পাকিস্তানি গোলা পড়েও ফাটেনি, মরুসীমান্তে মায়ের নিত্যপুজো তানোট মন্দির দেখে আসার কাহিনি
‘বর্ডার’ সিনেমাটি মনে আছে? ভারত-পাক যুদ্ধ। সানি দেওলদের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনার লড়াই এবং জয়। সেই সিনেমারই একটি দৃশ্য। সীমান্তের ভারতীয় গ্রামে হঠাৎ পাকিস্তানি গোলাবর্ষণ। সেনারা গ্রামবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরাচ্ছে। বাড়িঘর ভাঙছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সব ভাঙলেও ভাঙছে না মা দুর্গার মন্দিরটি। পরপর গোলা এসেছে পড়ছে। কিন্তু ফাটছে না। মন্দির এবং মাতৃপ্রতিমা অক্ষত।
অবিশ্বাস্য, কিন্তু বাস্তব।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানি গোলা পড়েও ফাটেনি, মরুসীমান্তে মায়ের নিত্যপুজো
আপনার মনে হতেই পারে, কল্পিত গল্প। কিন্তু, তা নয়। যে কোনও কারণেই হোক, এই ঘটনা ঘটেছিল। সেই মন্দির আজও রয়েছে। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনী দখল নিয়েছে মন্দিরের। নিত্যপুজো চলছে।
এই মন্দিরের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের টানে এবং খানিকটা সত্যমিথ্যার যাচাই করার তাগিদেই বছর কয়েক আগে তানোটসফর।
রাজস্থানে জয়ন্তী থেকে পশ্চিমে নিখাদ মরুভূমির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘযাত্রার পর একেবারে পাকিস্তান সীমান্তে তানোট। ছোট্ট মরুগ্রাম। সেখানেই মন্দির। আগে গ্রামের মধ্যেই ছিল মন্দির। এখন গ্রাম সরে গিয়েছে একটু দূরে। বিএসএফ শিবিরের গণ্ডির মধ্যেই পড়ে গিয়েছে মন্দির। নিত্যপুজো হয় বিএসএফের তত্ত্বাবধানেই।
আমি তখন ‘আজকাল’ কাগজে। সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক অধুনাপ্রয়াত রনি রায়, আরেক অদম্য উৎসাহী।
তানোট একেবারে প্রত্যন্ত প্রান্ত। ওই সামনে পাকিস্তান। এপাশে শিবির এবং মন্দির। ওপাশে বালির পাহাড়ের উপর ছোট্ট গ্রাম। ইটের ঘর, গরিব শ্রমজীবীর বাস, রোগা উট বাঁধা। আমাদের দেখে আড়াল থেকে কৌতূহলী চোখ । কথা বাড়াতে খাটিয়ায় বসে জল চাইলাম। জল এল।
যা শুনলাম, তার সঙ্গে ‘বর্ডার’ সিনেমার দৃশ্যের কোনও তফাত নেই।
এবং মন্দিরের মধ্যে গিয়ে চমকে যাওয়ার জোগাড়। মায়ের মূর্তি। আর পাশে, কাচের আলমারিতে প্রদর্শনীর মতো রাখা সেইসব গোলা, যেগুলি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দিক থেকে এসে পড়েছিল। কিন্তু ফাটেনি। এখন সযত্নে সাজিয়ে রাখা। এখানকার বিশ্বাস, দেবীশক্তির মাহাত্ম্যে গোলা ফাটেনি। কেউ বিশ্বাস করতে পারেন। কেউ বিশ্বাস না করতেও পারেন। কিন্তু ঘটনা হল গোলা পড়েছে পরপর। গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু মন্দিরের ক্ষতি হয়নি। গোলা এসে পড়েছে। ফাটেনি। পাকিস্তানের কামান, ট্যাঙ্ক সব ব্যর্থ এই চত্বরে।
আরও পড়ুন-কালের গহ্বরে বিলীন হল নেতাজির স্মৃতিধন্য পুজো
পুজো দেখলাম। পূজারিও বিএসএফ কর্মী।
‘দুর্গামাতা’ বলেই চিহ্নিত করেন বিএসএফ কর্মীরা। তবে আমাদের পরিচিত রূপ নয় দেবীর। একটু অন্য ঘরানা। এখানে স্থানীয় নাম তানোট মাতা।
গ্রামবাসীদের মুখে মুখে এখানে এই দুর্গার উৎস অদ্ভুত কাহিনিতে মোড়া। একান্ন সতীপীঠের একটি হল হিংলাজ। মরুতীর্থ হিংলাজ। এখন ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানে। এই তানোট মাতাকে অনেকে হিংলাজমাতার অবতার বলেন। কথিত, ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের রক্ষা করেছিলেন মা। ২০০০ পাকিস্তানি সেনা ও ট্যাঙ্ককে সেদিন মাত্র ১২০ জন ভারতীয় সেনার কাছে হেরে ফিরতে হয়েছিল। আমাদের দিকে শহিদ অনেকে। তবু পাকসেনা আর এগোতে পারেনি।
