জমে উঠেছে বইমেলা

বিধাননগর বইমেলা প্রাঙ্গণে চলছে ৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। স্টলে স্টলে ভিড়। নতুন বইয়ের গন্ধে ম-ম করছে চারদিক। মেলবন্ধন ঘটছে লেখক-পাঠকের। বইকে ঘিরে যেন এক মহোৎসব। মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

এবারের কলকাতা বইমেলা অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। সুন্দর। প্রচুর স্পেস। হাঁটাচলার অসুবিধা নেই। প্রথমদিন থেকেই সেজে উঠেছে প্রতিটি স্টল। নতুন বইয়ের গন্ধে ম-ম করছে চারদিক। এই শীত অসহনীয় নয়। উপভোগ্য। কামড় নেই, আদর আছে। দিব্যি গায়ে মেখে নেওয়া যায়। দিনে দিনে মেলায় বেড়েই চলেছে পাঠকের সংখ্যা। বিনোদনের নানা উপাদান থাকা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্ম যে যথেষ্ট বইমুখী, সেটা আবারও প্রমাণিত।

আরও পড়ুন-জলসমস্যা মেটাতে ৬০ কোটি বরাদ্দ হবে দুটি নয়া জলাধার, বসছে পাইপ

জাগোবাংলা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ পাবলিশিং, পত্রভারতী, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন, দীপ প্রকাশন, করুণা প্রকাশনী, দেবসাহিত্য কুটির প্রভৃতি স্টলে প্রতি বছর উপচে পড়ে ভিড়। এবারও হচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক। আশ্চর্যের বিষয়, বেশকিছু নতুন প্রকাশন সংস্থার স্টলেও ভিড় জমাচ্ছেন বহু উৎসাহী পাঠক। বইও কিনছেন। তাও আবার নতুন লেখকদের। অচেনাকে চেনার জন্য। অজানাকে জানার জন্য। বহু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বর্তমানে প্রকাশনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। মেলায় সাজিয়ে বসেছেন পসরা। বই বিক্রির পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। মেলার আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সাধারণ সম্পাদক সুধাংশুশেখর দে জানিয়েছেন, এবারের বইমেলায় সর্বাধিক প্রকাশক ও লিটল ম্যাগাজিন অংশগ্রহণ করছে। ১০০০-এর বেশি। আবেদন এসেছিল আরও অনেক। সবাইকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলা প্রকাশনা শিল্পে যে নতুন জোয়ার এসেছে, সেটা মেনে নিতেই হবে।
২৮ জানুয়ারি, ৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন বিশিষ্টজনেরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক আবুল বাশারকে গিল্ডের জীবনব্যাপী সাহিত্য সম্মান পুরস্কার, যার অর্থ মূল্য ২ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। মেলায় বরিষ্ঠ নাগরিক দিবস, ‘চিরতরুণ’ পালিত হবে ৪ ফেব্রুয়ারি। সম্মাননা প্রদান করা হবে কবি জয় গোস্বামী, প্রকাশক রঞ্জন সরকার এবং পাঠক সত্যব্রত ঘোষালকে।
এবারের ফোকাল থিম কান্ট্রি জার্মানি। এসেছেন ওই দেশের প্রায় পঞ্চাশজন প্রতিনিধি। জার্মানি স্টলটা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে। ঘুরে দেখছেন বহু পাঠক। জার্মানি ছাড়াও অংশ নিয়েছে ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, স্পেন, পেরু, আর্জেন্টিনা, গুয়াতেমালা-সহ অন্যান্য দেশ। আছে বহুজাতিক প্রকাশনা সংস্থা এবং ভারতের প্রায় সব রাজ্যের প্রকাশনা সংস্থা।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় বাজেটে চা-শিল্পের কোনও উচ্চবাচ্য নেই, হতাশ চা-শিল্পমহল

