ভারতবর্ষ হল ঋষি–মুনি, গুরুদের দেশ। যেখানে তাঁদের ঈশ্বরতুল্য জ্ঞানে মানা হয়।
গুরু হলেন এমন এক সত্তা যিনি শিষ্যের জীবনে আলোর পথ দেখান। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁকে স্মরণ, মনন করলে শান্তি ও রক্ষা পাওয়া যায়, এমনটাই বিশ্বাস সেই সুপ্রাচীনকাল ধরে।
গুরু আমাদের মনের সমস্ত সংশয়, দ্বিধা, হতাশা, ক্রোধ, সন্দেহ দূর করে নতুন পথের দিশা দেখান। গুরু শিষ্যের অন্তর্দৃষ্টিকে উসকে দেন। গুরু তাঁর কার্যক্রমে, তাঁর বলিষ্ঠতায়, তাঁর স্বকীয়তায় পারদর্শিতায় একজন শিষ্যকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য— এই ছয় রিপুকে জয় করেছেন, তিনি আধ্যাত্মিকতার বিমল পথ অবগত করেছেন। যিনি নিষ্কপটভাবে ইন্দ্রিয় দমন করতে পারেন, যিনি সত্যবাদী, সর্বদা ধর্মের পথে চলেন, যিনি স্থির, মন-পবিত্র, যিনি আত্মদর্শন করেছেন তিনিই গুরু।
গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকে গুরুপূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই পুণ্যদিনে গুরুবন্দনা করলে অক্ষয় আশীর্বাদ মেলে।
আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় গুরুপূর্ণিমা।
অনেকে বলেন গুরুপূর্ণিমা হল একটি বৈদিক প্রথা।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে গুরু সাত প্রকার।
সূচক গুরু— যিনি আমাদের স্কুল ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় শেখান।
পাঠকগুরু— যিনি বক্তৃতা করেন এবং নির্দেশ দেন ঈশ্বরকে।
বৌধক গুরু— যিনি আপনাকে আধ্যাত্মবাদ এবং প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা দেন।
নিশিধ গুরু— যারা আপনাকে অন্যদের ক্ষতি করার জন্য কালো তন্ত্রের কৌশল শেখায়।
জ্ঞানী ব্যক্তিরা এই ধরনের গুরুকে এড়িয়ে যান।
কর্মক্ষা গুরু— যিনি আপনাকে বাকিগুলি ছেড়ে তপস্বী হতে উৎসাহিত করেন।
পরম গুরু— যিনি সত্যি পথের মাধ্যমে আপনার ভয় দূর করেন এবং আপনাকে জীবন ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।
পূর্বজন্মের পুণ্যের কারণে কেউ পরম গুরু লাভ করে অন্যথায় নয়।
এছাড়াও গুরু শব্দটি সাধারণভাবে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন—
শিক্ষক, প্রশিক্ষক (আচার্য) বিশেষজ্ঞ (সন্ন্যাসী, সাধু, মুনি) আধ্যাত্মিক তপস্বী, যোগী, অতীন্দ্রবাদী এবং পুরোহিত।
আচ্ছা এবার আসি, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে বিখ্যাত গুরু-শিষ্যের কথায়।
অবশ্য গুরুর কথা মানেই গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি ও শিয্যের প্রতি গুরুর নানা গুরুতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলেই আসবে।
সেকালে গুরুরা প্রতিনিয়ত শিষ্যদের কঠিন কঠোর পরীক্ষা নিতেন। সাফল্যের সঙ্গে সেই পরীক্ষা উৎরোতে পারলেই মিলত গুরুর প্রাণভরা আশীর্বাদ। তবে সব সময় যে আশীর্বাদ মিলত তা নয়। কখনও কখনও মিলিত ভয়ানক অভিশাপ। কেমন ছিল পুরাকালের গুরুর শিষ্যের প্রতি আশীর্বাদ ও অভিশাপের কাহিনি?
পুরাকালে আয়োদধৌম্য নামক এক ঋষির শিষ্যদের গুরুভক্তির কারণে গুরু এবং শিয্য উভয়েই খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
কেমন ছিল সেই গুরুভক্তি আর গুরুর নির্মম, কঠিন কঠোর পরীক্ষা?
