মিঠেপিঠের উৎসব

পৌষপার্বণ অঞ্চল ও পরিবার ভেদে নিয়মরীতি ও লোকাচার ভিন্ন হলেও মূলে থাকে আবহমানকালের বিশ্বাস, অকৃত্রিম আনন্দ উপভোগ, মহাসমারোহে উদরপূর্তি আর ঘর গেরস্থালি সুখ-সমৃদ্ধির প্রার্থনা। লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম হল পৌষপার্বণ অথবা মকর সংক্রান্তি উৎসব। পৌষপার্বণ কথাটার গায়ে যেমন শীতকালের মিঠেসৌরভ জড়ানো তেমনি পৌষসংক্রান্তি মানেই চোখে ভাসে পিঠেপুলির হরেক সম্ভার। সুদীর্ঘকালের এই উৎসবের উল্লেখ কিন্তু পুরাণেও আমরা পাই।
শীতকাল আসা মানেই ভোজনরসিক বাঙালি পৌষপার্বণের দিনটা ক্যালেন্ডারে আগেই দাগ দিয়ে রাখে। অঞ্চল ও পরিবার ভেদে নিয়মরীতি ও লোকাচার ভিন্ন হলেও মূলে থাকে আবহমানকালের মানুষের গভীর বিশ্বাস, অকৃত্রিম আনন্দ, মহাসমারোহে উদরপূর্তি আর ঘর-গেরস্থালির সুখ-সমৃদ্ধির প্রার্থনা।
পৌষসংক্রান্তি শুরুই হয় পুজোপাঠ ঘিরে। কোনও পরিবারে সুন্দর আলপনা দেওয়ার চল, কোথাও আবার সাড়ম্বরে লক্ষ্মীপুজো, নতুন জামা-কাপড় পরা-সহ দু’দিন ধরে নানা নিয়মরীতিও দেখা যায়।

আরও পড়ুন-মকরপার্বণী

গ্রামাঞ্চলে গোয়ালঘর, তুলসীমঞ্চ, ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, ধানের গোলায় গোবরজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নতুন ধান ঘরে তোলার নিয়ম। ধানের মরাইয়ে দেওয়া হয় শ্রীচিহ্ন। আসলে নতুন ফসলকাটা শুরু হয় সংক্রান্তির দিন থেকে। মাঠের সোনালি ধান এই দিন ঘরে আসে। ভরে ওঠে ঘরগৃহস্থালি।
পৌষমাসের শেষ এবং মাঘমাসের শুরুতে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন থেকে অপেক্ষা শুরু হয়ে যায় পৌষসংক্রান্তির জন্য। অনেক জায়গায় পৌষ-জাগানো অনুষ্ঠিত হয় সারারাত জেগে। গঙ্গাস্নান করে পুণ্য অর্জন কিন্তু এই দিনের অন্যতম অঙ্গ।
মকর সংক্রান্তির দিনে গঙ্গাসাগর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গঙ্গাসাগর বারবার— এই দিনে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে পুণ্য অর্জন হয়। গঙ্গাসাগরেই কপিলমুনির আশ্রমে পুজো দেওয়ার জন্য ভিড় করেন লক্ষাধিক পুণ্যার্থী।

আরও পড়ুন-রেকর্ড! ৫১ বছরে উষ্ণতম মকর সংক্রান্তি বাংলায়

সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হওয়ায় এই দিনটিকে শুভ মেনে রবিশস্য ঘরে তোলার উৎসব শুরু হয়। নতুন ধান ঘরে উঠলে পিঠে-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায় স্বাভাবিকভাবে। অনেক বাড়িতে আগের দিন থেকে শুরু হয়ে যায় পিঠে-পুলির উৎসব। খাওয়া হয় পরের দিন। কেউ কেউ এই দিনটাকে তিল-সংক্রান্তিও বলে। লোকবিশ্বাস এই যে, এই দিন তিল না খেলে সূর্যের মকরযাত্রা সংঘটিত হয় না। ভারতীয় সংস্কৃতিতে উত্তরায়ণের সূচনা হিসেবে দিনটিকে পালন করা হয়। ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য কীর্তন ও পালাগানেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে এই দিনে।
কোনও অঞ্চলের নিয়ম হল আগের দিন চাল-কোটা। এ ছাড়াও শিষ-সহ ধানের গাছ বাঁধা হয় গোয়ালঘর, ঢেঁকিঘর এবং সিন্দুকে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ধান প্রধান ফসল। তাই নতুন চাল পৌষপার্বণের মুখ্য উপাদান। এই দিন সকালে পরিবারের সবাই স্নান সেরে ঠাকুর পুজো এবং চালের তৈরি পিঠে-সহ বৈচিত্রময় ব্যঞ্জন মহিলারা রান্না করে ঠাকুরকে নিবেদন করেন। আবহমান কালের এটাই রীতি।