মোট ৯টি গেট। প্রধান গেট সলিল চৌধুরি এবং ঋত্বিক ঘটকের নামে। এছাড়াও আছে গ্যোয়েটে গেট, ম্যাক্সমুলার গেট, জার্মান স্থাপত্যের অনুকরণে দুটি গেট, বিশ্ববাংলা গেট, জীবনানন্দ দাশ ও কাজী নজরুল ইসলাম গেট। সরণির নামকরণ হয়েছে রিলকে, ব্রেকট, কাফকা, মুলার এবং অন্যান্যদের নামে। এছাড়াও কয়েকটি সরণির নামকরণ করা হয়েছে বাংলা এবং ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাহিত্যিকদের নামে।
নজর কেড়েছে ম্যাসকট, দুটি হাঁস, হাসো ও হাসি। এবারের মেলাতেও আছে লটারি– বই কিনুন লাইব্রেরি জিতুন। ১৫ জন ভাগ্যবান বিজেতারা প্রতিদিন পাচ্ছেন ১০০০ টাকার বুক গিফট কুপন। বইমেলার অ্যাপ প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাচ্ছে। এই অ্যাপটি তৈরি করেছে সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি। অ্যাপের মাধ্যমে গুগল লোকেশন অনুযায়ী মেলার মধ্যে যে কোনও স্টল খুঁজে পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। মেলার বিভিন্ন স্থানে আছে কিউ আর কোড, যা স্ক্যান করে অ্যাপ এবং ম্যাপ ডাউনলোড করা যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে বেড়েছে বিষয়ভিত্তিক বইয়ের চাহিদা। ফলে বেরোচ্ছে নানা ধরনের বই। প্রবন্ধের বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ অনেকটাই বেড়েছে। বিক্রি বেড়েছে কবিতা-ছড়ার বইয়েরও। গল্প-উপন্যাসের চাহিদা আগের মতোই আছে।
পুরনো ক্লাসিকগুলোর প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি। সেইসঙ্গে রমরমিয়ে বিকোচ্ছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শংকর, বাণী বসু, অমর মিত্র, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, নবকুমার বসু, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ, সুবোধ সরকার, প্রচেত গুপ্ত, জয়ন্ত দে, দীপান্বিতা রায়, সৈকত মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায়, দেবারতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নতুন বই। জাগোবাংলা স্টলে উৎসাহের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই কিনছেন পাঠকরা। পাশাপাশি উপভোগ করছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গ মণ্ডপটিও রয়েছে আকর্ষণের কেন্দ্রে।

আরও পড়ুন-বিরাট-আবেগ নিয়ে রেলকে হারাল দিল্লি

প্রায় ২০০ লিটল ম্যাগাজিন অংশ নিচ্ছে। কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। আরাত্রিক, পুরবৈয়াঁ, ইসক্রা, বনানী, নৌকো, বনপলাশি, লুব্ধক প্রভৃতি পত্রিকার টেবিলে ভিড় জমাচ্ছেন অনেকেই। বিক্রিবাটা হচ্ছে ভালই। ভাষানগর পত্রিকার কবিতার গাড়ি ঘিরেও চোখে পড়ছে উন্মাদনা। মেলার মঞ্চে প্রতিদিন আয়োজিত হচ্ছে অনুষ্ঠান। প্রকাশ পাচ্ছে নতুন নতুন বই। কবিতাপাঠ ও আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন কবি ও সাহিত্যিকরা। শনিবার, এসবিআই অডিটোরিয়ামে ছিল আজকাল-এর বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান। বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মেলার মাঠে মেলবন্ধন ঘটছে লেখক-পাঠকের। প্রিয় লেখকদের দেখে অনেকেই তুলছেন সেলফি। কেউ কেউ নতুন বইয়ের পাতায় নিচ্ছেন লেখকের অটোগ্রাফ। মেলার মাঠে বই উপহারের মধ্যে দিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন সম্পর্ক। চোখে চোখ। হাতে হাত। সবমিলিয়ে জমে উঠেছে কলকাতা বইমেলা। বইকে ঘিরে চলছে এক মহোৎসব। ওই ডাকছে বই। চটপট সাড়া দিন। বিধাননগর বইমেলা প্রাঙ্গণে এই মেলা চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

Latest article