উপমন্যু ছিল আয়োদধৌম্য ঋষির শিষ্য। গুরুর নির্দেশে আশ্রমের গরু চরাত সে।
গুরুগৃহ থেকে খাদ্য না পাওয়ার কারণে ভিক্ষাবৃত্তি করেই সে জীবিকা নির্বাহ করত। এদিকে, সেই ভিক্ষান্ন খেয়ে দিনদিন উপমন্যু হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে দেখে একদিন গুরু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সে খাদ্য কোথা থেকে পাচ্ছে? উত্তরে অত্যন্ত বিনয় সহকারে উপমন্যু তার ভিক্ষাবৃত্তির কথা জানাল। শুনে গুরুদেব তাকে বললেন গুরুকে নিবেদন না করে ভিক্ষান্ন ভোজন একেবারেই অনুচিত।
গুরুর আদেশ মাথায় নিয়ে এরপর থেকে উপমন্যু ভিক্ষার সমস্ত সামগ্রীগুলোকে দান করতেন গুরুকে। গুরু ভিক্ষালব্ধ সবকিছু আত্মসাৎ করতেন এবং উপমন্যুকে কিছুই দিতেন না। এরপরেও উপমন্যুর চমৎকার চেহারা দেখে গুরু পুনরায় তার খাদ্য গ্রহণের বিষয় জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তরে জানাল যে, প্রথম ভিক্ষার সমস্ত দ্রব্য গুরুকে প্রদানের পর ক্ষুন্নিনিবৃত্তির জন্য সে দ্বিতীয়বার ভিক্ষা করে। এবার গুরু তাকে দ্বিতীয়বার ভিক্ষা করতে নিষেধ করে বললেন, এতে লোভ বৃদ্ধি পায় এবং অন্য ভিক্ষুকদের ক্ষতিও হয়। এরপর অত্যন্ত বিচলিত হয়ে, ক্ষমাপ্রার্থনা করে শিয্য উপমন্যু একবারই ভিক্ষা করতেন এবং পুরোটাই গুরুকে দিয়ে দিতেন।
এতেও উপমন্যুর চেহারার কোনও পরিবর্তন না দেখে গুরু পুনরায় এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলেন যে, সে আশ্রমের গরুর দুধ খেয়ে থাকে। গুরু এবার বললেন বিনা অনুমতিতে আশ্রমের গরুর দুধ খাওয়া অত্যন্ত অন্যায়।
এরপরও শিষ্যের স্বাস্থ্যবান চেহারা দেখে গুরু আবার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন উপমন্যু আশ্রমের গরুর দুধ, তাদের বাছুরের খাওয়ার পর তাদের মুখের ফেনা থেকে খিদে মেটায়। গুরু এবার বললেন যে উপমন্যুর জন্য বাছুরেরা দয়াবশত প্রচুর ফেনা উৎপন্ন করে। ফলে তাদের পুষ্টিতে ব্যাঘাত হয়।
এরপর উপমন্যু বেশ কিছুদিন অভুক্ত রইল এবং বনে বনে ঘুরতে লাগল। কিন্তু শেষমেশ খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আকন্দ গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়ে নেয়। তবু গুরুর আদেশ অমান্য করে না।
আকন্দের বিষে তার চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায়। অন্ধ হয়ে আশ্রমের পথে ফিরতে গিয়ে সে কূপে পড়ে যায়।
এদিকে, উপমন্যুর আশ্রমে ফিরতে দেরি হওয়ায় গুরু তাকে খুঁজতে খুঁজতে কূপের মধ্যে দেখতে পেলেন। এবং তার কাছ থেকে কুপে পড়ার প্রকৃত কারণ জানতে পারলেন। এবার গুরু তাকে দৈবচিকিৎসক অশ্বিনী কুমারদ্বয়কে আহ্বান করতে বলে চলে গেলেন। উপমন্যুর ডাকে দেব চিকিৎসকদ্বয় উপস্থিত হয়ে তাকে খাবার জন্য একটি পিঠে দিলেন।
(এরপর ১৮ পাতায়)
(১৭ পাতার পর)
কিন্তু উপমন্যুর এতই গুরুভক্তি যে, তিনি এই পিঠে গুরুকে না দিয়ে গ্রহণ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন।
অশ্বিনী কুমারদ্বয় এরকম গুরুভক্তি দেখে মুগ্ধ হলেন। এবং তাঁকে বর দিলেন এই বলে যে, ‘তোমার গুরুর দাঁত কালো লোহার মতো হবে পক্ষান্তরে তোমার দাঁত সোনার হবে এবং তোমার অন্ধত্বও দূর হয়ে যাবে।’
দৃষ্টিশক্তি লাভ করে ফিরে গুরুর কাছে সব বললেন। গুরু উপমন্যুর শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখে মোহিত হলেন। এবং সমস্ত বেদ, ধর্ম, শক্তি, দান ও আশীর্বাদ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