আরও পড়ুন-ঘাঁটি গেড়েছেন আট মন্ত্রী, অরূপ ছুটছেন-সামলাচ্ছেন

প্রকৃতির দানে সৃষ্টি নতুন চালই পৌষপার্বণের মুখ্য উপাদান। নির্মল আনন্দ উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে এই দিন।
বাংলার মেয়েরা ছড়াকাটে
‘পৌষ পৌষ সোনার পৌষ
এসো পৌষ এসো পৌষ যেও না
জন্ম জন্ম ছেড়ো না।’
পৌষসংক্রান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল আউনি বাউনি বা আউরি বাউরি। পালিত হয় পৌষসংক্রান্তির আগের দিন। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে এর বর্ণনা এই রকম—
‘‘…আওরি বাউরি দিয়া সব বাঁধিতে হইবে। মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড়ের দড়িতে সমগ্র সামগ্রীতে বন্ধন দিতে হইবে।”
‘‘আজিকার ধন থাক, কালিকার ধন আসুক,পুরাণে নতুনে সঞ্চয় বাড়ুক।”
লক্ষ্মীঠাকুর শ্রী ও সমৃদ্ধির প্রতীক। তাঁরই আশীর্বাদে সোনালি ফসল ঝরে পড়ে দেবী বন্দনায় ভক্তির অর্ঘ্য রূপে। তাই পৌষলক্ষ্মী বা ধান্যলক্ষ্মী হিসেবে আরাধ্যা তিনি।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

অনেক পরিবারেই এই দিন বাস্তুপুজোর নিয়ম রীতি রয়েছে। ‘আমার মার বাপের বাড়ি’ গ্রন্থে রানি চন্দ লিখেছেন, ‘‘মহা ধুমধাম-এর সংক্রান্তি। বসতভিটার মঙ্গলের জন্য বাস্তু পুজো হয়। তুলসী মণ্ডপে ঝিকা গাছের ডাল কেটে তার তলায় পুজো হয়। পুরুতমশাই নিজে চরু রান্না করে দিয়ে যান। চরুই পুজার প্রধান অঙ্গ। চরু রান্না হয় পাটশলমির আগুনে, নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ চাল বাতাসা ফুটিয়ে।”
বড় উনুন জ্বালিয়ে পিতলের কড়াইতে চরু রান্নার চিত্র আমরা অনেকেই দেখেছি। ঠাকুর মশাই একদিকে পুজো সারবেন অন্যদিকে গৃহিণীরা রান্নাঘরে পিঠে-পুলির আয়োজন শুরু করেন মহা-আনন্দে— এই দৃশ্যও খুবই পরিচিত।
অনেক পরিবারে আগের দিন ভাজাপিঠে তৈরির নিয়ম সেটা সেদিন ও পরের দিন খাওয়া হয়। এদিন যে নানান পিঠে তৈরি হয় তা দু’তিনদিন ধরে খাওয়া হয়। এইভাবেই চলে পিঠেপুলির উৎসব।

আরও পড়ুন-কাল রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের কালাদিবস পালন

এবার আসি নানান পিঠেপুলি-সংক্রান্ত খাবারের কথায়। পাটিসাপটা, সরু চাকলি, পায়েস, মালপোয়া, আসকে পিঠে বা সরাপিঠে, গোকুলপিঠে, দুধপুলি, পুলিপিঠে, চষিপুলি-সহ নানা কিছু পৌষ-উৎসবে থাকে। নতুন খেজুর গুড়, দুধ, চালগুঁড়ো, নারকেল, ক্ষীর এসবের প্রধান উপকরণ।
বাড়ির মা-ঠাকুমারা শুদ্ধ কাপড় পরে এই আয়োজনে শামিল হতেন। প্রথম পিঠে আবার অগ্নিদেবকে উৎসর্গ করা। তারপর বড় বড় কাঠের আর পিতলের বারকোশে সাজিয়ে ফেলা অগুন্তি পিঠেপুলি-সম্ভার। ছোট থেকে বড়— বাড়ির সব সদস্য মেতে উঠত উদরপূর্তির এই মিষ্টি উৎসবে।
শুধু নিজেদের ভূরিভোজই নয়, এই দিন ঠাকুরকেও ভোগ নিবেদন করা হয়। শীতের সবজির খিচুড়ি, পাঁচ বা সাত ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পায়েস ।
গ্রামে-গঞ্জে এই পার্বণ উপলক্ষে মহাসমারোহে মেলা বসে। একটা সময়ে মকরস্নান সেরে সই পাতানোর মতো নির্মল আনন্দে মেতে ওঠা ছিল এই দিনেই। একে বলা হত মকর পাতানো। এক সই আরেক সইকে ফুল বিনিময় করে, নির্ণয় করে সেই ফুলের নামে ডাকত। যেমন গোলাপ ফুল দিয়ে সই হত ‘গোলাপ সই’, বকুল ফুল দিয়ে ‘বকুল সই’।

