তমসো মা জ্যোতির্গময়

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর কথা আমরা জানি সবাই কিন্তু সময়ে দিশা পাই না এমনটা ঘটে আকছার। ক্ষেত্রবিশেষে সেই দিশা দেখানোর কাজটা করেন অনেকেই। যাঁদের থেকে জীবনের পাঠ পাওয়া যায়, যাঁরা শর্তহীন সঙ্গ দেন সব মুহূর্তে— তাঁরাই আমাদের গুরু। দ্ব্যর্থহীনভাবে আমাদের জীবনের প্রথম গুরু আমাদের মা। জন্মদাত্রী। তবু এমন আরও কেউ কেউ আছেন যাঁরা রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কিন্তু আলোর পথযাত্রী। তাঁদের কথা চৈতালী সিনহার কলমে

Must read

গুরু শব্দের অর্থ জীবনে যাঁর গুরুত্ব আছে। গভীর প্রয়োজন আছে। এককোষী ভ্রূণের বহু বিভাজন থেকে যে শরীর আলো দেখে পৃথিবীর তাকে জীবনের হাঁটি-হাঁটি পা-পা থেকে শুরু করে শিখতে হয় আমৃত্যু। কখনও কেউ হাতে ধরে শেখায়, বলে শেখায় কখনও সে নিজে শেখে। ঠেকে শেখে, ঠকে শেখে। কখনও অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার জন্য লাগে পরাবিদ্যা শিক্ষা। জীবিকা অর্জনের জন্য লাগে অপরাবিদ্যা। তাই শিক্ষা এক আবহমান নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। যেকোনও শিক্ষক হলেন গুরু। ‘গু’ মানে অজ্ঞানের অন্ধকার এবং ‘রু’ মানে আলো। অন্ধকার দূর করে যিনি আলো দেখান বা জ্ঞান দান করেন তিনিই গুরু। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তাই গুরুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গুরু পূর্ণিমা।
এক অক্ষরের গুরু
পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য, টিকে থাকার জন্য প্রথম শিক্ষা শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। তাই আদি গুরু মা। স্বর্গের চেয়েও বড় মানে কতটা বড় না ভেবে বড়র যে অন্ত শব্দ বৃহত্তম, মা বোধকরি তাতেও আঁটবেন না। সৃষ্টির পিছনে যে রহস্যই থাক না কেন, তিনি জগৎকারণ কালকলন কালী হোন চাই পরমপিতা কিংবা সেই নিরাকার ব্রহ্ম কিংবা বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং তত্ত্ব সেই স্রষ্টা এক মহারসিক নিঃসন্দেহে। ভবিষ্যতে নারীর হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাবে, চলে যাবে তার স্বাধীনতা এমন একটা ধারণা তাঁর নিশ্চয়ই হয়েছিল। তাই মাকে গুরুর আসনে বসাবার সব ব্যবস্থা করেই সৃষ্টি হয়েছিল মানব কোষের, যেখানে কোষের শক্তিঘর মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএ আসে সর্বদা মাতৃকোষ থেকে। বংশ পরম্পরায় পিতৃকুল আর গোত্র রক্ষা বাইরে চললেও ভিতরে শক্তি বহন করে মা। তাই জাগতিক আধ্যাত্মিক দৈবিক সব গুরুর আগে মা পরম গুরু।
গুরু পূর্ণিমার পুণ্য জোছনার মেদুর আলোয় কয়েকজন মাকে দেখব যাঁরা জগৎ কল্যাণের মহাদায় নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন মা— গুরুপত্নী নন, পাতানো মা নয়, জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে হয়েছিলেন মহাগুরু, সত্যিকারের মা— বিজ্ঞানের পরিভাষায় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ।

