করোনা অতিমারির ঘা এখনও দগদগে, ইতিমধ্যেই কি পৃথিবী আরও একবার সম্মুখীন হতে চলেছে অপ্রত্যাশিত এক মহামারীর? বিজ্ঞানীদের অনুমান কিন্তু সেরকমই। তবে এবার আর কোনও নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নয়, মহামারী সৃষ্টি করতে পারে ‘সুপারবাগ’| কী এই সুপারবাগ? সুপারবাগ হল এমন এক ধরনের জীবাণু, প্রধানত ব্যাকটেরিয়া, যা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। এই সুপারবাগগুলি হল আমাদের চেনা পরিচিত সাধারণ ব্যাক্টেরিয়াগুলি, যাদের ব্যাপারে সেই ছোট থেকেই পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসছি, তবে পার্থক্য এটাই যে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িস্টেন্স অর্জন করার জন্য এরা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য, অনিয়ন্ত্রিত। বাজার চলতি বেশিরভাগ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগই এদের আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এদের দমন করতে হয়তো আমাদের বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার নাভিশ্বাস উঠে যেতে পারে। সম্প্রতি ‘ল্যানসেট’ নামের গবেষণামূলক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে একটি তথ্য, যা বলছে ২০২৫-২০৫০ এর মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে শুধুমাত্র সুপারবাগ-এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্টেন্স, এবং ২০৫০-এর মধ্যে এই AMR-এর কারণে প্রতি বছর জীবন হারাবে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ। চাঞ্চল্যকর তথ্য তো বটেই! কিন্তু প্রশ্ন হল, কী এই সুপারবাগ? কোথা থেকে এর উৎপত্তি?
আরও পড়ুন-হিন্দুত্ব নয়, সাংবিধানিক মূল্যবোধ এখন ‘খতরে মে’
সুপারবাগ-এর উৎপত্তি কোথা থেকে
অনুমান করা হয় এই সুপারবাগ বা মাল্টিড্রাগ রেজ়িস্টেন্স ব্যাক্টেরিয়াগুলি প্রায় ৪৫ কোটি বছর আগে থেকে এই পৃথিবীর বুকে বসবাস করছে। এদের উৎপত্তির প্রধান কারণ ব্যাকটেরিয়াল জেনেটিক মিউটেশন। জিনগত পরিবর্তনের কারণে যে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে মারা যাচ্ছিল, সে এখন তার কোষের ভেতর এমন কিছু পরিবর্তন করে ফেলছে যাতে অ্যান্টিবায়োটিক তার কোষের ভেতর প্রবেশ করতেই পারছে না, বা প্রবেশ করলেও পাম্পিং প্রক্রিয়া দ্বারা তাকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, কিংবা অ্যান্টিবায়োটিকটিকে কিছু এনজাইম দিয়ে ব্যাক্টেরিয়া নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। এছাড়াও কিছু ব্যাক্টেরিয়ার কোষের মধ্যে থাকে রেজ়িস্টেন্স প্লাসমিড, যা ব্যাক্টেরিয়াকে করে তোলে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িস্টেন্স বা প্রতিরোধী। এই ব্যাক্টেরিয়াগুলি যখন বংশবিস্তার করে, তাদের থেকে সৃষ্ট প্রতিটি ব্যাক্টেরিয়া হয়ে যায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িস্টেন্স। এইভাবে রেজ়িস্টেন্স বিস্তার করাকে বলে ‘ভার্টিকাল ট্রান্সফার’। আবার নিজেদের জিনগত পুনর্বিন্যাস বা পুনর্গঠন বা রিকম্বিনেশনের জন্য ব্যাক্টেরিয়া নিজেদের জেনেটিক উপাদান সমগোত্রীয় বা ভিন্নগোত্রীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আদান-প্রদান করে থাকে, এর নাম হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। ব্যাক্টেরিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার হল নতুন নতুন সুপারবাগ সৃষ্টির প্রধান কারণ।
কীভাবে ক্রমশ বেড়ে চলেছে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্টেন্সের গতি
এর জন্য কিন্তু মূলত দায়ী আমরা। ছোটখাটো জ্বর, সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অবারিত প্রয়োগ ক্রমশই বাড়িয়ে তুলেছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্টেন্সের গতি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই জ্বর-সর্দির মূলে থাকে ভাইরাস, যাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক বিশেষ কার্যকর হয় না, কারণ অ্যান্টিবায়োটিক মূলত ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভাইরাসের জন্য আছে অ্যান্টিভাইরাল, ফাংগাসের জন্য আছে অ্যান্টি ফাংগাল ড্রাগ। এরপর আছে আমাদের ‘নিজেদের ডাক্তারি’, যা মারাত্মকভাবে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্টেন্স বিস্তার এর জন্য দায়ী। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই, নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে নিচ্ছি, বুঝতেও পারছি না, কোন রোগের জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিক কতটা পরিমাণে খেতে হবে! নির্দিষ্ট ডোজের কম ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক কিছু সেনসিটিভ ব্যাকটেরিয়া মেরে দিলেও সুপারবাগ-এর টিকিও ছুঁতে পারে না, ফলে বেড়ে চলে এই ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার উত্তরোত্তর বংশবৃদ্ধি। এছাড়াও অযাচিতভাবে বিভিন্ন পোল্ট্রি ফার্মে, মাছ চাষে, গবাদি পশুদের ওপর নির্বিচারে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক, যা প্রতি মুহূর্তে আরও উসকে দিচ্ছে নতুন নতুন সুপারবাগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাকে।
আরও পড়ুন-উন্নয়নের নামে শুধুই প্রহসন মধ্যপ্রদেশে বিজেপির গ্রাম পঞ্চায়েতে
আছে কি কোনও আশার আলো
আশার আলো থাকলেও সে বেশ কিছুটা ম্লান। বিজ্ঞানীরা তো প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর কাজ করে চলেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অনেকটাই অভাব রয়েছে, কারণ তাদের কাছে গোটা ব্যাপারটাই স্বচ্ছ নয়। ‘পেট খারাপ হয়েছে বলে তিনটে নরফ্লক্স খেয়ে নিলাম আর সুস্থ হয়ে গেলাম’—এ ধরনের কথা তো আকছার শুনছি আমরা, কিন্তু ব্যাপারটা যে সুস্থতার চেয়ে অসুস্থতার দিকে গড়িয়ে চলেছে সেই ধারণা সাধারণ মানুষের নেই। সাময়িক পেট খারাপ থেকে মুক্তি পেলেও ‘অসম্পূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স’ যে তার শরীরে থাকা একটি বা দুটি রেজ়িস্টেন্ট জীবাণুদের বংশবৃদ্ধির একটা পরিচ্ছন্ন রাস্তা খুঁজে বের করে দিল সেটা অনেকেই বুঝতে অপারগ। ওই তিনটে নরফ্লক্স তো সেই মুহূর্তে সকল নরফ্লক্স-সেনসিটিভ ব্যাক্টেরিয়াগুলিকে ধংস করে ফেলল, কিন্তু শরীরের মধ্যে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক-রেজ়িস্টেন্ট ব্যাক্টেরিয়াগুলি এবার মহানন্দে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকল। কেন? কারণ তাদের প্রতিযোগী নরফ্লক্স-সেনসিটিভ সমস্ত ব্যাক্টেরিয়াগুলি আপাতত মৃত, আর আপনার শরীর হোস্ট বা আশ্রয়দাতা হিসেবে লালনপালন করতে লাগল ওই রেজ়িস্টেন্ট ব্যাক্টেরিয়াগুলিকে। আর আপনার শরীর অজান্তেই সুপারবাগ-এর ভাণ্ডার উঠল। সেই জন্য, ‘নিজের ডাক্তারি’ বন্ধ করে শুধুমাত্র চিকিৎসক-এর পরামর্শমতোই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত, কারণ একমাত্র তিনি রোগ নির্ণয় করে সঠিক মাত্রার ওষুধ আপনাকে বলতে পারবেন। সুতরাং সাধারণ মানুষের অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাটা সর্বোপরি প্রয়োজন।
ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে, যেমন পোল্ট্রি ফার্ম থেকে শুরু করে ফ্রোজেন ফুড পর্যন্ত, খাবারকে সতেজ রাখার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহার অতি সত্বর বন্ধ করা উচিত। এই ব্যাপারে প্রশাসনকে অনেকটাই কড়া হওয়ার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজনে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
চিন্তার বিষয় হল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজ়িস্টেন্স এখন আর শুধুমাত্র ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, রেজ়িস্টেন্স ছড়িয়ে গেছে ভাইরাস ও ছত্রাকদের মধ্যেও। সামনের দিনগুলি সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলির কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে। প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুগত পরিবর্তন, মেরুপ্রদেশে দ্রুত বরফগলন ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে এবং পৃথিবীর সকল জীবানুকুল নিজেদের প্রতিদিন আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছে।
পরিশেষে একটি কথাই বলা যায়, সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ক্রমাগত গবেষণা ও আবিষ্কার, অভিনব থেরাপিউটিকস, উন্নত বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জন্য সকল স্তরে কার্যকরী সহযোগিতা, তাহলেই হয়তো অজ্ঞাতসারে আরও এক মহামারীকে পৃথিবীকে দেখতে হয় না।