক্ মাইরি!
ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে রিয়ার, এত নোংরা ছেলেটা! একবার বাবা কেমন আছে জানতে চাইল না বরং সুযোগ নিতে চাইছে! সেদিন পূর্ণা রাস্তা আটকে একথাই বলতে চেয়েছিল তবে, রিয়া ভুল করিস না ভাই! লালটু হেব্বি শয়তান! ও তোকে মোটেই বিয়ে করবে না, ওর নজর শুধু নিত্যনতুন মেয়ের দিকে। আর ওর বাবা? বিনা পণে কখনও ছেলের বিয়ে দেবে না!

আরও পড়ুন-দিঘায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস, ঘটছে আবহাওয়ার বদল

আবার রিং হচ্ছে, রিয়া সঙ্গে সঙ্গে কেটে দেয়। আবার ও ফোনটা বেজে ওঠে, রিয়া ধরতেই…
—কী হল ফোন কাটছিস যে বড়? এদিকে শালা আমি বলে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি! বিকেলে তোকে চুমু খাবার পর থেকেই মাইরি মাথার ঠিক নেই! আসি না সোনা তোর বাড়ি…
রাগে দুঃখে ফোনটা সুইচড্ অফ করে দেয় রিয়া। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। এই তবে ছেলেটার স্বরূপ। একেই বিশ্বাস করে বাড়ির চাবি পর্যন্ত তুলে দিয়েছিল… মাকে লুকিয়ে পাসবই বার করে টাকাটা তুলে নিয়ে পালাত… ছিঃ! নিজেকেই ধরে চড়াতে ইচ্ছে করে রিয়ার!
স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে চা করে দিচ্ছিল রিয়া, বাবা এখন অনেকটা ভাল, হিপ জয়েন্টের অপারেশনটা ভালয় ভালয় হয়ে গেলেই আবার হাঁটতে পারবে আগের মতন, তবে বাবাকে আর গাছ ঝুড়তে দেবে না রিয়া। মা আর মেয়েতে মিলে ইচ্ছে একটা ভাতের হোটেল দেবে হাই রোডের ধারে… লালটু আর যাই করুক প্ল্যানটা মন্দ ভাঁজেনি কিন্তু! ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে যায় রিয়ার…
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article