চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় : পুজো কিংবা বার-তিথি-নক্ষত্র দেখা ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে পঞ্জিকার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাবছেন, পাঁজি আবার সাহিত্য হল কবে? যাঁরা এমনটা ভাবছেন, তাঁদের ভুল ভাঙানোর জন্যে বলি, পঞ্জিকাতে কী নেই? সূচিপত্রে ৭০টা বিষয় আছে। যার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ের নাম লিখছি : ভূমিকা, হরপার্বতী, গংগাদিস্নানযোগ, মমজ্ঞকাদি গ্রহের রাশ্যাদি সঞ্চার, তারাশুদ্ধি, পতাকীচক্র, অন্তদর্শাকাল নিরূপণ, বিংশোত্তরী অন্ত্ররদশা, আশৌচ বিবেক ইত্যাদি।
পঞ্জিকার সব থেকে আকর্ষণীয় অংশ হল ‘জ্যোতিষ বচনার্থ’!
কী নেই সেখানে? প্রথমেই রয়েছে ‘বারবেলা’ ও ‘কালবেলা’। রবিবার থেকে শনিবার— সপ্তাহের প্রতিটা দিনেরই কোনও না কোনও সময় ‘বারবেলা’ বা ‘কালবেলা’ পড়বে। আর আছে ‘কালরাত্রি’। এই ‘বারবেলা’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালরাত্রি’ সময়কালে কোনও কাজ করা যাবে না। করলে নানা বাধা-বিঘ্ন, এমনকী প্রাণসংশয় পর্যন্ত!
সন্তানের অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ যে কোনও শুভ কাজেই হোক, পঞ্জিকার জ্যোতিষ বচনের নির্দেশ না মানলে সমূহ সর্বনাশ! পঞ্জিকা মতে, যে কোনও কাজেই জ্যোতিষরা আপনার সহায়।
হিন্দু ও বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, ব্রত (উপবাস), পরব, উৎসব, পঞ্জিকা এবং মুহূর্তের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। এই সকল বিষয়গুলি ছাড়া, কেউ হিন্দু ধর্মের উৎসবকে কল্পনা করতে পারে না। পঞ্জিকাতে এ-সবই মিলবে।
দৈনিক এবং মাসিক পঞ্জিকার সাহায্যে আপনি দিন, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, কার্য-কারণ, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রোদয় এবং চন্দ্রাস্ত সম্পর্কিত তথ্য জানতে পারবেন।
প্রাচীনতম পঞ্জিকা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
১. বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা
২. বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা
৩. শ্রী মদনগুপ্তের ফুল পঞ্জিকা
৪. পূর্ণচন্দ্র শীলের ফুল পঞ্জিকা
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। আজও কিছু মানুষ পঞ্জিকাতে বিশ্বাস রাখেন।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা বাঙালিদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি ক্যালেন্ডার।
বাংলায় পঞ্জিকা দুটি পদ্ধতিতে তৈরি হয়। এই বিষয়ে পণ্ডিত জয়ন্ত আচার্য জানিয়েছেন, একটি হল দৃকসিদ্ধান্ত (বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা) এবং অদৃকসিদ্ধান্ত (গুপ্তপ্রেশ, পিএম বাগচী ইত্যাদি)।
যে-দিনগুলিতে উৎসব অনুষ্ঠিত হবে সেগুলি তারা নির্দেশ করে। কখনও কখনও, তারা বিশেষ উৎসব জন্য বিভিন্ন তারিখ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে।
আবার বেলুড় মঠ বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার প্রতি অনুগত। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নিজে একজন জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রামকৃষ্ণ মিশন আরও বৈজ্ঞানিক হওয়ায় এই পঞ্জিকা (Bengali Panjika) অনুসরণ করবেন।
আসলে পঞ্জিকা পুরোটাই জ্যোতিষ-নির্ভর শাস্ত্র, জ্যোতিষের বিভিন্ন বিষয়ই পঞ্জিকায় (Bengali Panjika) আলোচনা করা হয়। বাজারে যেসব পঞ্জিকা পাওয়া যায়, সেগুলোর সবই জ্যোতিষীদের জন্য লেখা, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এজন্য পঞ্জিকায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেগুলো জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে না জানলে কারও পক্ষে বোঝাই সম্ভব নয়।
জ্যোতিষ হল বাস্তবতার বিজ্ঞান, কিন্তু এই বিজ্ঞানকে দেখা যায় না, উপলব্ধি করতে হয়। পৃথিবীতে যখন একটা মানুষের জন্ম হয়, তখন তার উপর শুধু তার চারপাশের পরিবেশই প্রভাব রাখে না, তার উপর আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রেরও প্রভাব থাকে, যার উপর ভিত্তি করে তার ভাগ্য রচিত হয় এবং যে ভাগ্য তার জীবদ্দশায় সে ভোগ করে যায়। কোনও একটা মানুষের উপর এই যে তার পরিবেশের প্রভাব, যার অন্তর্ভুক্ত বার, সময় এবং তার বসবাসের স্থান, মূলত এগুলোর ভাল-মন্দ সম্পর্কে মানুষকে অবগত করানোই পঞ্জিকার উদ্দেশ্য। জ্যোতিষ নিমাই চক্রবর্তী জানান, বাংলা পঞ্জিকার শুরুর দিন হচ্ছে, সূর্য তার যাত্রাপথে যেদিন নাক্ষত্রিক মেষরাশিতে (Sidereal Aries) প্রবেশ করে সেদিন থেকে। এটি সাধারণত ১৪ বা ১৫ এপ্রিল নাগাদ ঘটে। বাংলা চলতি পঞ্জিকা তাই একটি নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা (Sidereal calendar)। নাক্ষত্রিক পঞ্জিকার বছর সৌর পঞ্জিকা বছরের চেয়ে সামান্য দীর্ঘতর।
বাংলা পঞ্জিকায় ১৫৮৪ সালে পয়লা বৈশাখ ছিল ১১ এপ্রিল। গত ৫০০ বছরে গ্রেগরিয়ান সৌর পঞ্জিকার (Solar calendar) তুলনায় নাক্ষত্রিক বাংলা পঞ্জিকার বর্ষ শুরু তিনদিন পিছিয়েছে। কিন্তু এখন থেকে বাংলা পঞ্জিকা সৌর পঞ্জিকা হওয়ায় সূর্যের অবস্থান ধরে আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।