প্রতিবেদন : ট্যাংরার ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত, এটি বিরলতম একটি আত্মহত্যার প্লট। জেরা চলছে দুই ভাই প্রতীক-প্রসূন দেকে। সুস্থ হলে প্রয়োজনে কথা বলা হবে পুত্রসন্তানের সঙ্গেও।
কেন আত্মহত্যা : ট্যাংরার দে পরিবারের আত্মহত্যার ঘটনার পিছনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ঋণ। একটি ঋণ থেকে বাঁচতে আর একটি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া চলছিল টানা। কিন্তু শেষে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। বাড়িতে-অফিসে পাওনাদারদের তাগাদা। কর্মীদের বেতন দিতে না পারা, ব্যাঙ্কের লোকেদের রোজ ফোন, দরজায় কড়া নাড়ায় রাতের ঘুম ছুটে যায় পরিবারের। সামাজিক অসম্মান, লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথ খুঁজছিল তারা। দু’জনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে কেন জানানো হয়নি, এমন প্রশ্নও উঠেছে। প্রাথমিক জেরায় তারা জানিয়েছে, ঋণের পরিমাণ এতটাই ছিল যে, তাদের কোনও আত্মীয়ের পক্ষে তা শোধ করা সম্ভব ছিল না। ফলে তাদের জানিয়ে সমস্যা বাড়াতে চায়নি দুই ভাই।
সম্পত্তি : ঋণ মেটাতে একের পর এক সম্পত্তি বিক্রি করেছিল প্রতীক-প্রসূন। নয়তো মর্টগেজ রেখেছে। ৯০% সম্পত্তি বিক্রি করে ফেললেও শান্তিনিকেতনের একটি জমি এখনও অবিক্রীত রয়ে গিয়েছে। জমিটির পিছনে ‘ব্লকেজ’ থাকায় সেটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন-আমিষ আমি, নিরামিষও আমি, খাবার গড়ে না আমার পরিচয়
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত : সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচতে প্রতীক ও প্রসূন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে ঠিক হয়, তারা দু’জনে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু মৃত্যুর পর দু’জনের স্ত্রীকে পাওনাদারদের হাতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে, এই বুঝে দু’জনেই তাদের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে। তাঁরাও জানান, স্বামীর পথেই তাঁরা আত্মহত্যা করবেন। এবার চারজনে আত্মহত্যার প্লটের কথা ছেলে আর মেয়েকে জানায় এবং তাদের মামাবাড়ি চলে যেতে বলে। কিন্তু তারা রাজি হয় না। তারাও আত্মহত্যার জেদ ধরে। এরপর রবিবার রাতে ৬ জনে মিলেই শেষবারের মতো সেলিব্রেট করে। সিদ্ধান্ত হয় একসঙ্গে শেষ করবে জীবন।
মৃত্যুবিষ : সিদ্ধান্ত হয় পায়েসের সঙ্গে বিষ খেয়ে তারা আত্মহত্যা করবে। সেই মতো রাতে খাওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হয়, বিষ পায়েস খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘরের ৪ জনের জ্ঞান ফিরে আসে। ফেরে না শুধু মেয়ের। বিষে মৃত্যু হয় মেয়ের। এতে আরও মরিয়া হয়ে দুই ভাই দুই স্ত্রীকে মারতে ব্লেডের সাহায্য নেয়। গলা-হাতের শিরা ব্লেড দিয়ে কাটা হয়। তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে দুই ভাই বেরোয়। সিদ্ধান্ত হয়, মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে আত্মহত্যা করবে। এই সময় ছেলেকে মামাবাড়ি চলে যেতে বলা হয়। ছেলে ওই মৃত্যু, রক্ত দেখে এতটাই ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে যে প্রথমে মামাবাড়ি যেতে রাজি হয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেও মত বদলে জানায় তাদের সঙ্গে সেও মরতে চায়।
আরও পড়ুন-ডেরেকের প্রশ্নে দিশাহারা কেন্দ্র
প্রশ্ন : বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে প্রতীক-প্রসূন বেরয় রাত ১২.৩০টা নাগাদ। অভিষিক্তার কাছে দুর্ঘটনা ঘটে ৩.৩০ মিনিট নাগাদ। প্রশ্ন, এতক্ষণ কোথায় ছিল তারা, কীই-বা করছিল? রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের কাছে ধরা পড়ার ঘটনার কথাও শোনা যাচ্ছে। যদি আত্মহত্যাই উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে বাড়ির সিসিটিভির তার কেন খুলে রাখা হয়েছিল? বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অষ্পষ্ট। জেরাতেই তা স্পষ্ট হবে।
আত্মহত্যা করব : বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রতীক-প্রসূন আর তার ছেলেকে এনআরএসে নিয়ে আসা হয়েছে শনিবার। যেহেতু তাদের হয়ে বিল দেওয়ার কেউ নেই, তাই পুলিশ বাধ্য হয়ে তাদের সরিয়ে এনেছে সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু পুলিশ সতর্ক। কারণ, দুই ভাই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, তাদের বাঁচানো ভুল হয়েছে। তারা ফের আত্মহত্যাই করবে। তাই কড়া পাহারা, মনিটরিং, সতর্কতা। কিন্তু পুলিশ মানবিক দিক দিয়ে ভাবতে গিয়ে দোটানায়। কারণ এটিকে আত্মহত্যার বিরলতম প্লটের ঘটনা মনে করা হলেও, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে খুনের মামলাই দিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে এটাও স্পষ্ট, দুই ভাইয়ের বয়ানে অসঙ্গতি থাকলেও বহিরাগতের হাতে খুনের সম্ভাবনার কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি।