অনুমতি ছাড়াই
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে হাত দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। ততদিনে তিনি বিশ্ববরেণ্য। মনে বসেছে ‘বরসন লাগি বদরিয়া’ গানটি। বিদূষী গিরিজা দেবীর গাওয়া। একটি দৃশ্যে ব্যবহার করতে চান। কিন্তু কিছুতেই শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। হাতে বেশি সময় নেই। কী আর করেন। বেশি কিছু না ভেবেই গানটি নিজের ছবিতে ব্যবহার করে বসলেন পরিচালক। মাত্র এক লাইন। ছবি মুক্তির পর বিষয়টি জানতে পারেন বিদূষী গিরিজা দেবী (Girija devi)। একদিন দিল্লি বিমানবন্দরে মুখোমুখি দুই কিংবদন্তি। অনুমতি ছাড়াই গানের পংক্তি ব্যবহার। মৃদু অনুযোগ করেন বিদূষী গিরিজা দেবী। সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘‘গানটা ভাল লেগেছিল। তাই ব্যবহার করেছি। চেষ্টা করেও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না।” রাগ পুষে রাখেননি বিদূষী গিরিজা দেবী। প্রকৃত গুণীর কদর করতেন। উপলব্ধি করেছিলেন পরিস্থিতি।
ফিরিয়েছিলেন প্রস্তাব
কোনওদিন সিনেমায় গাইতে চাননি। ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ ছবিতে তাঁকে গান গাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলিউডের নামী পরিচালক ভি শান্তারাম। কিন্তু সেই প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজীবন অনড় থেকেছেন নিজের সিদ্ধান্তে। যদিও নয় বছর বয়সে অভিনয় করেছিলেন ‘ইয়াদ রহে’ ছবিতে। তাঁকে সারা পৃথিবী চিনেছে ঠুংরি-দাদরার জন্য। কেমন ছিল শৈশব? কীভাবে ভেজা শুরু সুরের ঝরনা-ধারায়?
দস্যিমেয়ে
জন্ম ১৯২৯-এর ৮ মে। বেনারসের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ছোটবেলায় অতি চঞ্চল ছিলেন। ঘোড়ায় চড়তেন, সাঁতার কাটতেন। মেয়ের দস্যিপনায় অস্থির হয়ে উঠতেন বড়রা। গলায় ছিল সুর। সেটা খেয়াল করেন বাবা। মেয়েকে নিয়ে যান পণ্ডিত সূর্যপ্রসাদ মিশ্রর কাছে। বলেন, ‘‘আপনি দায়িত্ব নিন।” চার বছর বয়সে সংগীতশিক্ষা শুরু। খেয়াল ও টপ্পা সংগীতে তালিম নিতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তালিম নেন গুরু চাঁদ মিশ্রের কাছে। দীর্ঘ সাধনা এবং অধ্যবসায়ের ফলে একটা সময় হয়ে ওঠেন সেনিয়া এবং বেনারস ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী। ঠুংরি শৈলীকে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হত ঠুংরি সম্রাজ্ঞী। তবে সংগীত জগতে ডাকা হত ‘আপ্পাজি’ (Girija devi) সম্বোধনে।
দাম্পত্য সঙ্গী
১৯৪৬ সাল। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিখ্যাত ব্যবসায়ী মধুসূদন জৈনের সঙ্গে। তাঁর উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় সংগীতে আরও মনোনিবেশ করেন। নিজেকে মেলে ধরেন সমঝদার শ্রোতাদের সামনে। আরও চর্চা, আরও আসর। দিনে দিনে বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। পেতে থাকেন মানুষের ভালবাসা, শুভেচ্ছা। সংসার এবং সংগীতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলছিলেন। হঠাৎ ছন্দপতন। ১৯৭৫-এ মৃত্যু হয় স্বামীর। ভেঙে পড়েন বিদূষী গিরিজা দেবী (Girija devi)। ছয় মাস সংগীত জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। পরে আবার শুরু করেন চর্চা।
দেশে এবং বিদেশে
আটষট্টি বছরের সংগীত জীবন। গেয়েছেন অসংখ্য ঠুংরি, খেয়াল, টপ্পা। পাশাপাশি কাজরী, চৈতি, হোলি। অসংখ্য আসর মাতিয়েছেন। তুলেছেন সুরের ঢেউ। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যেতেন শ্রোতারা। গেয়েছেন বেতার এবং দূরদর্শনেও। বেরিয়েছে রেকর্ড। অসংখ্য অনুরাগী। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ছিল দারুণ কদর।
আরও পড়ুন- অগ্নিযুগের দুই বীরাঙ্গনা
পুরস্কার ও সম্মাননা
দীর্ঘ সংগীত জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মাননা, সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার। সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দিয়েছে পৃথিবীর সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সংগীত মহাসম্মান এবং বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা প্রদান করে। আটের দশকে কলকাতার সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে অনুষদ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। নয়ের দশকের শুরুর দিকে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর স্নেহছায়ায় বেড়ে উঠেছেন বহু ছাত্রছাত্রী। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ বিলায়েত খানের সঙ্গে গানের সূত্রেই একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। একে অপরের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর বিদূষী গিরিজা দেবী (Girija devi) কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
অন্য শিল্পীদের চোখে
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
বিদূষী গিরিজা দেবী বিশেষ ধরনের গায়কী পূরব অঙ্গ-এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ছিলেন শ্রেষ্ঠতম ঠুংরি শিল্পী। আমার সঙ্গে ছিল দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। মায়ের মতো ছিলেন। ডাকতাম মাঈয়া বলে। সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। উনি নীচের তলায়, আমি উপর তলায়। এইভাবে থেকেছি প্রায় ১৪ বছর। বহু অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গান করেছি। ওঁর সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজিয়েছি। নতুনদের শিখিয়েছি, অডিশন নিয়েছি। অংশ নিয়েছি ওঁর পরিচালিত বসন্তোৎসবে। নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার স্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী ওঁর কাছে কিছুদিন গান শিখেছেন। একসঙ্গে ঘুরেছি বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
হৈমন্তী শুক্লা
আমার পরম সৌভাগ্য বিদূষী গিরিজা দেবীর স্নেহ পেয়েছি। ওঁকে মা বলে ডাকতাম। বহু অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। আমার গান শুনে প্রশংসা করতেন। এটা বড় প্রাপ্তি। দু-একটা ঠুংরি ওঁর কাছে শিখেছিলাম। বাংলা গান গাইলেও, আমি বাবার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছি, সেটা উনি জানতেন। রবি কিচলুর স্ত্রী বীণা কিচলু একটা জাতীয় স্তরের সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। ওখানে আসতেন মা। আমাকেও ডেকে নিতেন। ঠুংরিতে বোল বনাওয়াত বলে একটা কথা আছে, সেটা শিখেছিলাম ওঁর কাছে। খেয়ালে যে-কোনও কথা নিয়ে আলাপ বিস্তার করা যায়। ঠুংরিতে সেটা হয় না। যত্ন করে বুঝিয়েছিলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। আমার মনে হয়, উনি ছিলেন ঈশ্বরের অংশ। ওই বয়সে যেভাবে উপরের ‘সা’-টা লাগাতেন, শুনে কেঁপে উঠতাম। একবার জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘কীকরে করলেন মা?” বলেছিলেন, ‘‘ভগবানের দয়ায়। চেষ্টা করলে তোমরাও পারবে।” ওঁর গাওয়া সব গান আমার প্রিয়। গাইলেই মনে হত সানাই বাজছে। বাংলার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল। পছন্দ করতেন বাঙালি শিল্পীদের। আমার কাছে বাংলা গান শুনতে চাইতেন। এঁদের মতো মানুষ দিনে দিনে কমে আসছে। আমরা ভাগ্যবতী কিছুটা সান্নিধ্য পেয়েছি।
পণ্ডিত দেবজ্যোতি বসু
বেনারস ঘরানার ঠুংরির শৈলীকে যে দু’জন শিল্পী প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিদূষী গিরিজা দেবী। পাশাপাশি মার্গীয় সংগীতও গেয়েছেন। অথচ তাঁর এই দিকটাকে অবজ্ঞা করে শুধুমাত্র ঠুংরি-দাদরার জগতেই ওঁকে বড় করে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। এটা দুঃখজনক। কিষেন মহারাজ ওঁকে বোন বলতেন। বিদূষী গিরিজা দেবীর যখন ষোলো বছর বয়স, পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ ওঁর সঙ্গে সঙ্গত করেছিলেন। সেই রেকর্ডিং আমাদের কাছে আছে। আজকের দিনে কলকাতায় ঠুংরি-দাদরার যে প্রচার প্রসার, তার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল বিদূষী গিরিজা দেবীর। দীর্ঘদিন ছিলেন বালিগঞ্জের সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে। কলকাতায় ডুয়েটে অংশ নিয়েছেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ এবং উস্তাদ আমজাদ আলি খানের সঙ্গে। পুনার সাওয়াই গান্ধর্ব ভারতের অন্যতম সেরা সংগীত সম্মেলন। বড়বড় শিল্পীরা সেখানে গেয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আয়োজন করতেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। সেই সম্মেলনে শেষ যে-বছর গেয়েছিলেন বিদূষী গিরিজা দেবী, সেই বছর গুরুতর অসুস্থ পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। রীতিমতো শয্যাশায়ী। তবু এসেছিলেন স্নেহের বোন বিদূষী গিরিজা দেবীর গান শুনতে। গান শেষ করে বিদূষী গিরিজা দেবী দেখা করেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে। আমার পরম সৌভাগ্য বিদূষী গিরিজা দেবীর স্নেহ পেয়েছি। পেয়েছি আশীর্বাদ। কারণ আমার পুরো পরিবার বেনারস ঘরানার। ডাকতাম বুয়াজি বলে। ওঁর মতো সরল মনের মানুষ খুব কমই দেখেছি।