আরও পড়ুন-আমি যাঁকে গুরু মানি

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে
নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর নৃত্য সম্পর্কে আনন্দময়ীর বিশ্লেষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আনন্দময়ীর মতে জগৎটাই নৃত্যময়; জীবের মধ্যে যে প্রাণের স্পন্দন, এমনকী বীজ থেকে যখন অঙ্কুরোদ্গম হয় তখন সেখানেও এক ধরনের তরঙ্গময় নৃত্যের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গরূপ নৃত্য যে মূল থেকে উদ্ভূত হয়, একসময় স্তিমিত হয়ে আবার সেই মূলেই মিলিয়ে যায়। এই রূপকের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ককেই নির্দেশ করেছেন। কে এই আনন্দময়ী মা যিনি এত সহজে করেছেন কঠিন তত্ত্ব ব্যাখ্যা? এখনকার বাংলাদেশ, ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলার খেওড়া গ্রাম ১৮৯৬-এর ৩০ এপ্রিল দেখেছিল তাঁর আগমন। বাবা মুক্তানন্দ গিরি নাম নিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছেন আর তারই প্রভাব পড়েছে ছোট মেয়ে নির্মলার প্রাণে। হরিসংকীর্তন শুনে হয়ে যান ভাবাবেশে মোহিত। বারোর কোঠায় রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে বাঁধা হল গাঁটছড়া। প্রথম দিকে আধ্যাত্মিক অনুভূতি ভাবাবেগ লোকের চোখে ছিল অসুস্থতা, হিস্টিরিয়া। কিন্তু সব হিস্ট্রি লেখা হয় ঘটনার অনেক আগেই। শাহবাগে কালীমন্দিরে সাধনাকালে দিব্য ভাবাবেগে মা ধরা দেন এক আনন্দঘন আবেগে। এখন থেকে নির্মলা হয়ে ওঠেন মা আনন্দময়ী নামে খ্যাত। ঢাকায় রমনা অঞ্চলে গড়ে ওঠে আশ্রম। সেখানে ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ডাক্তার ত্রিগুণা সেন, গোপীনাথ কবিরাজ প্রমুখ। নিজেই স্বামী রমণীমোহনকে দীক্ষা দিয়ে করে ছিলেন সঠিক অধ্যাত্ম্য সঙ্গী, ডাকতেন ভোলানাথ বলে। আনন্দময়ী মা পরে স্বামীর সঙ্গে উত্তর ভারতের দেরাদুনে চলে যান, মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। তাঁর একটি বিশেষ কীর্তি হল প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান নৈমিষারণ্যের পুনর্জাগরণ ঘটানো। সেখানে গিয়ে তিনি নতুন করে ভগবৎ সাধনার ক্ষেত্র তৈরি করেন। নৈমিষারণ্য বর্তমানে একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান এবং প্রতি বছর বহু ভক্ত আসেন। এরপর তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে পুরাতন তীর্থসমূহের সংস্কার সাধন এবং নতুন নতুন তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের রমনা ও খেওড়া-সহ ভারতের বারাণসী, কনখল প্রভৃতি স্থানে তাঁর নামে আশ্রম, বিদ্যাপীঠ, কন্যাপীঠ, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শ্রীআনন্দময়ী মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ‘সংসারটা ভগবানের, যে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় থেকে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।’ এটাই আনন্দময়ীর মুখ্য বাণী। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অগাস্ট তিনি নশ্বর শরীর ত্যাগ করেন। তাঁর মরদেহ উত্তর ভারতের হরিদ্বারে কনখল আশ্রমে গঙ্গার তীরে সমাধিস্থ করা হয়। অসংখ্য ভক্ত-শিষ্যের কাছে রেখে গেলেন ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের তীব্র সমালোচনা সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির

বিরাজে সত্য সুন্দর
১৯২৯ সালে আলবেনিয়ার গোলাপ কুঁড়িটি ভারতে এসেছিলেন সিস্টারস অফ লোরেটো সংস্থার ধর্মপ্রচারক হয়ে ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। দার্জিলিংয়ে এসে নবদীক্ষিত অ্যাগনেস কাজ শুরু করলেন পুরোমাত্রায়। দু’বছর পর সন্ন্যাস নাম পান তেরেসা বা টেরিজা। লোরেটো হাউসে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে কলকাতায় এলেন এবং মুখোমুখি হলেন এক মন্বন্তর আর দাঙ্গাপীড়িত বাংলার সঙ্গে। মানুষের দুর্দশায় আহত হল মাতৃহৃদয়। লোরেটো-অভ্যাস ত্যাগ করে নীল-সাদা সুতিবস্ত্র পরিধান করে, ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন স্নেহের আঁচল পেতে। বস্তি এলাকায় শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন নিরবচ্ছিন্ন। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামক একটি সংস্থা গড়ে তুলে অনাথ, আতুর, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন মাদার টেরিজা। আলবেনিয়ার মেয়েটি, অ্যাগনেস গোঞ্জা বোজাঝিউ— গোঞ্জা মানে গোলাপ কুঁড়ি। মিশনারিজ অফ চ্যারিটির উদ্যোগে এইডস আক্রান্তদের পুনর্বাসন, অনাথ আশ্রম স্থাপন করা হয়। বিশ্বব্যাপী শরণার্থী, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বয়স্ক, মাদকাসক্ত, দরিদ্র, অনিকেত, বন্যা-কবলিত ইত্যাদি সকল প্রকার মানুষের পাশে থাকে মায়ের স্নেহের পরশ। গড়ে ওঠে নির্মল শিশু ভবন, নির্মল হৃদয় ও আরও নানা প্রতিষ্ঠান।
মাদারের এই কর্মযজ্ঞ ছিল একাধারে নিন্দিত ও নন্দিত। মুমূর্ষু, দুঃস্থ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিনিময়ে মা তাদের ধর্মান্তরিত করেছেন। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছেন অনেক মানুষকে। (এরপর ১৮ পাতায়)

