হুমকি, পালটা হুমকি, অসংযত ভাষার প্রতিযোগিতায় সাম্প্রতিক বিধানসভা সরগরম হয়েছিল। বিধানসভার চত্বরের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাননীয় বিরোধী দলনেতা বললেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিধায়কদের ‘চ্যাংদোলা’ করে ফেলে দেওয়া হবে। এসব হচ্ছেটা কী? বিধানসভা গণতন্ত্রের মন্দির। বাজেট অধিবেশনে বাজেট পেশ ও তৎসংক্রান্ত বিতর্কের পর বিভিন্ন দফতরের ব্যয়বরাদ্দ পেশ করা হয়। বিরোধী বিধায়কদের কাছে তখন সুবর্ণ সুযোগ, প্রশাসনিক বিভাগগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা, দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়া। গঠনমূলক সুপারিশ থাকলে, সেটি পেশ করা। কিন্তু নানা অছিলায় বিধানসভা বয়কট করে বিরোধীরা এই সুবর্ণ সুযোগ হারালেন। আটের দশকে কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা অত্যন্ত কম থাকা সত্ত্বেও সুব্রত মুখোপাধ্যায়, জয়নাল আবেদিন, অতীশ সিনহা, মানস ভুঁইয়া প্রভৃতি কয়েকজন বিধায়ক বিধানসভা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এবং প্রশাসনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন। আজ মানস ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। মাননীয় বিরোধী নেতা হিন্দুত্বের নতুন রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন মনে হয়। মহালয়ার দিন তর্পণ প্রভৃতি কয়েকটি বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানকে তিনি হিন্দুধর্মের সঙ্গে এক করে দিয়েছেন। যদি বলি, হিন্দুধর্ম বলতে কিছু নেই। আছে ভারতের সনাতন সংস্কৃতি ও জীবনধারা। হিন্দু একটি ভৌগোলিক ধারণা। পারসিরা যখন ভারতে এসেছিলেন, তাঁরা সিন্ধু নদীকে হিন্দু নদী বলেছিলেন, কারণ তাঁরা ‘স’ বলতে পারতেন না। কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন এই পবিত্র ভূমিতে নানা উপাসনা পদ্ধতি ও তার সঙ্গে নানা বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়েছিল। অনেকগুলি কালের গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে। আবার যাঁরা অন্য দেশ থেকে অস্ত্র হাতে এসেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই কালস্রোতে এই সনাতন সমাজ ও জীবনধারার মধ্যে মিশে গেছেন। ফলে তৈরি হয়েছে এক মিশ্র, উদার, গতিশীল জীবনধারা ও সংস্কৃতি । এটাই হিন্দু সংস্কৃতি, কোনও নির্দিষ্ট উপাসনা পদ্ধতি ও বাহ্যিক আচার দিয়ে একে সংকীর্ণ করা যায় না। এই সংস্কৃতি হল আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ও রাষ্ট্রীয়তাবাদের ভিত্তি। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতি অবিছিন্নধারায় স্মরণাতীত কাল থেকে প্রবাহিত। সেই ধারা কখনও প্রবল, কখনও দুর্বল, কখনও তার উজ্জ্বল জ্যোতিতে জাতির মানস উদ্ভাসিত, জগৎবাসী বিমোহিত, কখনও ক্রমবর্ধমান আস্তরণে সেই অগ্নি প্রায় নির্বাপিত (চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৩১)। রবীন্দ্রনাথ একই কথা অন্যভাবে বলেছেন: “প্রাচ্য সভ্যতার কলেবর ধর্ম। ধর্ম বলিতে রিলিজন নহে, সামাজিক কর্তব্যতন্ত্র; তাহার মধ্যে যথাযোগ্যভাবে রিলিজন, পলিটিক্স সমস্তই আছে। তাহাকে আঘাত করিলে সমস্ত দেশ ব্যথিত হইয়া উঠে; কারণ সমাজেই তাহার মর্মস্থান, তাহার জীবনীশক্তির অন্য কোন আশ্রয় নাই।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২ খন্ড, পৃষ্ঠা ১০৯২)। অতএব ভারতের উদার গতিশীল সনাতন সংস্কৃতির মধ্যে রিলিজিয়ন বা উপাসনা পদ্ধতি ও সামগ্রিকভাবে জীবনধারা রয়েছে। বিরোধী নেতা মহাশয় অবহিত আছেন কি ?
