১৯৯৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এক সমাবেশের মাধ্যমে ২১ নভেম্বর দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্ব টেলিভিশন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সমাবেশে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টেলিভিশনের গুরুত্ব অসীম। টেলিভিশনের মাধ্যমে নানা ঘটনা নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং জনজীবনে তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে। আধুনিক বিশ্বে টেলিভিশন ব্যতীত পথ চলা এক মুহূর্তও সম্ভব নয়। তাই এর মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে শান্তি, সুরক্ষা, ঐক্য বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে টেলিভিশনকে ব্যবহার করার জন্যই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-কৃষক আন্দোলনের জয়, শাসকের দম্ভ ও অহঙ্কারের পরাজয়
টেলিভিশন শব্দটি গ্রিক ও লাতিন শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি একটি শব্দ। গ্রিক শব্দ অর্থ দূরত্ব, আর লাতিন শব্দ অর্থ দেখা। ১৮৭৩ সালে বিজ্ঞানী স্মিথ ইলেকট্রনিক সিগন্যালের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এরপর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম টেলিভিশন আবিষ্কার করেন এবং সাদাকালো ছবি বৈদ্যুতিক সম্প্রচারের মাধ্যমে দূরে পাঠাতে সক্ষম হন। এরপর এক রুশ ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার আইজাক শোয়েনবাগের্র কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি।
টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয় ১৯৪০ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয় এবং টেলিভিশন গণমাধ্যম হিসেবে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় টেলিভিশনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ঘরের মধ্যে বসেই সারা দুনিয়ার যাবতীয় তথ্য জানতে পারা এবং তা চাক্ষুষ করা একমাত্র টেলিভিশনের মাধ্যমেই সম্ভব। টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা দুনিয়া একটি ‘বিশ্ব ভুবন’-এ পরিণত হয়েছে। তাই বিশ্ব শান্তি, ঐক্য ও সুরক্ষা অটুট রাখতে টেলিভিশন এক অপরিহার্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে টেলিভিশনের ইতিহাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রটিও অনেক বিস্তৃত।
আরও পড়ুন-রানি কাহিনি…
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে দূরদর্শনের আবির্ভাব হয় মূলত শিক্ষার হাতিয়ার হিসেবে, বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়। উন্নয়নমূলক রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবেই ১৯৫৯ সালে জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ভারতীয় দূরদর্শনের যাত্রা শুরু হয়। দূরদর্শনের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল ‘‘Doordarshan will act as a catalyst of national development’’. কিন্তু ১৯৯০ সাল পযর্ন্ত দূরদর্শন যেহেতু সরাসরিভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল তাই এটি মূলত একমুখী প্রচারের যন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে বলেও সমালোচনা শোনা যায়। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তৈরি হওয়া জরুরি অবস্থার সময়ে কেন্দ্র বিরোধীদের প্রচারকে ছত্রভঙ্গ করতে এবং সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে ভারতীয় দূরদর্শনকে ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
আরও পড়ুন-দূরদর্শনের চার কন্যা
১৯৪৭-এ ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। একদিকে আমদানি করা জিনিসের ওপর অতিনির্ভরতা, অন্যদিকে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে উত্পাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং সেই সঙ্গে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি। এই ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী তত্কালীন ভারতের পরিস্থিতি। এই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য জওহরলাল নেহরুর সরকার উন্নয়নের সমাজতান্ত্রিক মডেল গ্রহণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয় যার মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র দূরীকরণ, বেকার সমস্যার সমাধান এবং রফতানি কমিয়ে স্বনির্ভর হওয়া।
আরও পড়ুন-আইন বাতিল কী বলছেন ওঁরা
উন্নয়নকে প্রযুক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত বলে সেই সময় মনে করা হয়েছিল এবং ভাবা হয়েছিল যে টেলিভিশনের মাধ্যমেই উন্নয়নের ধারাকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। নেহরুর ভাবনায় স্বাধীনতার প্রারম্ভিক উদ্দীপনার অন্যতম অঙ্গ ছিল অবশ্যই সভ্য স্বাধীন দেশ এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম। তাই নেহরু সরকার গণমাধ্যমের উপযোগিতার ওপর যথেষ্ট জোর দেয়। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে গণমাধ্যম পরিকল্পিত এবং দ্রুত উন্নয়নের ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। এই মর্মে ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতে টেলিভিশনের পথচলা শুরু হয়।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাবে মহমেডান
প্রথমদিকে দিল্লি থেকে নিকটবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে সপ্তাহে দু’দিন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত। UNESCO এবং ডাচ্ বৈদ্যুতিন কোম্পানি Philips এর সাহায্যে এই প্রকল্পটি চালানো হত। এর লক্ষ্য ছিল গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের বার্তা বিশেষ করে শিল্পমূলক অনুষ্ঠান পৌঁছে দেওয়া। ১৯৬৫-এর অগাস্ট মাসে টেলিভিশন দিল্লি থেকে প্রতিদিন সম্প্রচার শুরু করে এবং সম্প্রচারের সময় ও বিস্তার উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওভারব্রিজ
ভারতের মতো একটি দরিদ্র দেশে এমন একটি ব্যয়বহুল গণমাধ্যম ব্যবস্থা চালু করা নিয়ে বিতর্কও দানা বাঁধে। সেই বিতকের্র বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নতি, মতাদর্শ ও সংহতি বজায় রাখার জন্য টেলিভিশন ব্যবহারের ওপরে জোর দেওয়া হয়। কালক্রমে টেলিভিশনে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বাড়তে থাকে এবং ভারতীয় টেলিভিশন ‘দূরদর্শন’ বা সংক্ষেপে DD নামে পরিচিত হয়।
দিন দিন টেলিভিশনের দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। এই ইন্টারনেটের যুগেও তার প্রচার ও প্রসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিনোদন থেকে সংবাদ মানুষকে টেনে রেখেছে বাক্সটি। বর্তমানে ৪.২৩ বিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন টেলিভিশনে চোখ রেখে থাকেন। শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে টেলিভিশন দিবসে। পরীক্ষামূলক দিনগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচারিত হয়েছিল প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক জে হার্লে ম্যানার্সের ‘দ্য কুইন্স ম্যাসেঞ্জার’। ফিলো ফ্রান্সওয়র্থকে ফাদার অফ টেলিভিশন বলা হয়।