অশোক মজুমদার
একুশে জুলাই… মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইতিহাস যদি কোনওদিন এই অধ্যায়ের প্রশ্ন নিয়ে উত্তরপত্র সাজায়, সাক্ষী হিসেবে অনেকের সঙ্গে এই ছবিওয়ালারও ডাক পড়বে।
দেখতে দেখতে তেত্রিশ বছর পার হয়ে গেল, সেদিনের যুব কংগ্রেস নেত্রী থেকে আজ নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেস দলের নেত্রীর এই মেগা ইভেন্ট। ছবিওয়ালারও তাই।
আমার ফটোগ্রাফি শুরুর প্রায় সমসাময়িকই বলা যায় দিদি তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির যাত্রাপথ। রাজনৈতিকভাবে যতটা আগ্রাসী, এক ইঞ্চি জমিও ছাড়েন না বিরোধীদের, ব্যক্তিগতভাবে ঠিক উল্টো…অসাধারণ একটা মানবিক উদার মনের মানুষ উনি।
আরও পড়ুন-পুরীকাণ্ড, ৪৮ ঘণ্টাতেও গ্রেফতার হল না কেউ
প্রথম কয়েকবারের সাক্ষাৎ থেকেই আমার মনে হত মেয়েটিকে রাজনীতি বহুদূর নিয়ে যাবে। কিন্তু ওঁর রাজনৈতিক জীবন সংগ্রাম বড়ই অমসৃণ। রক্তক্ষয়ী। লিখতে বসলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। তবে লড়াইয়ের জেদটা সেদিনও যেমন দুর্দমনীয় ছিল, আজও তাই।
আমিও তখন সাদা বাড়ি কালো গ্রিলে (আনন্দবাজার পত্রিকা) লড়ছি। সারাবছর দিন-রাত এক করে খুন, অ্যাক্সিডেন্ট, দুর্ঘটনা, বন্যা, পুজো-পার্বণ যাই ঘটুক, ছুটতাম। কারণ পায়ের নিচে শক্ত মাটির প্রয়োজন। কিন্তু বছরভর যাই করি না কেন, ২১শে জুলাই লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো এখনও আমি ধর্মতলামুখী।
২০১৪ পর্যন্ত সাদা বাড়ি কালো গ্রিলের (আনন্দবাজার পত্রিকা) চিত্র সাংবাদিক ও তারপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফটোগ্রাফার হিসেবে ২১শে জুলাইয়ের সঙ্গে আমারও গাঁটছড়া তেত্রিশ বছরের…
বঙ্গ রাজনীতিতে এই ২১শে জুলাই অঘোষিত এক ছুটির দিন বলাই যায়। এইদিন কলকাতা তো বটেই, জেলার মানুষজনের কাছে কোথাও যাওয়ার হলেই খুব স্বাভাবিক একটা প্রতিক্রিয়া যে, ‘‘২১শে জুলাই তো আজ!!’’
এ দিনটা শুধু ছবি তোলার কাজ হলে আমি কখনওই এত বছর ধরে একই অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার কথা ভাবতামও না। কারণ রিপিট ছবির ধারাবাহিকতা আমার অত্যন্ত অপছন্দের। সেদিক থেকে ২১শে জুলাই কোনও ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান একেবারেই নয়। চেনা ছবি চেনা মুহূর্ত। তবুও আমি হাজির হই।
কী অমোঘ টানে লাখো মানুষ এদিন ওই সাধারণ মেয়েটির ভাষণ শুনতে পাড়ি জমায় কলকাতায়। এ কোনও সহজ কথা নয়। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে ভরসার, স্নেহের, ভালবাসার। আমিও তাঁদেরই দলে। হয়তো আমার পরিচয় এক ছবিওয়ালার তবুও তিরানব্বয়ের সেই রক্তাক্ত দিনে ট্রাফিক পোস্টে বসে থাকা মেয়েটির সঙ্গ আমি আজও ছাড়তে পারিনি। স্নেহ নাকি মায়া, বলতে পারি না। কিন্তু এক বাঙালি নারীর পায়ে পায়ে বিপ্লবের সাক্ষী হওয়াটা যে ভীষণ গর্বের।
আমরা সকলেই জানি, এরকমই এক ২১শে জুলাই ১৯৯৩-এ রাইটার্স ঘেরাও অভিযান রণক্ষেত্র চেহারা নেয়। পুলিশের গুলিতে তেরোজন কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক মারা যান। কিন্তু দিদি ভীষণভাবে জখম হয়েছিলেন। খুব অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছিলেন। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসার পরও বাড়ি ফিরে বেশ কিছুদিন লাগে সুস্থ হয়ে উঠতে। তবে একটু হাঁটাচলা করার মতো পরিস্থিতি হতেই মাথায় ব্যান্ডেজ ও ভাঙা হাত নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।
