মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে মেলবন্ধন ঘটেছে প্রশাসনিক তৎপরতার সঙ্গে জননেত্রীর আন্তরিকতার। নিজের চোখে তার সাক্ষী থাকার বৃত্তান্ত তুলে ধরছেন
মইনুল হাসান
মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে উপস্থিত থাকার অর্থ হচ্ছে এক অনবদ্য ইতিবাচক অভিজ্ঞতা। প্রায় ৫৬৮ টা এমন বৈঠক তিনি করে ফেলেছেন। যে কোনও প্রশাসনিক প্রধানের কাছে এটি একটি ঈর্ষনীয় সংখ্যা। কিন্তু এমন প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্পন্ন যিনি করেছেন তিনি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রোজনামচায় অসম্ভব বলে কিছু নেই।
আরও পড়ুন-বার্সার জার্সিতে মেসির রেকর্ড ভাঙলেন গাভি
কলকাতা থেকে রাজ্যের ভালমন্দ বোঝা যাবে না। জেলায় জেলায় মুখ্যমন্ত্রী যেমন যাবেন, আধিকারিকরাও যাবেন। প্রশাসনের সর্বস্তরের আধিকারিকরা থাকবেন, তেমনই থাকবেন জনপ্রতিনিধিরা। অনেক সমস্যা মুখোমুখি আলোচনা হবে। যে সমস্যা বহুকাল ধরে পড়ে আছে- মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা মিটে যাচ্ছে সামান্য কয়েক মিনিটে। সভাতে সংবাদমাধ্যম থাকছে শুধু তাই না, পুরো সভাটি বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে। কোনও কোনও সময় কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও উপস্থিত থাকছে। তাদের বহু প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, এমনটাও ঘটেছে।
আরও পড়ুন-দুটি রাজনৈতিক মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় কেরল
বিভিন্ন জেলা শহরের মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক একটি অভিনব ঘটনা। “ অংশগ্রহনকারী গণতন্ত্রের ” ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল সংযোজন। এক্ষেত্রে যে তত্ত্বকথাগুলো বলা হয় তার বাস্তবে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এবার, কদিন আগেই মুর্শিদাবাদের বহরমপুর সভায় বলেছেন – এবার থেকে তিনি জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক সভা মহকুমা স্তরেও করবেন। সভায় প্রায় হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। বিধায়করা সবাই বলেন “ আমাদের মহকুমায় হোক ”। মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সভাতে উপস্থিত থেকে আমার যা মনে হয়েছে সেগুলো এখানে তুলে ধরছি।
আরও পড়ুন-কেজরিকে পর্যটক বললেন সিধু
দূরদর্শনেও অনেক সভার সম্প্রচার দেখেছি। সাধারণভাবে মুর্শিদাবাদের সভাতে আমি উপস্থিত থাকি। সেই কথাই এখানে বলছি। এই সভাগুলোতে মুখ্যমন্ত্রীকে নানা রূপে পাওয়া যায়। তিনি কখনও কঠোর প্রশাসক, কারও কথা শুনছেন না, ধমক দিয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন। আবার কখনও স্নেহময়ী দিদি। বড় দিদি। সংসারের কর্ত্রী। একটু আগে যাকে বকাবকি করেছেন তার শরীরের খোঁজ নিচ্ছেন। বাড়ির সকলের স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে চাইছেন। এমন একটা ঠাট্টা করলেন যাতে সবাই হেসে উঠলেন। একটু রাগ হলেও সব গলে জল। বাঙালির সংসারে এমন দিদিরাই তো হাল ধরে থাকেন। এরাজ্যের দিদি তিনি। আপামর জনতার ভালোবাসার দিদি। রাজ্যের হাল তিনিই ধরে রেখেছেন।
বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করে অবাক হন তার স্মৃতিশক্তি দেখে। কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় লালগোলা থেকে ফেরার পথে ভগবানগোলার মোড়ে এক দোকানে তেলে ভাজা ও ডালবড়া খেয়েছেন – জানিয়ে দিলেন সব। পুলিশকে নির্দেশ দিলেন গরিব মানুষ, যারা এভাবেই সংসার চালায় তাদের কোনও অসুবিধা যাতে না হয় সেটা দেখতে। এমনতর মানবিক মুখ সারা দেশের প্রশাসনে বিরল নয় – বিরলতর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন গুণের অধিকারী। সারা দেশের মানুষ সেই কারণে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাইকে তিনি চেনেন। শুধু তাই না, নাম ধরে ডাকেন। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ রাজীব হোসেন বলতে উঠলেই ছোট্ট ধমক দিয়ে বসতে বললেন। কিন্তু একটু পরেই তাকে বলতে অনুমতি দিয়ে বললেন “ মান্নানের ছেলে রাজীব, সৌমিকের ভাই। ওদের সবাইকে চিনি। ছোট করে বল। ”