আরও পড়ুন-কামারহাটির রেল বস্তিতে আগুন

এই মকর পরবের দিনেই দক্ষিণ-পশ্চিমে এক অতি জনপ্রিয় উৎসব টুসু। বাড়ির যেখানে ধান রাখা হয় সেখানে টুসুপুজো হয়। নারকেল, বাদাম, কুল, মিষ্টি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। বাড়ির মহিলারা সারারাত জেগে গান করেন।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই উৎসব চলে আসছে। পুরাণ অনুযায়ী, এই তিথিতেই ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। আবার এই দিনেই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। তাই আজও এই বিশ্বাস সুগভীরভাবে মানুষের মনে প্রোথিত যে, মকর সংক্রান্তিতে অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও একটা কথা, পৌষপার্বণ মানেই শুধু নিজের রসনাতৃপ্তি, এমনটা নয়।

আরও পড়ুন-অডিওটেপ প্রকাশ্যে, প্রার্থী পিছু ২.৫০ লাখ করে ঘুষ, টাকা নিয়ে ১৭ চাকরি! ফাঁপড়ে বিজেপি বিধায়ক

আদিকাল থেকেই আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শি বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে আদানপ্রদানের পালা চলে। এ যেন খেয়ে ও খাওয়ানোর উৎসব। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে খাইয়ে এই নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ। একটা সময় পর্যন্ত মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতেও নতুন চাল, নতুন গুড়, নারকেল, মিষ্টি পাঠানোর রীতি-রেওয়াজ লক্ষ্য করা যেত।
এ তো গেল আবহমানকালের নিয়ম।
বদলেছে সময়। আমূল বদল ঘটেছে মানুষের মন মানসিকতা ও জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির। মা, ঠাকুমা, কাকিমা, জেঠিমার একান্নবর্তী পরিবার বিলুপ্তির পথে। ভুবনায়নের জোয়ারে গা-ভাসানোর দিনে ঘর আর কর্মক্ষেত্র সামলানো মহিলাদের আর গলদঘর্ম হতে হয় না পিঠেপুলি তৈরি করতে। মিষ্টির দোকানেই সব পাওয়া যায়। তাছাড়া এই সাবেকি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মকর সংক্রান্তির সময় ‘পিঠেপুলি পার্বণ’ অনুষ্ঠিত হয় নানা জায়গায়। মেলা ও বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকা থেকে মহিলা-পুরুষেরা এসে বাংলার হারিয়ে যাওয়া সুস্বাদু ও রকমারি পিঠে-পুলি হাজির করেন। সেখানে হরেক কিসিমের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী পিঠেপুলির সম্ভার মেলে। সেই কারণেই আজকের দিনে পিঠে-পায়েসের জন্য বাড়ির মহিলাদের আর গলদঘর্ম হতে হয় না। স্যুইগি, জ্যোমাটোর রমরমায় মুঠোফোনের ছোঁয়াতেই আপনার মনপসন্দ মিঠাই মুহূর্তে হাজির আপনার দোরগোড়ায়।

আরও পড়ুন-কাল রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের কালাদিবস পালন

তবে একথাও ঠিক কেউ কেউ আবার অত্যুৎসাহী হয়ে বাড়িতেই তৈরি করেন উপাদেয় সব পিঠেপুলি। আপনজনদের ভালবেসে সাবেককালের ঐতিহ্য রক্ষা করেন।
তবে মকর সংক্রান্তি এবং পিঠেপুলির উৎসব কিন্তু স্বকীয়তা হারায়নি। বাজারে, মিষ্টি দোকানের লম্বা লাইনে এবং গঙ্গাসাগরের মেলায় লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর ভিড় দেখা যায়।
সুতরাং বঙ্গসংস্কৃতিতে মিঠাপিঠার ঐতিহ্যবাহী উৎসব চলছে এবং চলবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

Latest article