“মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,
বক্ষে ভরা বাক্,
কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন
নিত্য কালের ডাক।”
বাংলার মাটির সেই দুর্জয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ছাত্রদলের গান’ আজ থেকে প্রায় কয়েক দশক পূর্বে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই কর্তব্য কি হবে তা নিয়ে পরবর্তীতে অনেকেই ব্যঙ্গের সুরে বলেছেন “আত্মাহুতি, জলাঞ্জলি, বলিদান! ধুর এখন ওসব করে লাভ কী?” আবার অনেকেই প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন “ছাত্ররা কি বেকার থাকবে? চাকরি দিক তারপর হবে বলিদানের কচকচানি”। আসলে ছাত্রদলের পূর্ব-ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা একটা ক্রম দেখতে পাব, ক্রমটা ঠিক এরকম যেখানে আন্দোলনের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ হয়ে সজাগ থেকেছে নবীন-তরুণ ছাত্রদল। ৮৯-এর বসন্তের তিয়েন আন মেন স্কোয়ার হোক কিংবা ৫২’র ফেব্রুয়ারির ভাষার অধিকার বুঝে নেওয়ার তীব্র লড়াই, ছাত্ররা উদ্ভিন্ন এক প্রাণ, যারা বসন্তের উদাসী হাওয়া মানেনি, শীতের প্রাবল্যকে চুরমার করেছে, মায়ের আদরের স্পর্শ ছেড়ে সমাজের হাল ধরতে পিছ-পা হয়নি, তারাই ছাত্রদল। তাই যারা অশাশ্বত ভঙ্গিমায় ছাত্রদের দিকে আঙুল তোলার চেষ্টা করেছে তাদের উচিত জবাব একদিন এই ছাত্ররাই দেবে। এই ছাত্ররা সেদিনও অধিকারের লড়াইয়ে পথ হেঁটেছে আজও হাঁটছে। তারা শুধু আশ্বাস চেয়েছে, পাশে থাকার অঙ্গীকার চেয়েছে। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের কাছে টেনে নেওয়ার সেই কৌশল বা আগলে রাখার সেই মমতা যার স্নিগ্ধতার সামনে এসে মাথা ঠেকিয়েছে তিনি গান্ধি মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে ২০২২ সালের ২৮ অগাস্টে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন “তোমরা আমাদের গর্ব।” মঞ্চের ওপরে তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, ছাত্রস্রোতের মধ্যে অগ্নিধারা বর্ষিত হচ্ছে সত্তর-আশির দশকের সেই ছাত্রনেত্রীর বক্তব্যে। ছাত্রদের পাশে মুখ্যমন্ত্রী— এই সাহস বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দেখিয়েছেন রাজনীতির ইতিহাসে। তখনও ভারতের বিপুল ছাত্রসমাজ মণিপুরের হিংস্রতা দেখে ওঠেনি। তবে উন্নাও-হাথরস পরবর্তী ক্ষোভানল দাবনলের রূপ নিয়েছে। চতুর্দিকে প্রতিবাদ মিছিল, প্রতিবাদ সভা, জনপ্রিয় মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্রদের লাইভের মাধ্যমে সেই আগুন আছড়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু আধুনিক ভারতবর্ষের বুকে তখনো মণিপুরের (Manipur) ঘটনার কালি লাগেনি। কিন্তু আজ, এই সময় দাঁড়িয়ে যখন বিশ্বের দরবারে, বিভিন্ন বিদেশি সংবাদপত্রে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন সত্যি মনে হয় যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন প্রতিবাদী কণ্ঠের নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্রদল মণিপুরের (Manipur)মাটি থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তাহলে হয়ত এই দুর্দিন নেমে আসত না। গির্জা জ্বলত না, মায়ের বিবস্ত্র দেহ ঘিরে নরপিশাচ থাকত না, ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ আগলে মায়ের আর্তনাদ শোনা যেত না।
মণিপুরের (Manipur) সেই মা কোথাও গিয়ে বাম সন্ত্রসের নজিরস্বরূপ সাঁইবাড়ির সেই মায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। ছাত্রসমাজের ক্ষোভের কারণ এখানেই। এখানেই গর্জে উঠেছে প্রতিবাদ, এখানেই গড়ে উঠবে বিপ্লব। মন্তব্য করে কখনওই ছাত্রসমাজের গন্তব্য পরিবর্তন করা যায়নি, জুলমের বিরুদ্ধে ভগত সিং, ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ, প্রীতিলতারা লড়েছিলেন। শুধু তাঁদের একজন মাস্টারদা ছিলেন গতি নির্ধারণের জন্য, রাসবিহারী ছিলেন। বর্তমান ছাত্রপ্রজন্মের মাথার ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন।
‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’ নীতিতে বিশ্বাসী ছাত্ররা সবসময় ‘দশে মিলি করি কাজ/হারি জিতি নাহি লাজ’-এর বুলি আওড়েছে। সেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আপামর ছাত্রসমাজের ২০২৩-এর লক্ষ্য ইউনাইটেড ইন্ডিয়া, যে ইন্ডিয়া মণিপুরের (Manipur) ভয়াবহতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিবাদ করবে, অকারণ কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে, উন্নাও-হাথরসের নির্মমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, পেট্রোপণ্যের অকারণ মূল্যবৃদ্ধির মতো দুর্নীতির কফিনে শেষ পেরেকটি আটকে দিতে ২০২৪-এর দিকে ছুটবে। এক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ অবশ্যই অঙ্গীকারবদ্ধ। ছাত্ররা সেই নরম মাটির তাল যাকে চাইলেই যেকেউ যেমন ইচ্ছায় ভাঙতে কিংবা গড়তে পারে। তাই সঠিক পথ বেছে নিতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রসমাজকে সাহায্য করতে হবে। তার জন্য শিক্ষার প্রগতি ভীষণ প্রয়োজন। আবার শুধু শিক্ষা থাকলেই হবে না সেই শিক্ষাকে জীবনের সংঘবদ্ধতায় উপযুক্ত পরিসরে ব্যবহার করতে শিখতে হবে। প্রগতিশীল মানসিকতা নিয়ে শিক্ষিত ছাত্রসমাজকে দেশের সার্বিক উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে, তার জন্য অবশ্যই দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের হাতে তৈরি করা রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ এবং সর্বপ্রিয় স্নেহধন্য শাখা সংগঠন হিসেবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ভূমিকা এক্ষেত্রে অপরিসীম।
এই মন্ত্র বা বাণী কিন্তু কখনওই ‘হীরক রাজার দেশে’র মগজ ধোলাই নয়। এ এক স্বতন্ত্র ধ্যান-ধারণা। গোলাপের সুগন্ধ আস্বাদন করতে গেলে কাঁটার অস্তিত্ব যেমন অস্বীকার করা যায় না, ঠিক সেরকমই সমাজ গঠনের ভাবনায় ‘কণ্টকগাড়ি কমলসম পদতল’-এ ব্রতী হতে হবে।
আরও পড়ুন- তৃতীয় শ্রেণির পর পড়াশুনো বন্ধ! নারীশিক্ষায় তালিবানি ফতোয়া
এই সময় বিভিন্ন প্রলোভনের যে রাজনীতি চলবে ছাত্রসমাজকে সেই মোহ পরিত্যাগ করতে হবে। এই প্রলোভনের উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে অনেকেই ছাত্রদের মধ্যে অযাচিত বিদ্বেষমূলক ধারণা ঢুকিয়ে দেবে। বিচারাধীন বিভিন্ন বিষয়কে ভুল আঙ্গিকে ব্যখ্যা করবে, ভাবটা ঠিক এমন যেন সবটা প্রমাণিত সত্য। সঠিক পথে আন্দোলন যেন না হয় তার জন্য আদালতের অপব্যবহারের মতো বিভিন্ন অনৈতিক পথ বেছে নিতে বলবে। তবে আপামর ছাত্রসমাজকে এমন কৌশল রপ্ত করতে হবে যে তারা যেন এই সব চক্রব্যূহ থেকে সঠিক পথ ধরে বেরিয়ে আসতে পারে। মানুষের স্বার্থে, মানুষের জন্য, মানুষের পাশে থেকে ‘Of the people, by the people And for the people’র কথা মাথায় রাখতে হবে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই আঁচ যেন পরবর্তী দিনগুলিতে স্তিমিত না হয়ে পড়ে সেই দিকে নজর রাখতে হবে। এই মহৎ ভাবনা কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতীত কেউ দেননি, এমনকী নতুন প্রজন্মের উত্থানকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতাও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারুণ্যকে দেখেই। এই তারুণ্য শেখায় মানুষের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল হতে হবে, এই তারুণ্য শত্রুর চোখে চোখ রেখে বলতে শেখায় ‘the sword of revolution is sharpened on the whetting stone of ideas…’ (ভগত সিং)