রূপা মজুমদার : মানিকতলা মোড় থেকে দক্ষিণে একটু এগিয়েই বাঁদিকে চোখে পড়বে গাছপালায় ঢাকা খ্রিস্টান সিমেট্রির গেট। রংচটা গোলাপি দেওয়ালের গায়ে খোদাই করে লেখা : ‘মানিকতলা খ্রীষ্টান সিমেট্রি’। ভেতরে ঢুকে কিছুকাল আগেও অবাক হতে হত— এ তো কোনও কবরখানা নয়, এ তো ছোটখাটো জঙ্গল! এখন অবশ্য খানিকটা পরিষ্কার করা হয়েছে।
বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর চোখে পড়বে দত্ত পরিবারের কবর : তরু দত্ত, অরু দত্তর কবর— অনাদরে, অবহেলায় শায়িত দুই বোন। অথচ উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকায় যে নামগুলি আছে তাঁদের সঙ্গে একই পঙ্ক্তিতে রাখা উচিত তরু দত্তর নাম। পরিতাপের বিষয়, বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া এই ক্ষণজন্মা, প্রতিভাশালী মহিলা কবির কবরের ওপর পাথরের স্মৃতিফলকটি অযত্নে প্রায় মাটিতে মিশে যেতে বসেছিল।
অধ্যাপক চিন্ময় গুহর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ গ্রন্থ তরু দত্তের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় আমাদের। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্নর নেতৃত্বে ও উদ্যোগে মানিকতলা সিমেট্রিতে তরু দত্ত নামাঙ্কিত স্মৃতিফলক বসানোর কাজটি সম্পন্ন হয় ১১ অক্টোবর, ষষ্ঠীর দিন। ফলক উন্মোচন করেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। উপস্থিত ছিলেন শুভাপ্রসন্ন-সহ কমিশনের সদস্যবৃন্দ, ডাঃ শান্তনু সেন, দত্ত পরিবারবর্গ, অধ্যাপক চিন্ময় গুহ, ‘পুরোনো কলকাতার গল্প’ নামে ফেসবুক পেজের স্বর্ণালী চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত সেন ও অন্য সদস্যরা। ফলকটি লিখেছেন বিশিষ্ট ফরাসিবিদ চিন্ময় গুহ।
আরও পড়ুন : ক্যানসার চিকিৎসায় আলোর দিশারি ন্যানোটেকনোলজি
তরুলতা দত্তের পরিবার ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, উইলিয়াম কেরি প্রমুখ তৎকালীন খ্রিস্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকদের সংস্পর্শে এসে ১৮৬২ সালে সপরিবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে যে গির্জা, সেখানেই তাঁদের ধর্মান্তরণ ঘটেছিল। অরু ও তরু দত্ত— এ দুই বাঙালি কন্যার নাম ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে একসময় একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হত, অনেকটা ইংরেজি সাহিত্যের ব্রন্টি বোনদ্বয়ের মতো। দুই পিঠোপিঠি বয়সের বোন অরু ও তরু ছিলেন, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’র লেখক, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের বড়ভাই, কবি ও ভাষাবিদ গোবিন্দচন্দ্র দত্তের কন্যা। মা ক্ষেত্রমণি দত্ত। গোবিন্দবাবুর এক পুত্র ও দুই কন্যার সকলেই স্বল্পায়ু ছিলেন। অরু ও তরু দুই বোনের মধ্যে কবি-কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতিটা ছোটবোন তরুরই একটু বেশি ছিল।
একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যুর পর তরুর বাবা ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৬৯ সালে ফ্রান্সে আসেন, তরু এবং অরুকে ভর্তি করেন দক্ষিণ ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে। সেখানে দুই বোন ফরাসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শুরু হয় দু’জনের কবিতা লেখা। দুই বোন ফরাসি এবং ইংরেজিতে লিখতে পারতেন মাতৃভাষার মতো। ১৮৭১ সালে তাঁরা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে শুরু ইংরেজি ভাষার চর্চা। ১৮৭৩ সালে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন মূলত ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে।
বড় বোন অরু দত্ত বেঁচে ছিলেন মাত্র ২০টি বছর। ১৮৭৪ সালের ২৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। অনেক সমালোচকের মতে অকালপ্রয়াত অরুর কবিতা অনেকক্ষেত্রে তরুর চেয়েও সরস। তরু দত্ত বোনের মৃত্যুতে ভীষণ আঘাত পান, কারণ সর্বদা দুই বোন মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। দু’জনে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার বেশ কিছু কবিতা তরু লিখেছেন, অরু অলংকরণ করেছেন।