আরও পড়ুন-প্রয়াত সৌদির ‘ঘুমন্ত’ রাজকুমার
সেই তারপর থেকেই ২১শে জুলাই শহিদ দিবস পালন করতে করতে এতগুলো বছর কীভাবে পার হয়ে গেল কখনও হিসাবই করিনি। জানি না ভারতবর্ষে এমন কোনও আন্দোলনকে নিয়ে এত বড় একটা সমাবেশ হয় কি না। তবে ফি বছর বাংলার এটা স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত।
এই সমাবেশ একবার শুধু ব্রিগেডে হলেও ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের কাছেই প্রতিবার হয়ে এসেছে। অন্যান্যদিন অফিস-কাছারি, বাজার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত চেনা ধর্মতলা চত্বরে এদিন বাস-ট্রাম, অফিস বন্ধ হয়ে যায়। এটা নিয়ে আগে আগে বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখা হলেও মানুষের আবেগের জনসুনামিতে সেসব কর্পূরের মতো উবে যায় বলেই সংবাদ মাধ্যমও ফোকাস করে এই বিশেষ দিনে কর্মীদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বার্তা দেন…
এইসবের মাঝে ১৯৯৩-এর ঘটনার সময় আমি যেমন ছিলাম আজও ঠিক তেমনি আছি। প্রতিটি ২১শে জুলাই আমিও হাজির থাকি সকাল থেকে। দেখতে গেলে আমার কাছেও এটা রেকর্ড যে আমার ক্যামেরাতে বন্দি ৩৩ বছর ধরে ২১শে জুলাই। এমনকী সাদা বাড়ির কালো গ্রিলে (আনন্দবাজার পত্রিকা) থাকাকালীন বহু সময় ২১শে জুলাই মূল স্টেজে অন্য চিত্র সাংবাদিক থাকলেও আমি এই বিশেষ দিনটার ছবি কিন্তু ছাড়িনি। মূল স্টেজের ছবি না তুললেও ঘুরে ঘুরে ভিড়-সহ নানান মুহূর্তের ছবি তুলে গেছি। আবার কখনও এক ফাঁকে স্টেজে দিদির ছবিও তুলে এসেছি।
২০১৪ থেকে মুখ্যমন্ত্রী দফতরের ছবি তুলি বলে আমার সৌভাগ্য হয় এখন মূলমঞ্চ থেকে ছবি তোলার। সেই ছবি দিদির নির্দেশে সব কাগজকে দিতে হয়।
২০১১ সালে দিদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তো এটা কভারেজের শীর্ষে থাকে প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে।
সত্যি বলতে সেই কোন ছোটবেলায় পড়াশোনার জন্য আমি বর্ধমানের সবুজ মাঠ-ঘাট, খেত, পুকুরের পাড় ছেড়ে বীরভূমের রুক্ষ শুষ্ক ঊষরতাকে সঙ্গী করে কলকাতার বাসিন্দা হলেও আজও শিকড়হীন। কিন্তু এই একটি মাত্র জায়গায় আমি থমকে যাই। কত বকা খাই, মুখ্যমন্ত্রী দফতরের অত্যন্ত কাজের ব্যস্ততায় কখনও কখনও রাগ হয় তবুও ওই মানুষটির প্রতি প্রথমদিন থেকেই জন্মানো এক অসম্ভব শ্রদ্ধা দিনের শেষে সবকিছু ম্লান করে দেয়।
চিত্র সাংবাদিক হিসাবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় কত আন্দোলন দেখেছি। নেতা তৈরি হতে দেখেছি। আবার হারিয়েও যেতে দেখেছি। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে লড়াকু মেয়েটিকে দেখে আসছি এখনও পর্যন্ত তাঁর সেই মনোভাবের কোনও পরিবর্তন দেখিনি। মানুষ ওঁর এই দায়বদ্ধতাকে বিশ্বাস করে বলেই প্রতিবার ২১শে জুলাই হাজির হয় কলকাতায়। আমিও আমার দায়বদ্ধতা থেকেই ছবি তুলে আসছি যা আমার কাছে অত্যন্ত গৌরবের।