সারা বিশ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরাখবর আজ আমাদের নখদর্পণে, তার সব কৃতিত্বই টেলিভিশন নামক ম্যাজিক বাক্সটির। ‘বোকা বাক্স’ বলে যতই তার বদনাম করা হোক না কেন, এই যন্ত্রটি ছাড়া অচল সবকিছু। রাজনৈতিক তরজা, মিটিং, মিছিল থেকে শুরু করে যুদ্ধ পরিস্থিতির তাজা ফুটেজ, ভাল ভাল সিনেমা, সিরিয়াল, ক্রিকেট ম্যাচ, ফুটবল ম্যাচ—ওই বোকা বাক্সই ভরসা। ১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস দিনটি পালন করা শুরু করে ২১ নভেম্বর।
টেলিভিশন আবিষ্কার
‘টেলিভিশন’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘tele’ অর্থাৎ দূর এবং ল্যাটিন শব্দ ‘vision’ অর্থাৎ দেখা থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘দূরে বসে দেখা’। উনিশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর কৌশল নিয়ে যখন গবেষণা শুরু করলেন। ১৮৬২ সালে তারের মাধ্যমে প্রথম স্থির ছবি পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এরপর ১৮৭৩ সালে বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ, ইলেকট্রনিক সিগন্যালের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের পরে আরও তিন বিজ্ঞানী পল নিপকো, জন লোগি বেয়ার্ড এবং ফিলো টেলর ফার্নসওয়ার্থ এই কাজে নিযুক্ত হন। জার্মান বিজ্ঞানী পল নিপকো ‘Nipkow disk’ নামে একটি যান্ত্রিক ডিভাইস তৈরি করলেন যে ডিভাইসটি একটা ছবিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পাঠাতে সাহায্য করত। এটিই ছিল প্রথম স্ক্যানিং মেকানিজম যা টেলিভিশন আবিষ্কারের প্রথম ধাপ। এরপর স্কটিশ বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড ১৯২৫ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করেন।
লোগি বেয়ার্ডের প্রচেষ্টা
স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার লোগি বেয়ার্ডের জন্ম স্কটল্যান্ডের ১৮৮৮ সালে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন লোগি। এরপর গবেষণায় নিযুক্ত হন। সেই সময় ঠিকঠাক খাবারও জুটত না তাঁর। বাধা সত্ত্বেও প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বেতারে ছবি ধরার কাজ নিয়ে গবেষণা চালাতে থাকেন। একটি ঘরে তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি ছিল ও পাশের ঘরে একটা পর্দা টাঙানো ছিল। একদিন তিনি সেই পর্দায় একটা যন্ত্রের ছবি উঠছে দেখে চমকে উঠলেন।
সেই ছবিটি যে পাশের ঘরে রাখা যন্ত্রের, সে বিষয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। তরুণ বিজ্ঞানী জন লোগি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন আর একটু চেষ্টা করলেই তিনি সফল হবেন। এরপর লন্ডনে এসে এই গবেষণার জন্য বহু লোকের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও সাহায্য পান না। সকলেই তাঁকে পাগল বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু দমবার পাত্র ছিলেন না বেয়ার্ড। একাই চেষ্টা করতে লাগলেন। গোলাকার একটা স্ক্যানিং ডিস্ক, নিয়নবাতি আর একটা ফটো ইলেকট্রিক সেল, এই ছিল তাঁর সম্বল। ঘুর্ণায়মান স্ক্যানিং ডিস্কের অসংখ্য ছিদ্রপথে এসে যে আলোকরশ্মি কোনও বস্তুর ওপর পড়ছে তাকে ফটো ইলেকট্রিক সেলের মাধ্যমে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে সেই তড়িৎ শক্তিকে পুনরায় আলোক ফলিত করে তোলা সম্ভব হল শেষপর্যন্ত। সফল হল বেতারে ছবি পাঠানোর কৌশল। টেলিভিশনের আবিষ্কার হল এভাবেই।
প্রথম টিভির প্রদর্শন
প্রথম যে পরীক্ষাটি বেয়ার্ড দেখিয়েছিলেন তখন দূরত্বটা ছিল কয়েকশো গজ মাত্র। তাঁর পরীক্ষার জায়গা থেকে কিছু দূরে একটি ঘরের মধ্যে দর্শকদের বসিয়েছিলেন। দর্শকদের সামনে ছিল একটা যন্ত্র ও একটা পর্দা। তারপর তিনি পরীক্ষাগারে চলে যান। এক সময় দর্শকরা দেখতে পায় সিনেমার পর্দার মতো সচল মানুষের মূর্তি। ২ অক্টোবর বেয়ার্ড ইতিহাসের প্রথম টিভি নিয়ে হাজির হলেন সবার সামনে। এটাতে প্রতি সেকেন্ডে ১২.৫টা করে ছবি দেখা যেত। অর্থাৎ প্রথমবারের মতো টিভির মাধ্যমে চলমান প্রোগ্রাম দেখানো সম্ভব হল।
টেলিভিশনের জয়যাত্রা
জানা যায় মার্কিন বিজ্ঞানী ফানসওয়র্থ ১৯২৭ সালে বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিভিশন সিস্টেম তৈরি করেন। তিনি ক্যাথোড রে টিউব (CRT) ব্যবহার করে ছবি পাঠানোর কৌশল উদ্ভাবন করেন, যা পরবর্তী সময়ে টেলিভিশন প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।
প্রথম দিককার টেলিভিশনগুলো ছিল যান্ত্রিক। এগুলোতে ঘূর্ণায়মান ডিস্ক ব্যবহার করে ছবিকে স্ক্যান করা হত এবং তা আলোক সংকেতে রূপান্তরিত হত। তবে এটা ছিল খুব ধীর পদ্ধতি। ফার্নসওয়ার্থের তৈরি ইলেকট্রনিক টেলিভিশন সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠে। এতে হাই রেজোলিউশনের ছবি দ্রুত গতিতে পাঠানো সম্ভব হয়।
১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে টেলিভিশনের পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে বিবিসি (BBC) বিশ্বের প্রথম নিয়মিত টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে। টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয় ১৯৪০ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে এবং টেলিভিশন গণমাধ্যম হিসেবে ব্যাপক বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাড়তে থাকে প্রযুক্তিগত উন্নতি
প্রথম দিকের টেলিভিশনগুলো ছিল সাদা-কালো। ১৯৫৩ এর শেষের দিক থেকে NBC ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত রঙিন টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে। ১৯৬০-এর দশকে রঙিন টেলিভিশন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতে টেলিভিশন আসে ১৯৫৯ সালে। ১৯৬২ সালে ‘Telstar’ নামক প্রথম কমার্শিয়াল টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়, যার মাধ্যমে আন্তঃমহাদেশীয় টেলিভিশন সম্প্রচার সম্ভব হয়। এর ফলে টেলিভিশনের ব্যাপ্তি বিশালভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপর আসে কেবল টিভি। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে কেবল টেলিভিশনের মাধ্যমে দর্শকরা বিভিন্ন চ্যানেল দেখতে শুরু করে। ২০০০-এর দশকে টেলিভিশন প্রযুক্তি পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে ওঠে। HD, 4K, Smart TV, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়।
বাক্স কিন্তু বোকা নয়
বোকা বাক্সের বদনাম তার আজও ঘোচেনি। অনেকেরই চক্ষুশূল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোটা বিশ্ব তার হাতের মুঠোয়। কী করে এল টেলিভিশন? সামনেই ‘বিশ্ব টেলিভিশন দিবস’। সেই উপলক্ষে টেলিভিশন আবিষ্কারের গল্প বললেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

