দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালগণ নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে রাজ্য সরকারকে বিভিন্নভাবপে বিব্রত করার পথ বেছে নিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিল, যা রাজ্যপালের সম্মতি দরকার, যা না হলে আইন হবে না, সর্বোপরি রাজ্যের মানুষ আইনি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হবে, সেই সব বিলকে সম্মতি না জানিয়ে নিজের টেবিলে ফেলে রাখছেন। পশ্চিমবাংলা এ ব্যাপারে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। সে কথা পরে আসছি। সম্প্রতি তামিলনাড়ু সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল এই বলে যে, রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া প্রায় ১ ডজন বিল রাজ্যপালের কাছে পড়ে আছে। তিনি সম্মতি জানাচ্ছেন না বা অন্য কোন ব্যবস্থা করছেন না। যার ফলে রাজ্য বিধানসভায় আকাঙ্খা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিচারপতি জে বি পারজিওয়ালা এবং বিচারপতি আর মাধবনের বেঞ্চ এ ব্যাপারে ৪১৪ পাতার এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। তারা দৃঢ স্বরে একমত হয়ে বলেছেন রাজ্যপালদেরকে সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে, এমন কাজ তার পরিপন্থী। তারা এটা করতে পারেন না। রাজ্যপাল ও মহামহিম রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ কতটা সময় নিতে পারেন সেটা তারা বলে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-তালিকার দিকে তাকিয়ে চাকরিহারারা
১৯৯৪ সালের এস আর বোম্মাই মামলার মতো যুগান্তকারী রায়-এর সমতুল আর একটা রায় বলে আমার মনে হয়। সংবিধানের ৩৪৬ নং ধারাকে হাতিয়ার করে একটার পর একটা রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকার জরুরি অবস্থা জারি করছিল। শুধুমাত্র রাজ্যপালের তথাকথিত গোপন রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে। রাজ্যে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হচ্ছিল। ৩৫৬ নং ধারার যছেচ্ছার হচ্ছিল। এই মামলায় ৯ জন বিচারপতির বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল এবং ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগে কেন্দ্রীয় সরকার-এর উপর লাগাম পরানো হয়েছিল। অন্ধ্রপ্রদেশে ৩৫৬ লাগু করা রাজ্য সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বলে বিধানসভা ও মন্ত্রীসভা ফিরিয়ে দিয়েছি। এবারের রায়টিও তেমনই ঐতিহাসিক।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টে স্বীকারোক্তি পাক সরকারের, আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি কুলভূষণকে
এবার তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর এল রবি বিধানসভায় পাশ করা বিলে সই করছেন না। সরকার এই কাজের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করলেন। রাজ্য সরকারের দাবি, সংবিধানের বাংলার বিধানসভা নির্বাচন আর বেশি দূরে নেই। মালদার মোথাবাড়ি থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, সামশেরগঞ্জ, সূতি হঠাৎই অশান্ত। মানুষে মানুষে অবিশ্বাসকে ঘৃণায় পরিণত করে সীমান্ত পেরিয়ে এতবড় চক্রান্ত হল, অথচ দেশের গোয়েন্দা বিভাগ আটকাতে পারল না। দিল্লির সরকারটা আছে কি শুধু ওয়াকফের মতো সংখ্যালঘু বিরোধী বিল পাশ করাতে? তদন্ত হলে প্রথম খুঁজে বের করতে হবে বিএসএফ বাংলাদেশ থেকে আগত দুষ্কৃতীদের আটকাতে পারল না কেন? কেন রক্ত ঝরল ইতিহাসের শহরে? মানুষ বোকা নয়, তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে বেশ বুঝতে পারছেন, নির্বাচন এলেই যেমন এজেন্সির ধরপাকড়, তল্লাশি বাড়ে তেমনি সরকার বিরোধীরা আস্তিন গুটিয়ে গা ঘামায়। তা করতে গিয়ে বাংলার বদনাম এবং