আরও পড়ুন-ধ্বংস অর্থনীতি, অবাধে চলছে লুঠপাট, ফের ইউনুসকে বিঁধলেন শেখ হাসিনা

অসহায়, অপাঙ্‌ক্তেয় মানুষকে সুস্থ জীবনের সন্ধান দিয়েছেন, জ্বালিয়েছেন বিবেকদীপ। সব ধর্ম আদতে সেই ধরে রাখার রূপকথা মাত্র।
নানা অলৌকিক কাজ হত মায়ের হাতের স্পর্শে। একবার মাথায় একাধিক টিউমার আক্রান্ত ব্যক্তি মায়ের হাতের স্পর্শে সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে পোপ মাকে সন্ত বা সেইন্ট-এর স্বীকৃতি দেন। পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। ভারত সরকার মাকে দেন সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার— ভারতরত্ন। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি নশ্বর দেহ ছেড়ে আলোর পথে লীন হলেন। লক্ষণীয়, তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। মায়ের চেয়ে বড় শিক্ষক ও গুরু কেউ হয় না।
সতেরও মা অসতেরও মা
মা সারদা বাঙালির প্রাণের মা। গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, মন্ত্র দীক্ষা দিয়ে শিষ্যকে সত্যিকারের মায়ের খোঁজ দিয়েছিলেন মা সারদা। ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদাদেবীর জন্ম হয়। তাঁর পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে সারদা দেবী বলেছিলেন, ‘‍‘ছেলেবেলায় দেখতুম, আমারই মতো মেয়ে সর্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমার সকল কাজের সহায়তা করত— আমার সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ করত; কিন্তু অন্য লোক এলেই আর তাকে দেখতে পেতুম না।’’ সেকালে প্রচলিত গ্রাম্য প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এরপর ১৪ বছর বয়সে প্রথম সারদাদেবী স্বামী সন্দর্শনে কামারপুকুরে আসেন। এই সময় তিনি যে তিন মাস শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করেছিলেন, তখনই ধ্যান ও অধ্যাত্ম জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি পান তাঁর স্বামীর কাছ থেকে। আঠারো বছর বয়সে তিনি শোনেন, তাঁর স্বামী পাগল হয়ে গেছেন। পিতার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে আসার পর তাঁর ভয় ও সন্দেহ অপসারিত হয়। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী সম্পর্কে যে সব গুজবগুলি রটেছিল তা কেবলই সংসারী লোকের নির্বোধ ধারণামাত্র। তিনি দেখলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তখন সত্যিই এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু। এইসময় সারদা দেবী ও দিব্যমাতৃকাকে অভিন্ন জ্ঞান করে শ্রীরামকৃষ্ণ ষোড়শী পুজো করেন। জন্ম নেয় এক বিশ্বমাতৃকার বীজ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে মন্ত্রশিক্ষা দেন এবং মানুষকে দীক্ষিত করে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করতে পারার শিক্ষাও দান করেন। শেষ জীবনে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ গলার ক্যানসারে আক্রান্ত তখন সারদা দেবীই স্বামীর সেবা এবং স্বামী ও তাঁর শিষ্যদের জন্য রন্ধনকার্য করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁকে কেন্দ্র করে অঙ্কুরিত ধর্ম আন্দোলনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সারদা দেবী।
জাগতিক নানা কার্যে মা ছিলেন এক আদর্শ নারীর উদাহরণ। সে-যুগে জন্মেও মা ছিলেন নিঃশব্দ বিপ্লবী— জাতপাত না মানা, অস্পৃশ্যতা বর্জন করে মা দেখিয়েছিলেন কথার চেয়ে কাজ বড়।
শ্রীমা রামকৃষ্ণ সংঘ ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনটি লাভ করেছিলেন। মা ছিলেন ‘সতের ও মা অসতেরও মা’। রামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। গড়ে উঠেছিল বেলুড় মঠ। মা হয়ে উঠেছিলেন সংঘজননী। শ্রীরামকৃষ্ণ মাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের প্রয়াণের পর রামকৃষ্ণ আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং ভক্তদের বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর সত্তায় কোনও পার্থক্য আরোপ না করতে। কয়েকজন শিষ্যও তাঁর দর্শন লাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতিপ্রাপ্ত হন। কেউ তাঁর সাক্ষাৎ দর্শনের পূর্বেই দেবী রূপে তাঁর দর্শন লাভ করেন। আবার কেউ স্বপ্নে তাঁর থেকে দীক্ষা লাভ করেন। যেমন বাংলা নাটকের জনক গিরিশচন্দ্র ঘোষ, যিনি মাত্র উনিশ বছর বয়সে স্বপ্নে তাঁর কাছে থেকে মন্ত্র লাভ করেছিলেন। অনেক বছর পরে যখন তিনি সারদা দেবীকে দেখলেন, অবাক হলেন তাঁর স্বপ্নে দেখা সেই দেবী ইনিই।
‘যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার’— এই উপদেশটিই বিশ্বের উদ্দেশ্যে মায়ের শেষ বার্তা। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে মায়ের প্রয়াণ ঘটে।
শ্রীসারদা মায়ের একটি বিখ্যাত উক্তি হল— ‘‍‘আমি পাতানো মা নই, গুরুপত্নী নই, কথার কথা মা নই, আমি সত্যিকারের মা।’’ এই মাতৃভাব তাঁকে দিয়েছে এক মহাজাগতিক উত্তরণ। সাধারণ চোখে এক গ্রাম্যপল্লিবালা, এক গরিব ব্রাহ্মণ বিধবা থেকে বিশ্বমাতৃকা, সংঘজননী হয়ে ওঠা এক মহাজীবনের ইতিহাস।