অসম্ভব প্রতিভাময়ী তরু দত্তর মৃত্যু হয় ৩০ আগস্ট, ১৮৭৭। মাত্র ২১ বছর বয়সে। জীবনের অধিকাংশ সময় ইউরোপে কাটালেও তরুর অন্তরে গভীর ভালোবাসা ছিল দেশের প্রকৃতি, গাছপালা, পুরাণ, মহাকাব্যের ওপর। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটি ‘Our Casurina Tree’। আরও একটি বিখ্যাত কবিতা ‘Lotus’। তরু দত্তের লেখায় মানবজীবনের সমস্যা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতও ছুঁয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। তৈরি হয়েছে সাবিত্রী, একলব্য, সীতা। মৃত্যুর এক বছর আগে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর ১৬৫টি কবিতার সংকলন ‘এ শিফ গ্রিন্ড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ডস’ (ফরাসি খেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের প্রতি ভালোবাসায় নিজ ব্যয়ে কবিতা সংকলনটি প্রকাশ করেন ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে। এর মধ্যে চারটি কবিতা দিদি অরু দত্তের অনুবাদ। ১৮৭৭ সালে সমালোচক এডমন্ড গজ এটি পড়েন এবং ভূয়সী প্রশংসা করে রিভিউ প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বইটির আরও সংস্করণ বের হয়। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নেওয়া ‘অ্যানশিয়েন্ট ব্যালাডস অ্যান্ড লিজেন্ডস অব হিন্দুস্তান’ তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়।
আরও পড়ুন : পুজোর পরে এভাবেই ফিরুন অনিয়ম থেকে নিয়মে
মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ফরাসি ভাষায় ডায়েরির আকারে লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জি’। এটি কোনও ভারতীয় লেখকের ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি অনুবাদ করে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, বহু বছর পর ১৯৫৬ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘বিয়াংকা অর দা ইয়াং স্প্যানিশ মেইডেন’ প্রথম ভারতীয় মহিলা লেখিকার ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস। ‘চিঠির সঙ্গে তরুলতা গাছের পাতা ও একটা ছোট ফুল পাঠালাম।’ —১২, মানিকতলা স্ট্রিটের বাড়িতে বসে ইংরেজিতে চিঠিটি লিখেছিলেন ১৮ বছরের তরুণী। আরও একটি চিঠিতে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে ওই তরুণী লিখেছিলেন, ‘হয়তো কোনও একদিন ফিরব। হয়তো আর কোনওদিনই ফেরা হবে না!’ তখন কে জানত, বিভিন্ন সময়ে লেখা চিঠিগুলোই একসময় অমূল্য সম্পদ হয়ে যাবে। মিস মেরি মার্টিন আর ক্লারিস বাদেরকে লেখা তরুর ইংরেজি ও ফরাসি চিঠিগুলি ঐতিহাসিক সম্পদ।
তরু দত্তের চিঠির সংকলনও প্রকাশ পায়। চিঠিগুলো থেকে তৎকালীন জীবনযাত্রা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবচেতনা, তাঁর ভাবনা জানা যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর লেখনীতে। মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও এক হাতে ফরাসি অন্য হাতে ইংরেজি সাহিত্যকে ছুঁয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসি কোমলতা ও ইংরেজি আভিজাত্য— এই তিন নিয়েই তরু দত্ত।
তরুর মৃত্যুর পর কলকাতার বাস উঠিয়ে যে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান গোবিন্দচন্দ্র দত্ত, সে বাড়ি কেনেন জনৈক বসু পরিবার। সেই বিশাল বাড়ি, ক্যাসুরিনা গাছওয়ালা সেই বাগান আজ ১২এ বি ও সি তিনটি আলাদা নম্বরে বিভক্ত। রমেশ দত্তের বাড়ি প্রোমোটারের হাতে পড়ে এখন মধ্যবিত্তের বাক্সবাড়ি। ১২বি ও ১২সি-র বাসিন্দা এ বাড়ি হেরিটেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েও পরবর্তীকালে নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। ১২এ অংশের মালিকানা দেবকুমার বসু এবং তাঁর স্ত্রী শোভাবাজার রাজপরিবারের কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর। দত্ত পরিবারের ব্যবহৃত কাঠের সিঁড়িটি তাঁরা রেখে দিয়েছেন অবিকল।
ফরাসি ও ইংরেজিতে তাঁর ব্যুৎপত্তি রীতিমতো বিস্ময়ের, বলছেন গবেষকেরা! মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য বাঙালি হিসেবে অগ্রণী পুরুষ হন, তা হলে মেয়েদের মধ্যে ছিলেন তরু। কিন্তু এত গুণে গুণান্বিতা হয়েও কেন তিনি উপেক্ষিতা? কেনই বা উনিশ শতকের বরণীয় সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় না? নারীশক্তির আরাধনার আবহে দেবীর বোধনের দিনে ‘বাংলার কিটস’— উপমহাদেশের বিস্মৃতপ্রায় প্রথম ফরাসি ও ইংরেজি নারী-কবি-ঔপন্যাসিকের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের এই শ্রদ্ধা নিবেদনে অংশভাগী হতে পেরে এক বাঙালি নারী হিসেবে আমি গর্বিত। ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মায় প্রয়াত তরু দত্ত ২০২১ সালে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য দেখলে আনন্দিত হতেন।