সর্বনাশ করতেও কেউ পিছপা নন। মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ আদালত আশ্বস্ত করার পরও যোগ্য চাকরিহারাদের ক্রমাগত উস্কানির বন্যা। এবারের লক্ষ্য রাত দখল না ভোট দখল? আনন্দ, দুঃখ, সৌজন্য, সহমর্মিতা যখন রাজনৈতিক প্রয়োজনেই চালিত হয়, তখনই গোল বাধে। তাই বামেরা বেমালুম সূচপুর গণহত্যা ভুলে যান। মানতেই চান না ‘চোরের ক্যাবিনেট’ বলে একদিন বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ছেড়েছিলেন ‘সৎ’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিজেপিও ভুলে যায় ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা, গোধরার রক্তস্রোতের ঘটনা। বাংলাকে এলোমেলো করতে পারলেই কেল্লাফতে! মুর্শিদাবাদের অপ্রত্যাশিত হাঙ্গামা আঙুল তুলছে বহিরাগত শক্তির চক্রান্তের দিকেই। পিছনে কাদের মদত সামনে আসুক! কেন্দ্রের নয়া আইনে বর্ডারের এপারে ৫০ কিলোমিটার এলাকার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনীরই হাতে ন্যস্ত। বাংলাদেশিরা ঢুকে এতবড় হাঙ্গামা বাধাল আর কেন্দ্রের অতন্দ্র আধাসেনারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! এক ধাক্কায় ২৬ হাজারের চাকরি গেলে সামাজিক পরিস্থিতি অশান্ত হতে বাধ্য। তা বলে জেলা থেকে রাজপথ, প্রধান সড়কের প্রতিটি বাঁকে চাকরিহারাদের দুঃখের সাতকাহনের বিপণনে মন দেবেন বাম-বিজেপির নেতানেত্রীরা! তাঁদের সুর এক, রং-টা শুধু আলাদা। বিশেষত মোদি সরকারের সৌজন্যে দেশে বেকারের সংখ্যা যখন রেকর্ড ছুঁয়েছে তখন এ বিপর্যয় অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যখন ওই অনিশ্চয়তা থেকে চাকরিহারাদের বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বৈঠক করছেন, আশ্বস্ত করছেন, সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ পিটিশন দাখিলের কথা বলছেন, উল্টোদিকের বিরোধীরা তখন প্রকাশ্যে দুঃখের ভান করলেও আনন্দে মশগুল। কত ভোট আসবে রে! অন্তত ক্ষমতা দখল না হোক ২৬ হাজারের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে যদি ‘টি-২০ নির্বাচন’-এর স্কোরটা বাড়ানো যায়! ভাবটা এমন, এবার বাগে পেয়েছি। এগারো সাল থেকে বারবার রিংয়ের বাইরে ছিটকে যাওয়ার হতাশা, প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে রাজ্যের বিরোধীরা এটাকে মওকা হিসেবেই দেখছেন। সিঙ্গুর কাণ্ডে দেশজোড়া বিতর্কের মধ্যে জমি নেওয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা সিপিএম স্বীকার করলেও বুদ্ধদেববাবুরা ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বৈঠকে বসেননি। পাশে থাকার কোনও আশ্বাসও দেননি। অথচ সুপ্রিম কোর্ট ২৬ হাজারের প্যানেল পুরোটা বিসর্জন দেওয়ার পরপরই মমতা কিন্তু এক মুহূর্ত বিলম্ব না করেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সেই অদম্য জেদের সামনেই সুপ্রিম কোর্ট ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যোগ্যদের চাকরির ব্যবস্থা করেছে। এটা কিন্তু চাকরি খাওয়া ভট্টাচার্য কিংবা বিচারক থেকে আচমকা সংসদ সদস্য বনে যাওয়া বন্দ্যোপাধ্যায়রা সহজে মেনে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। একটাই প্রার্থনা, যে কোনও মূল্যে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষ নজর থেকে সম্প্রীতির পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করুন। সমস্যা হতেই পারে কিন্তু এই বাংলার মাটিতে হিন্দু মুসলিম শিখ খ্রিস্টান সবার সমান অধিকার। কিছু স্বার্থান্বেষীর কথায় কান দিয়ে সেই ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে ধ্বংস করবেন না। গরিব খেটে খাওয়া মানুষের বাংলায় বামেরা যেমন আজ অপ্রাসঙ্গিক, তেমনি ধর্মের আড়ালে বিভাজনের বিষ ছড়ানোর বহিরাগত কারবারিদেরও রুখে দিতে হবে।