ঊর্ধ্বাকাশে বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুর গতি, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি জানার জন্য বেলুন অবজারভেশন জরুরি। যা অনেকেরই অজানা। এখনও এই বিশুদ্ধ পদ্ধতির বিকল্প তৈরি হয়নি। লিখছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমসফিয়ারিক সায়েন্সের অতিথি অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত
আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর ভূপৃষ্ঠের পর্যবেক্ষণ বা যাকে বলে সারফেস অবজারভেশন, সেটা সম্পর্কে আমরা সবাই কিছু না কিছু জানি। এখানে বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের চাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুর গতি, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি মাপা হয়। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উচ্চতায় অন্তত ৫০ কিমি পর্যন্ত এই সমস্ত তথ্যর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিমাণ ছাড়াও, এইসব তথ্যর বিশেষ করে বিমান চলাচল, নিউমেরিকাল ও আবহাওয়া পূর্বাভাস, মহাকাশযান উৎক্ষেপণ, যুদ্ধের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন- ভোট দিতে গিয়ে মোদির রোড শো! সরব মমতা, কমিশনে আপ-কংগ্রেস
ফ্রান্সে ১৮৯২ সালে (বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে) গুস্তাভ হেরমিতে ও জর্জেস বেসানকোন বেলুনের সাহায্যে মেটিওগ্রাফ ব্যবহার করে প্রথম ঊর্ধ্বাকাশের তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রয়োজন অনুযায়ী নানাভাবে হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুন ব্যবহার হয়। বিমানবন্দরে মেঘের উচ্চতা জানার জন্য সিলোমেটার খারাপ থাকলে এখনও বেলুনের সাহায্যে তা নির্ণয় করা হয়।
পাইলট বেলুন অবজারভেশন ও প্রয়োজনীয়তা : ঊর্ধ্বাকাশে বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুর গতির মান ও দিক জানার জন্য পাইলট বেলুন অবজারভেশন (PBO) নেওয়া হয়। বাস্তুকার স্থির বস্তুর দূরত্ব, উচ্চতা ইত্যাদি নির্ণয় করেন রাস্তা, রেল লাইন ইত্যাদি প্রস্তুত করার জন্য। কিন্তু পাইলট বেলুন অবজারভেশন, অনুভূমিক ও ঊর্ধ্বমুখী গতিসম্পন্ন হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুনের অবস্থান ও সরণ পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন উচ্চতায় বাতাসের গতি নির্ধারণ করে। মাটিতে থেকে যেন আকাশে ভেসে (ইনসিটু) পর্যবেক্ষণ। এই বিশুদ্ধ পদ্ধতির বিকল্প এখনও উদ্ভাবন হয়নি। এটি বিমান, হেলিকপ্টার ও ড্রোন চালনার জন্য খুব প্রয়োজন। সাধারণত ০৬ জিএমটি, ১৮ জিএমটি নিয়মিত এই অবজারভেশন নেওয়া হয়।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই পদ্ধতিতে অনায়াসে ১০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত শুধু মাত্র বায়ুর গতি ও দিক নির্ণয় করা সম্ভব। খরচ খুব কম। আমাদের দেশে ৭০টির মতো অবজারভেটরি থেকে এই অবজারভেশন নেওয়া হয়। প্রয়োজন একটি অপটিক্যাল থিওডোলিত (বিশেষ ধরনের ক্রসওয়্যার যুক্ত টেলিস্কোপ) একটি হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুন (যার ওজন ২৭ গ্রাম থেকে শুরু করে ১৫০ গ্রাম) ও একটি ২৫ মিটার থেকে ১০০ মিটার টেইল (ঘুড়ির কাগজে সুতো লাগিয়ে) দিনের বেলায় বেলুনের সঙ্গে বাঁধতে হয়। থিওডোলিতকে লোকাল উত্তর দিকের সঙ্গে এবং অনভূমিক-এর সামঞ্জস্য করে একটি পিলারের (স্ট্যান্ড) ওপর বসানো হয়। বেলুন ছেড়ে দেওয়ার পর থিওডোলিতে এর সাহায্যে প্রতি মিনিট বাদে বাদে বেলুনের অনভূমিক কোণ, উল্লম্ব কোণ এবং ক্রসওয়্যার সংখ্যা (গ্রতিকুল) লিপিবদ্ধ করা হয়। তার পর ট্রাজেক্টরি মেথডে (যা ক্লাস ১০-১২ ছাত্রদের অংকের হাইটস অ্যান্ড ডিসট্যান্সের মতো) উইন্ড স্পিড ও ডাইরেকশন বের করা হয়। ৬০ মিনিট বেলুন দেখা গেলে, অন্তত ৬০ খানা অঙ্কের সমান। যেটা কমপ্লিট করতে টোটাল ৯০ মিনিটও লাগে না কোনও অবজার্ভারের। বর্তমানে কম্পিউটারে করা হয়। বস্তুত বিমানের ফ্লাইট লেভেল অনুযায়ী বাতাসের গতি রিপোর্ট করা হয়। বিমান ওঠার (টেক-অফ) ও নামার (ল্যান্ড) সময় এই রিপোর্টের ভীষণ প্রয়োজন। বিমানবন্দরে লোকাল থান্ডারস্ট্রম, কুয়াশা, ভিজিবিলিটি ইত্যাদির পূর্বাভাস ও যুদ্ধে আর্টিলারি ফায়ার করতে ভীষণ প্রয়োজন। রাতের বেলায় বেলুনের সঙ্গে মোমবাতি (চাইনিস ল্যান্টেন) লাগিয়ে অবজারভেশন নেওয়া হয়।