উপমন্যুর গুরুভক্তি আজও দৃষ্টান্তস্বরূপ।
এবার আসি আয়ুদধৌম্যের আরেক শিষ্য আরুণীর কথায়।
সেযুগে শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে বাস করে বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করার একটা রীতি ছিল। আরুণী তাঁর গুরুর কাছে শিক্ষাগ্রহণে গিয়েছিল।
তখন বর্ষাকাল। প্রচুর জলের তোড়ে ঋষির জমির আল ভেঙে গিয়েছিল। তখন তিনি শিষ্য আরুণীকে ডেকে আল বেঁধে আসার নির্দেশ দিলেন। গুরুর আজ্ঞা পালনের জন্য আল মেরামতের জন্য ভিজতে ভিজতে মাঠে পৌঁছাল সে। কিন্তু জলের তীব্র বেগের কারণে কিছুতেই আল বাঁধতে পারছিল না।
এদিকে, আল বাঁধতে না পারলে তা গুরুর আদেশ অমান্য করা হবে ভেবে শেষমেশ আরুণী নিজেই ভাঙা আলের গায়ে শুয়ে পড়ে জলের গতি রোধ করলেন।
এদিকে, সন্ধে হয়ে আসছে দেখে গুরু তাঁকে খুঁজতে বেরোলেন। খুঁজতে খুঁজতে গুরু দেখলেন ওই বর্ষায়, বৃষ্টিতে ভিজে গুরু আজ্ঞা পালনের জন্য আল পথের ওপরে শিয্য শুয়ে রয়েছেন।
নিজের শিষ্যের এমন অতুলনীয় কর্মনিষ্ঠা ও গুরুভক্তি দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল গুরুর সৌম্যমুখমণ্ডল। তিনি বললেন, ‘হে আরুণী তুমি কেদারখণ্ড বিতরণ করে উঠে এসেছ।’
তাই আজ থেকে তোমার নাম হবে উদ্দালক। আর আমার আজ্ঞা অতি-শ্রদ্ধাভরে পালন করেছ সেই জন্য সমস্ত বেদ, ধর্মশাস্ত্র তোমার অন্তরে প্রকাশিত থাকবে। কেদারখণ্ড অর্থাৎ জমির আল ভেদ করে ওঠার জন্য আরুণীর নতুন নাম হল উদ্দালক। পরবর্তীকালে এই অরুণী তথা উদ্দালক হয়ে ওঠেন একজন মহাজ্ঞানী ও বেদজ্ঞ ঋষি। কালের পরিক্রমায় তাঁর আশ্রমও ভরে ওঠে শিষ্যদের উপস্থিতিতে।
গুরুদেবের আশীর্বাদ-এর কাহিনি তো আমরা শুনলাম। এবার আসি ভয়ঙ্কর ক্রোধী গুরুদের কথায়।
পৌরাণিক যুগে বিন্ধ্যপর্বত সমস্ত পর্বতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মাননীয় ছিল। সেজন্য তার অহংকারও ছিল। সকলেই জানি যে নারদ মুনি বা দেবর্ষি নারদ চাইতেন সবসময় ঝগড়া বাধাতে। তিনি চুপিচুপি গিয়ে বিন্ধ্যকে বললেন যে সুমেরু পর্বত দাবি করে যে সে বিন্ধ্যর থেকে অনেক বেশি উঁচু। এবং তার সমৃদ্ধি অনেক বেশি। সূর্য সমস্ত নক্ষত্রকে নিয়ে বিন্ধ্যপর্বতে পরিভ্রমণ করেন আর সমস্ত দেবতা সুমেরুতে দিনযাপন করেন। এই কথা শোনার পর বিন্ধ্য সূর্যকে বললেন যে উদয়াস্তকালের সুমেরু পর্বতের মতো করে তাঁকেও প্রদক্ষিণ করতে হবে। সূর্য এতে অসম্মত হলে বিন্ধ্য নিজে দেহকে বর্ধিত করে সূর্যের পথরোধ করে ফেললেন। ফলে সূর্যের উত্তাপে পর্বতের একদিকে জ্বলেপুড়ে যেতে লাগল। অন্যদিকে প্রচণ্ড শীত ও অন্ধকারে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লে, দেবতারা এর প্রতিকারের উপায় না দেখে অগস্ত্য মুনির শরণাপন্ন হলেন। অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্যের গুরু।
অগস্ত্যকে দেখে গুরুভক্তিতে বিন্ধ্য যেই তার মস্তক অবনত করল, অগস্ত্য তাকে বললেন, যে যতক্ষণ তিনি প্রত্যাবর্তন না করবেন ততক্ষণ সেরূপ অবনতমস্তকে থাকবে। বিন্ধ্যকে এই অবস্থায় রেখে অগস্ত্য দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেন এবং কখনওই আর ফিরে আসেননি। আর বিন্ধ্যপর্বত ওইরকম মাথা নিচু করেই রয়ে গেল গুরুর আদেশে।
অগস্ত্য মুনির শক্তি ও পরাক্রমের এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে।