আরও পড়ুন-ধ্বংস অর্থনীতি, অবাধে চলছে লুঠপাট, ফের ইউনুসকে বিঁধলেন শেখ হাসিনা

মহিমা তব উদ্ভাসিত
মীরা আলফাসা। ১৮৭৮ সালে ফ্রান্সে ইহুদি পরিবারে জন্ম। ছোট থেকেই আধ্যাত্মিক টান অনুভব করতেন মনে। নাটক সংস্থায় কাজ করতে করতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী বিবেকানন্দের রাজযোগ সম্পর্কিত বই পড়ে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের উপর গভীর টান অনুভব করেন। ফরাসি ভাষায় অনূদিত গীতা পড়ে ভারতীয় অধ্যাত্মবিদ্যাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে যায়। ছিন্ন হয় বিবাহবন্ধন। পুনর্বিবাহ করলেন দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত পল রিচার্ডকে। ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ধর্ম ও দর্শনে আগ্রহী দম্পতি ভারতে এলেন, পণ্ডিচেরি-শ্রীঅরবিন্দ সান্নিধ্যে।
সেই সান্নিধ্যে পূর্ণ হল সে-সাধনাবৃত্ত। আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। যোগসিদ্ধ দুই মহাপুরুষের সাধনার মিলিত ফল দেশ ও দশের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছিল। অরবিন্দ আশ্রমের মূল মন্ত্র সেবাধর্ম, যার প্রকাশ মানবসেবার মধ্যে। without he, I exist not, without me he is unmanifest. মীরা হয়ে উঠলেন জগন্মাতা শ্রীমা। মাকে ঠিক শ্রীঅরবিন্দের শিষ্য বলা যায় না, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ অনুগামী, যা ঈশ্বরের অভিপ্রেত ও নির্দেশিত।
অরবিন্দ একসময় চরম স্বদেশিকতার পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি ঈশ্বর চেতনায় নিমগ্ন হলেন তখনও দেশমাতৃকার মঙ্গল কামনাতেই ব্রতী ছিলেন। আশ্রম প্রতিষ্ঠা ও সর্বত্র যাতে শান্তি ও আনন্দ বজায় থাকে সেই জন্য ছিল শ্রীমার তৎপরতা। অরবিন্দের সাধনা, অরবিন্দের ধ্যান-যোগ সবকিছুতেই শ্রীমা ছিলেন তাঁর সাহায্যকারী একমাত্র অনুগামী। নীরবে তাঁর সাধনায় সাহায্য করেছেন। অরবিন্দের নির্দেশমতো, মা কান্ডারি হয়ে মানুষের মঙ্গলের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে মা আশ্রম তৈরি করে অরবিন্দের সাধনার যোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে অরবিন্দের সাধনার ফল তাঁর অনুগামীরা পায়, সর্বোপরি দেশের মানুষ যাতে তাঁর আলোয় আলোকিত হয়। সারা পৃথিবীর বহু জায়গায় আজ অরবিন্দ আশ্রম গড়ে উঠেছে। অরবিন্দের সাধনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া সম্পূর্ণটাই সম্ভব হয়েছে শ্রীমার জন্য। এক অলৌকিক আনন্দ জ্যোতি শ্রীমা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিশ্ববাসীর