১৯৬৫ সালেও এই অঞ্চলে পাকিস্তান উৎপাত করেছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের আশ্চর্যজনক ঘটনা তানোটকে পরিচিতি দিয়েছে আরও বেশি। ভারতীয় সেনা যখন পূর্ব পাকিস্তান মানে এখনকার বাংলাদেশে পাকসেনাকে দুরমুশ করতে এগোচ্ছে, তখন পাকিস্তান মরিয়া হয়ে ভারতকে দু’দিকে ব্যস্ত রাখতে পশ্চিম সীমান্তেও আক্রমণ চালায়। কিন্তু ১৯৬৫-র মতো সাদেওয়ালার দিক থেকে না ঢুকে তারা এবার তানোট মন্দিরের কাছে লঙ্গেওয়ালা পোস্ট টার্গেট করে। তার দায়িত্বে ছিলেন মেজর কুলদীপ সিং চাঁদপুরীর নেতৃত্বে মাত্র ১২০ জন জওয়ান। ৪ ডিসেম্বর পূর্ণশক্তিতে আক্রমণ করে পাকিস্তান। রাতভর যুদ্ধ হয়। কিন্তু পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। দেখা যায় মন্দিরে পড়ে রয়েছে গোলা, বোমা। একটিও ফাটেনি। অথচ চারপাশের এলাকা চুরমার। সেসময় অন্তত ৩,০০০ গোলা ছুড়েছিল পাক সেনারা। সেই রাতের যুদ্ধজয় ভারতীয় সেনার ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
এই ঘটনার পর তানোট মাতার মহিমা আরও ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনা মন্দিরের পাশে একটি স্মারক স্তম্ভ তৈরি করে দেয়। তারপর সীমান্তরক্ষী বাহিনী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পুজোর দায়িত্ব নেয়। এলাকায় অনেকে মা দুর্গার এই রূপকে কারনি মাতাও বলেন। মায়ের রূপ ও নাম নিয়ে আরও নানা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু মোটের উপর ওই দুর্গা মা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে জওয়ানরা পোস্টিং-এ আসেন। তাঁদের সকাল-সন্ধে প্রণাম মা দুর্গাকেই। পাকিস্তানে গিয়ে হিংলাজমাতাকে প্রণাম করা এখন কঠিন। তাই তাঁর অবতার বা অনুরূপ সংস্করণকে প্রণাম করতে যান বহু মানুষও। তবে বিএস এফ শিবিরের সময় ও নিয়ম মানতে হয়। এখানে শহর থেকে জওয়ানদের সামগ্রীর সঙ্গে পুজোর নানা সামগ্রীও নিয়মিত আসে।
এখানকার গ্রামবাসী এবং পোস্টের জওয়ানদের বিশ্বাস, ১৯৭১ সালে যেমন অসুরদের বধ করেছিলেন মা দুর্গা, তেমনই তিনিই সারা বছর অশুভ শক্তি থেকে আগলে রাখেন।
এমন কথাও রটে আছে যে সীমান্তের ওপারেও তানোট মাতার মাহাত্ম্যের কথা রটে আছে
বলেই চারপাশের একাধিক জায়গায় কারণে বা অকারণে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণের সমর্থিত বা অসমর্থিত খবর এলেও তানোটের ত্রিসীমানায় কোনও পাকিস্তানি তৎপরতা এখনও পর্যন্ত আর দেখা যায়নি।
মন্দির চত্বর ঘুরে দেখেছি।
আরও পড়ুন-গাজিয়াবাদের পুজোর থিমে এবার এক টুকরো গ্রামবাংলা
মায়ের প্রতিমার একটু ওপাশেই সেই না ফাটা গোলার সারি রাখা। দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের গণ্ডি টপকে সেই অনুভূতি।
একটু ওপাশে এখন হেলিপ্যাড হয়েছে। লাগোয়া কপ্টার নামে। বালির পাহাড়ের উপর থেকে তানোট গ্রাম অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার বদলে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। প্রবীণ দু’একজন মনে করার চেষ্টা করেন সেই সময়টার কথা। দুপুর থেকে পাক গোলা শুরু। ভারতীয় সেনা সরাচ্ছে গ্রামবাসীদের। ছোট ছোট ঘর ভেঙে যাচ্ছে। প্রবল শব্দ। ছোটাছুটি। সন্ধের পর থেকে পুরো যুদ্ধ। কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে টিকে থাকা। সকালে যখন বোঝা গেল পাকিস্তান ফিরে গিয়েছে, চারপাশ ধ্বংসস্তূপ, মৃতদেহের সারি, বিধ্বস্ত পাক ট্যাঙ্কের কঙ্কাল, আকাশে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের চক্কর, তখন দেখা গেল মন্দির অটুট। পড়ে রয়েছে একগাদা না ফাটা গোলা।
মরুগ্রামে বালির পাহাড়ের উপর দাঁড়ালে এক বিচিত্র ল্যান্ডস্কেপ।
এপাশে ভারত। ওই ওপাশে পাকিস্তান। আর এর মধ্যেই জেগে রয়েছে মায়ের মন্দির।
পড়ন্ত বিকেলে সন্ধের মুখে রোজ ঘণ্টাধ্বনি।
মা দুর্গার পুজো চলে। নিত্যপুজো।