এবার আসি আরেক পরাক্রমশালী ভয়ঙ্কর তেজী ও ক্রোধী মুনির কথায়। তিনি হলেন দুর্বাসা। তাঁর ক্রোধাগ্নি থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং দেবতারাও। সামান্য কারণে তিনি অত্যন্ত রেগে যেতেন এবং অভিশাপ দিতেন। তাঁর সাধনার এমনই তেজ ছিল যে তাঁর প্রদত্ত সমস্ত অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হত।
দুর্বাসা শব্দের অর্থ হল দূর বাস অর্থাৎ যার সাথে বসবাস করা যায় না।
মহৎ, সিদ্ধ এবং দুর্দান্ত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি যেমন একদিকে ছিলেন নন্দিত, অন্যদিকে ভীতি উদ্যোগকারী, অভিশাপ প্রদানকারী এক ঋষি।
পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাসের সময় দুর্বাসা তাঁর দশ হাজার শিষ্যকে নিয়ে পাণ্ডবদের আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হন। এবং খাবার চান। সেইসময় পাণ্ডবদের পর্ণকুটিরে এতজনের অন্ন প্রদানের ব্যবস্থা ছিল না।
মহাঋষি দুর্বাসা অত্যন্ত ক্রোধিত হন এবং অভিশাপ দেয়ার হুমকি দিয়ে শিষ্যদের নিয়ে স্নান করতে চলে যান।
দ্রৌপদী সেই সময় এই সমস্যার কথা শ্রীকৃষ্ণকে জানালে মনে মনে শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বলেন যে, দেখো খাবারের পাত্রে কোনও অন্ন অবশিষ্ট আছে নাকি? দ্রৌপদী দেখলেন যে, একটি অন্নদানা পড়ে রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ সেই দানা খেয়ে পরিতৃপ্তি প্রকাশ করেন। কৃষ্ণের মায়াবী লীলায় দুর্বাসা এবং তাঁর সব শিষ্যের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়ে যায়।
সেযাত্রায় পাণ্ডবরা রক্ষা পান দুর্বার্সার অভিশাপ থেকে শ্রীকৃষ্ণের কৃপায়। দ্রৌপদীকে অন্নপূর্ণা বলে আশীর্বাদ করেছিলেন।
দুর্বাসা একবার দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কী ছিল সেই অভিশাপ?
দুর্বাসা মুনি একদিন ভ্রমণ করছেন। সেই সময়ে অপ্সরা রম্ভা তাঁকে একটি পুষ্পমাল্য উপহার দেন। এরপর পথে ইন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বাহন ঐরাবতে চড়ে বের হয়েছিলেন। ইন্দ্রের রূপ দেখে দুর্বাসা মোহিত হলেন। আশীর্বাদস্বরূপ ইন্দ্রকে উপহার দিলেন ওই পুষ্পমালাটি। দেবরাজ ইন্দ্র সেই মালা হেলাভরে ঐরাবতের মাথায় পরিয়ে দিলে ঐরাবত ওই মালাটি ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। এটি দেখে দুর্বাসা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হয়ে ইন্দ্রকে শ্রীভ্রষ্টের অভিশাপ দেন।
তাঁর এই অভিশাপের ফলে ইন্দ্র ত্রিপুরাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে শ্রীহীন হয়েছিলেন।
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকেও দুর্বাসা মুনি তাঁর অভিশাপ দান থেকে বিরত থাকেননি।
একদিন দুর্বাসা মুনির পায়েস খাওয়ার ইচ্ছা হলে, খাওয়াদাওয়ার পর শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর সর্বাঙ্গে পায়েস লেপন করতে বলেন। কৃষ্ণ দুর্বাসার পায়ের তলা ছাড়া সর্বত্র পায়েস লেপন করেন।
এ-ঘটনায় রুষ্ট হয়ে দুর্বাসা কৃষ্ণকে বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পায়ের তলা ছাড়া সর্বশরীর অভেদ্য হবে।
পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু পায়ের তলায় বাণবিদ্ধ হয়েই মানবশরীর ত্যাগ করেছিলেন।
গুরু-শিষ্যের কাহিনি শেষ করব দ্রোণাচার্য আর একলব্যের কথা দিয়ে।
একলব্য ছেলের নিষাদ রাজার পুত্র। অনার্য হিসেবে নিষাধরা সবসময় ছিল অবহেলিত।