মনে, দূর করতে চেয়েছিলেন মানবমনের সঙ্কীর্ণতা, অহঙ্কার, যাতে হানাহানি ভুলে, সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে। জগতের যতটুকু মঙ্গলসাধন, এই দু’জনের সম্মিলিত সাধনার ফলেই যে সার্থক হয়েছে এবং সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ১৭ নভেম্বর ১৯৭৩-এ তাঁর জাগতিক কর্মভারের অবসান ঘটে।

আরও পড়ুন-ধ্বংস অর্থনীতি, অবাধে চলছে লুঠপাট, ফের ইউনুসকে বিঁধলেন শেখ হাসিনা

মাতৃরূপেণ সংস্থিতা
১৮৬৭ সালে জন্ম, অ্যাংলো আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল ছিলেন লেখিকা ও শিক্ষিকা। এক ঐশ্বরিক অঙ্গুলিহেলনে তিনি প্রাচ্য থেকে আসা এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পেলেন। নব বেদান্তের আলোয় সে মহামানব তখন বিশ্ববিজয়ী। যে-আলোর সামনে নত হয় সূর্য, সে-আলোর ছটায় মার্গারেট আমূল পরিবর্তন হয়ে হলেন নিবেদিতা। সিস্টার নিবেদিতা। একজন বিদেশি মহিলা ভারতে এসে দিনের পর দিন স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বস্তিতে বস্তিতে ঘুরছেন তিনি যদি নিবেদিত প্রাণ না হবেন তাহলে আর কেই বা হবেন নিবেদিতা। লোকের হাসি তামাশা, প্লেগের ভয়াবহ পরিবেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের মতো চেহারাগুলোর অসহযোগিতার মধ্যেও বিদেশি বোনটি মাতৃরূপে লড়ে গেছেন সমস্ত প্রতিকূলতার লড়াই। ভারতের জাতীয় আন্দোলন, নারীশিক্ষা নানা বিষয়ে নিবেদিতা উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি আজ মহীরুহ। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য নারী যিনি ভারতীয় সন্ন্যাসিনীর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।
জীবনের শেষ পর্বে নিবেদিতা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্য স্থাপিত হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকার যাতে রামকৃষ্ণ মিশনকে অযথা উত্ত্যক্ত না করে, সেই কথা ভেবে মিশনের সঙ্গে তিনি তাঁর আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ত্যাগ করেন। তবে সবসময় তিনি ছিলেন শ্রীশ্রী সারদা মায়ের আদরের খুকি।
১৯১১ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর দেহ দার্জিলিংয়ে দাহ করা হয় এবং তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে লেখা থাকে : ‘এখানে ভগিনী নিবেদিতা বিশ্রাম নিচ্ছেন, যিনি ভারতকে তাঁর সর্বস্ব দিয়েছিলেন।’ তাঁর কাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ‘লোকমাতা’ নিখুঁতভাবেই মানানসই।

Latest article