রেডিও সন্দে রেডিও উইন্ড (RSRW) অবজারভেশন ও প্রয়োজনীয়তা : যদিও বিজ্ঞানে সর্বশেষ পদ্ধতি বলতে কিছু নেই। পাইলট বেলুন অবজারভেশনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এখানে প্রতিটি বায়ুর স্তরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বায়ুমণ্ডলের চাপ মাপা যায় না। রেডিও সন্দে রেডিও উইন্ড অবজারভেশন (RSRW) প্রতিটি স্তরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, চাপ ও বাতাসের গতি ও মান নির্ণয় করে হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুন ব্যবহার করে। প্রয়োজন একটি রেডিও ট্রান্সমিটার (৪০১ MHz অথবা ১৬৮০ MHz), টেম্পারেচার সেন্সর (থার্মিস্টর) আর্দ্রতা সেন্সর (হাইগ্রিস্টর) ও বায়ুচাপ মাপার বারসুইচ আর একটি রেডিও রিসিভার। সমস্ত তথ্য বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় ভাবে পাওয়া গেলেও, উইন্ড স্পিড ও ডাইরেকশনের কোনও সেন্সর এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তাই, এখানেও কম্পিউটারের সাহায্যে ট্রাজেক্টরি মেথডে ব্যবহার করা হয় উইন্ড স্পিড ও ডাইরেকশন বের করার জন্য। প্রতি মুহূর্তে বেলুনের উচ্চতা বারসুইচ থেকে নেওয়া হয়। এই অবজারভেশন শেষ হতে (বেলুন বার্স্ট) ১২০ মিনিটও লাগতে পারে। ওই সময় বেলুনের উচ্চতা ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার। কোডেড ইনফরমেশন সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি ও ডিজিটালই প্রেরণ হয়ে যায়। ডিকোড করলে ১০০ পাতারও বেশি তথ্য হবে। আধুনিক সুপার কম্পিউটার এই কোডেড তথ্য সরাসরি গ্রহণ করতে পারায় নিউমেরিকাল ওয়েদার প্রেডিকশন স্পিড ও রিসোলিউশন অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে নয়ডাতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (NCMRWF)-এ ওই ধরনের সুপার কম্পিউটার থাকায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনেক উন্নত হয়েছে। উন্নত দেশগুলি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নির্ধারণের জন্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)-এর সঙ্গে যুক্ত করেছে রেডিও সন্দে রেডিও উইন্ড (RSRW) অবজারভেশন। এতে তথ্যের বিশুদ্ধতা অনেক গুণ বৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের দেশেও রেডিও সন্দে রেডিও উইন্ড (RSRW)-কে জিপিএস-এ পরিবর্তন করা হছে। বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত ওজন গ্যাসের উলম্ব উপস্থিতি নির্ণয় করা হচ্ছে বিশেষ কিছু RSRW অবজারভেটরিতে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৫০০টি RSRW অবজারভেটরি আছে। এর মধ্যে আমাদের দেশে ৩৯টি। ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অরগানিসন-এর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন ০০ জিএমটি ও ১২ জিএমটি RSRW পর্যবেক্ষণ করা হয়। একটি RSRW (জিপিএস) (জার্মান)-এর মূল্য প্রায় ১ লক্ষ টাকা। সেন্সর-সহ ট্রান্সমিটার বেলুন ছেড়ে দেওয়ার পর আর ফিরে পাওয়া যায় না। কাজেই সব দিক থেকেই এই তথ্য মহামূল্যবান। বিমানবন্দরের আবহাওয়াবিদেরা (ডিউটি অফিসার) সকালের চা-কফির থেকেও এই তথ্যের খোঁজে বেশি থাকেন পাইলটদের চাহিদা মেটানোর জন্য।
এই সমস্ত উপলব্ধি সত্ত্বেও RSRW অবজারভেশনের কিছু পিছুটান আছে। এখান থেকে এখনও বায়ুমণ্ডলের উলম্বগতি, অনেক বায়ুদূষণকারী গ্যাসের উলম্ব উপস্থিতি যথোপযুক্ত সেন্সরের অভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছে না। না হলে এইসমস্ত তথ্য বায়ুমণ্ডলের অস্থিরতা ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর বিশেষত্ব ও পরিণতি আরও ভাল করে জানা যেত।