অন্যদিকে, দ্রোণাচার্য ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্র-বিশারদ ধনুর্ধর। তিনি ছিলেন পাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষার গুরু এবং যুদ্ধশিক্ষার সমস্ত জ্ঞান তিনি তাঁদের প্রদান করছিলেন। সেইসময় ভারতবর্ষে দ্রোণাচার্যের চেয়ে বড় কোনও অস্ত্রগুরু ছিল না। অর্জুন ছিলেন আচার্যের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। অর্জুনকে তিনি যে-বিদ্যা শেখাতেন আর কোনও শিষ্যকে তিনি তা দিতেন না। পুত্রসম স্নেহ করতেন দ্রোণাচার্য অর্জুনকে।
অর্জুনের প্রতি তাঁর এই বাৎসল্য একলব্যর জীবনে নিয়ে এসেছিল চরম বিপর্যয়।
দ্রোণাচার্যের শিষ্য হওয়া ছিল একলব্যের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু যখন একলব্য গুরুকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল সে গুরু দ্রোণের শিষ্য হতে চায়। অত্যন্ত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে দ্রোণাচার্য জানিয়েছিলেন কোনও নিচু জাতের হীন বংশের কাউকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারবেন না। বহু বাসনা চির আকাঙ্ক্ষিত দ্রোণাচার্যের মুখে এই কথা শুনে নিষাদপুত্রের মনে খুব ব্যথা লেগেছিল।
একবুক অপ্রাপ্তি নিয়েই মনে মনে তাঁকে গুরু মেনে, তাঁর মূর্তি বানিয়ে, মনে মনে সংকল্প করে নিজেই নিজেকে দীক্ষিত করে তুলতে লাগলেন একলব্য।
গুরুর প্রতি নিষ্ঠা শ্রদ্ধার গুণেই সে নানারকম অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল।
একদিন বনে ঘুরতে এসে গুরু দ্রোণ আর অর্জুন মুখোমুখি হলেন একলব্যর। একলব্য তখন দ্রোণের শিষ্যদের থেকেও বড় যোদ্ধা। একলব্যের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে দ্রোণাচার্য জানতে চেয়েছিল যে তার অস্ত্রগুরু কে?
দ্রোণাচার্যকে তাঁর মূর্তি দেখিয়ে একলব্য বলেন, ‘গুরুদেব আমি এই মূর্তির ভেতর আপনাকে প্রতিষ্ঠা করেছি আর আপনাকেই গুরু মেনে সাধনা করছি। আজকে আমার যে অর্জন তার সব আপনার জন্যই, আপনি আমার গুরু।’
সংশয়ী অর্জুন অত্যন্ত চিন্তায় পড়লেন এবং মনঃক্ষুণ্ণ হলেন যে তার চেয়ে বেশি পারদর্শী ধনুর্বীর যে আর কেউ নেই, আর সে-ই যে গুরু দ্রোণের একমাত্র শিয্য। যাকে গুরু সব বিদ্যাই দিয়েছেন। তাহলে একলব্য এত ভাল অস্ত্রবিদ্যা কীভাবে শিখল! তবে কি গুরুদেব গোপনে একলব্যকে শিয্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন!
প্রিয় শিষ্যের মনের সংশয় ঘোচাতে দ্রোণাচার্য কূট বুদ্ধির আশ্রয় নিলেন। যিনি কিনা কখনও একলব্যকে হাতেকলমকে শিক্ষা দেননি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাড়িয়ে দিয়েছেন গুরু না হয়ে, সেই নিষাদপুত্রের কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন।
তিনি গুরুদক্ষিণা হিসাবে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেয়ে বসলেন। উনি ভালমতো জানতেন তির চালানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় অঙ্গ হচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুল। একজন তিরন্দাজের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়ার অর্থ আক্ষরিকভাবে তাকে হত্যা করার শামিল।
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একলব্য গুরুর এককথায় তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নিজ হাতে কেটে তা গুরুদক্ষিণা হিসেবে দান করেন।
এমনই ছিল সে-সময়ের গুরুর প্রতি শিষ্যের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।