‘সানডে হো ইয়া মানডে, রোজ খাও আন্ডে’… এই আন্ডা বা ডিম বাঙালির হেঁশেলের সৌরভ গাঙ্গুলি, যার দাদাগিরি চলে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ভাতের পাতে, বিকালের স্নাক্স আইটেমে বা ডিনারে ডিমভাজা অবতারে। জীবনের বিভিন্ন আবেগের সাক্ষী এই মুরগি বা হাঁসের ডিম। সন্তানের পুষ্টি নিয়ে চিন্তিত মায়ের ফুড চার্টে বা দূরপাল্লার যাত্রীর খাবারের কৌটোয় বা অসময়ে অতিথি আগমনে বা স্পোর্টসের মাঠে টিফিনের বাক্সে কাঁচা পাউরুটি, কলার সঙ্গে অথবা অপটু রাঁধুনীর ত্রাতার ভূমিকায় এর অবদান অনস্বীকার্য; কিছুটা ‘রায়-মার্টিনের’ বইয়ের মতো।
পেলব আলু, গোটা ডিমের লাল-হলুদ ঝোল কিংবা মামুলি শশা, পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কার কুচি পেটের মধ্যে পুরে ময়দার পরোটায় ডিম মাখিয়ে এগরোলের স্বাদ চাখেনি এমন ভোজনরসিকের সংখ্যা নিতান্তই কম।
আরও পড়ুন-অবনীন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজন
ডিম, পিঁয়াজকুঁচি, কাঁচালঙ্কার কুঁচি ও নুন দিয়ে বানানো বাঙালির ঘরে যাকে বলে ডিমভাজা, সেটি আবার মামলেট বা ওমলেট নামে খ্যাত ছিলেন অন্য সংস্কৃতিতে।
কিংবদন্তি অনুসারে, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে যাত্রা করছিলেন, সেখানে বেসিয়ারেসের কাছে একটি সরাইখানায় জীবনে প্রথম একটি পুরু সুস্বাদু অমলেট খেয়েছিলেন এবং তিনি এতটাই তৃপ্ত হয়েছিলেন যে পরের দিনই আদেশ দিলেন, গ্রামের সব বাড়ি থেকে ডিম সংগ্রহ করে তার সৈন্যদের জন্য একটি বিশাল আকারের ওমলেট তৈরি করার জন্য। তার পর থেকেই নাকি ফ্রান্সে ইস্টারে ওমলেট খাওয়ার ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। সাহেবের নামে কেবল ‘নেপোয় মারে দই’ বললে চলবে না, তার বদলে ‘ওমলেট’ও যে উপহার দিয়ে গেছেন বলতে হবে।
আরও পড়ুন-বইপাড়ার বনস্পতি
হাফ-টিকিট ও হাফ-ডিমের সঙ্গে আমার আশৈশব আত্মীয়তা। দুটি ক্ষেত্রেই হাফ থেকে ফুল এ উত্তরণ এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। যেন ম্যাচিওর হওয়ার ছাড়পত্র।
হাফ-ডিমের ব্যাপারটা আজও বড় রহস্যময়। আশির দশকের গোড়ায় দেখা যেত, যতই নিম্নবিত্ত পরিবার হোক না কেন রবিবার ছিল মাংস খাওয়ার দিন। তাও আবার মহার্ঘ্য খাসির মাংস। অথচ তস্য তস্য সস্তা ডিম সুতো দিয়ে কেটে অর্ধেক কেন দেওয়া হত, তা আজও আমার কাছে রহস্যময়। ডিমের সঙ্গে যৌনতার কোনও সম্পর্ক আছে … এই ধরনের কোনও ধারণা কাজ করত কিনা জানা নেই।
সাহিত্যিকেরা তাঁদের লেখায় ডিমকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাপদ রায় তাঁর একটি গল্পে ডিম নিয়ে স্বামী স্ত্রীর অন্তর্নিহিত গোলমাল (যা কখনও মেটবার নয়) তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন-লাল-গেরুয়া ভাই ভাই, স্ক্যামে ওরা জগাই-মাধাই
সাহেব (স্বামী) জলখাবারে দৈনিক একটি করে ডিম খান। একেকদিন একেকরকম। কোনওদিন ডিমসেদ্ধ, কোনওদিন ওমলেট বা কোনওদিন ডিমের পোচ। সমস্যা হল, সাহেব ডিমসেদ্ধ দেখলে পোচ চান, পোচ হলে ওমলেট চান। স্বভাবতই ঝগড়াটা শুরু হয় সকালের জলখাবারের টেবিল থেকেই।