আরও পড়ুন-দুটি রাজনৈতিক মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় কেরল
একটা উদাহরণ দিলাম। একের পর এক নেতাদের স্বাস্থ্যর খবর নিচ্ছেন। জাকির সাহেব খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন। তাঁকে বার বার বললেন বসে বক্তব্য রাখতে। কথার মধ্যে তখন ঝরে পড়ছে আদর আর ভালবাসার সূর। পুরনো নেতা নিয়ামত শেখ – তিনি কোনও বক্তব্য না রেখে দোয়া করলেন “ আপনি আমাদের জন্য আপনি যা করেছেন – আল্লাহ আপনার জন্য যেন জান্নাত মঞ্জুর করেন। ” হাজী সাহেবের এই দোয়া প্রার্থনায় দিদি আপ্লুত হলেন। প্রশাসনিক সভা একটা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। এমন একটা পরিবেশ নিয়ে আসার কৃতিত্ব একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সভাগুলিতে তিনি বলেছিলেন – দুই জেলার আম আর আমসত্ত্ব দুইই তাঁর চাই। তার কারণ এই দু’জেলা বিগত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ফলাফল ভাল ছিল না। এবার দু’জেলার ফলাফল খুবই ভাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন – “ এই আনন্দে দুই জেলার বহু মানুষ এত আম ও আমসত্ত্ব পাঠিয়েছেন যে, বেশ কয়েকদিন লেগেছে তা ভাগ করে সবাইকে দিতে। ” সভাতে তখন উল্লাসধ্বনিতে ভরপুর।
প্রত্যেকটা জেলাকে ও তার সম্পদকে কত গভীরে মুখ্যমন্ত্রী চেনেন তা প্রশাসনিক বৈঠকে জানা যায়। জানা যায় কত গভীরভাবে তিনি মানুষকে চেনেন। কোনও ভুল তথ্য দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সে জনপ্রতিনিধি হোক অথবা আধিকারিক হোন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে দেবেন কোনটা ঠিক। জেলার কোন সেতু কেমন, কোন নদী কোথা দিয়ে গেছে, কোন ফসল অথবা ফলমূল কোথায় ভাল পাওয়া যায় সব তাঁর জানা। সেই মতো পরিকল্পনা তিনি নিজেই করেন। প্রশাসনিক বৈঠক সেই কারণে কোনও নীরস বৈঠক হয়না। তিনি নিজেই সেটাকে সরস করে তোলেন। কাজে টইটুম্বুর করে তোলেন।
আরও পড়ুন-কেজরিকে পর্যটক বললেন সিধু
এক মিনিটে তিনি নিমতিতা হাসপাতালকে বিড়ি শ্রমিকদের জন্য তৈরি করার নির্দেশ দেন। আবার নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবমত পৌরসভার জমিকে পর্যটন নেবে ও যৌথ পরিকল্পনা করবে সেটাও ঠিক করে দেন। এমন অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের কোনও দিন হয়নি। একসময় ক্রিকেট মাঠে যেতাম। ইডেনে যেদিন আজহারউদ্দিন রান পেতে থাকবে – সেদিন সূর্য্যের নীচে সেটাই হবে শ্রেষ্ঠ দর্শন। এটাই ছিল আমাদের মতো ক্রিকেটপ্রেমীদের তখনকার দর্শন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠক ঠিক তাই। অবাক হয়ে শুধু দেখতে হবে। তখন স্তব্ধ বিশ্ব চরাচরে আর কিছু দেখার নেই।
সবার দাবি ও চাহিদা তিনি শোনেন। কিন্তু তিনি অন্যায্য কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পক্ষে তিনি নন। সামাজিক প্রকল্পগুলির কথা বার বার বলছেন। সবাইকে বোঝাতে চাইছেন, এখানেই আছে সরকারের প্রাণভোমরা। মানুষের যেন এটা মনে হয় এবং অনুভব করে সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের সঙ্গে আছেন। এর চাইতে বড় উপলব্ধি আর কীই বা হতে পারে।
প্রশাসনিক বৈঠক নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেন। সেসব বিষয়ে কর্ণপাত অর্থহীন। সারা দেশে নীরবে বিপ্লব সাধন করে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।