আরও পড়ুন-এবার জেলা ভিত্তিক কমিটি পিএইচএ’র ঘোষণা সংগঠনের কার্যনির্বাহী সমিতির সভায়
হিন্দুত্বের মূল কথা নিহিত রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনা ও কার্যধারার মধ্যে। নেতাজি সুভাষ তাঁর কৈশোরেই বিবেকানন্দের প্রকাশিত লেখা ও রচনা পাঠ শেষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে সেইসময় যে সমস্ত বই ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, প্রায় সবই পড়ে ফেলেছিলেন। সুভাষের মনে হয়েছিল, এই মহাপুরুষ যে কথা প্রচার করেছেন, সেটি নিজের জীবনে অভ্যাস করেছেন (An Indian Pilgrim, পৃষ্ঠা ৩৮)। শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ শুধু কথার কথা নয়। তিনি সমস্ত ধর্মমত ও উপাসনা পদ্ধতি অনুসারে সাধনা করেছেন এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই চরম সত্য উপলদ্ধি করেছেন। একথা নতুন কিছু নয়। এটাই ভারতের সংস্কৃতির শাশ্বত বাণী। নতুন ও বিরল ঘটনা হল, একজন মহামানব এই সত্যকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির এজেন্ট রাজ্যপালের অনৈতিক চিঠি, বৈধতাই নেই বললেন প্রাক্তন উপাচার্য
চিকাগো ধর্মমহাসভার প্রথম দিবসের অধিবেশনে ( ১১ সেপ্টেম্বর,১৮৯৩) স্বামীজি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন: “যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭)। দ্বিতীয় ভাষণে (১৯ সেপ্টেম্বর) বিবেকানন্দ বললেন, “কুসংস্কার মানুষের শত্রু বটে, কিন্তু ধর্মান্ধতা আরও খারাপ।” (ঐ, পৃষ্ঠা ১৯)। ধর্মমহাসভার শেষ এবং ষষ্ঠ ভাষণে (২৭ সেপ্টেম্বর) স্বামীজী বলেছেন: “যদি কেহ এরূপ স্বপ্ন দেখেন যে অন্যান্য ধর্ম লোপ পাইবে এবং তাঁহার ধর্মই টিকিয়া থাকিবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র, তাঁহার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত, তাঁহাকে আমি স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি, তাঁহার ন্যায় ব্যক্তির বাধাপ্রদান সত্বেও শীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকা উপর লিখিত হইবে: ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি’।” (ঐ,পৃষ্ঠা ২৮)। এই হল প্রকৃত হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্ম, যা আবহমান কাল থেকে বয়েছে। বিবেকানন্দ নতুন পরিস্থিতির আলোকে নতুন ভাবে জগৎসভার কাছে তুলে ধরেছেন।
মহামান্য বিরোধী নেতা এই তাত্ত্বিক আলোচনা নিয়ে আদৌ আগ্রহী কি না, জানি না। তবে ওঁর উদ্দেশ্য বোধের অগম্য নয়। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মনে উত্তেজনা, ঘৃণার মনোভাব ও একই সঙ্গে কৃত্রিম নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ তৈরির চেষ্টা করছেন। এই বছর যত দিন যাবে, এই অপচেষ্টা আরও বাড়বে। এমনকী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগানোর বেপরোয়া ষড়যন্ত্র হতে পারে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। বাংলার মাটিতে এ-সব চলে না। এই রাজ্যের মানুষ সংকীর্ণ জাত-পাত ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। বরং মান্যবরের এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য ও কীর্তিকলাপ ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামো বিরোধী- ভ্রাতৃত্ববোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে লঙ্ঘন করছে।