অনেক ভেবে-চিন্তে স্ত্রী একটি মোক্ষম বুদ্ধি বার করলেন। সেদিন সকালে একই সঙ্গে ডিমসেদ্ধ, পোচ, ওমলেট তিনটিই করলেন।
সাহেব তেমনি সহজ লোক নন। ভুরু কুঁচকিয়ে তিনটি প্লেট অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে আঙুল দিয়ে ডিমসেদ্ধটাকে দেখিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘ওই ডিমটা ওমলেট করা উচিত ছিল, আর ওই ওমলেটের ডিমটাকে পোচ।’
শুধু সাহিত্যে নয়, রাজনীতির ময়দানে তর্কের স্থান দখল করে নিয়েছে ডিম। ব্রিগেডের জনসভায় ডিম-ভাত নিউজ চ্যানেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দিয়েছে। মিড-ডে মিলে ডিমের উপস্থিতি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় আসন বিন্যাস
বাজার থেকে টাটকা ডিম কেনার জন্য একটু ঝাঁকিয়ে দেখা হয় কারণ পচা ডিমে নাকি শব্দ আসে। আলোর সামনে ডিম ধরলে যদি ভিতরে রিংয়ের মতো দেখতে পান তবে বুঝতে হবে পচন-ধরা শুরু হয়েছে। আর ছোটবেলার বিজ্ঞান বইয়ের জ্ঞান অনুযায়ী ডিমকে জলে ডুবিয়ে পরীক্ষা তো রয়েছেই। ডুবলে টাটকা, ভাসলে পচা। এত উপায় জানার মধ্যেও একটি কিন্তু রয়েছে। আবার একটি বিখ্যাত লেখকের গল্প বলি, যা গল্প কম-বাস্তব বেশি…
‘বাজার থেকে একটি ডিম কিনে এনেছিলাম। বাসায় এসে দেখি সেটা পচা। দোকানে ফেরৎ দিতে গিয়ে দোকানদারের ওপর খুব রাগারাগি করলাম।
বুড়ো দোকানদার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে গালাগাল খেয়ে তারপর হাত তুলে আমাকে থামিয়ে তার ডিমের ঝুড়ির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে আমাকে করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, আপনার মাত্র একটা পচা ডিম তাই এত রাগারাগি করছেন আর আমার ঝুড়ি ভর্তি পচা ডিম আমি কী করি বলুন তো?’
‘আমার এই ডিমের গল্প পড়ে কারোর যদি মাথাগরম হয়, দয়া করে ওই বুড়ো দোকানদারের কথাটা স্মরণ রাখবেন।’
আরও পড়ুন-কাবুলে বিস্ফোরণ
ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে খেতে চান অনেকেই। বর্তমানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন কুসুম-সহ একটি ডিম সবার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর (বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া)। কুসুমের মধ্যে পুরো ডিমের প্রায় অর্ধেক পুষ্টি উপাদান থাকে। কুসুমের মধ্যে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, উপকারী বায়োটিন, ভিটামিন এ-ডি-ই, লেটিইন, ফলেট, কলিন এবং জি-অ্যাকজানথাইন থাকে। আমদের খাদ্য-তালিকায় প্রতিদিন যে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা আছে, তা সহজেই সুলভ বাজেটে মেটাতে পারে ডিম।
ডিমের জন্মবৃত্তান্ত বিতর্কিত হলেও এর চরণচিহ্ন আঁকা আছে পরীক্ষা-হলে, সাহিত্যে, রাজনীতির তরজায়, যাপনের অংশ হিসাবে। ‘ঘোড়ার ডিমের’ কথা বাদ দিয়ে বরং এই করোনা আবহে রকমারি রান্না দিয়ে চেনা ডিমকে অন্যভাবে পরিবেশন করুন নিজ-গুণে।