প্রচারের ঢাক বেজেই চলেছে, কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে কই?

রঙিন স্লোগান দেওয়া ও ছবি তোলা ছাড়া যুব সম্প্রদায়ের কাজ তৈরির জন্য মোদিজি কী করেছেন? প্রশ্ন উঠছে, প্রশ্ন উঠবেই। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় করবা চৌথ পালন করেছিলেন স্ত্রী। কয়েক ঘণ্টা পর নিজেই খাবারে বিষ মিশিয়ে স্বামীকে খুন করলেন। উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বী জেলায় এক মহিলার বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে এই সংবাদ প্রকাশিত। ঠিক একই ঘটনা ঘটে চলেছে ভারতে, বেকারত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে। মোদি সরকার ব্রত নিয়েছে বেকার কমানোর। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
অজৈবিক প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর হয়ে ঢাক পেটানো অর্থনীতিবিদেরা কাজহীন (জবলেস) আর্থিক বৃদ্ধির অভিযোগকে এক নাগাড়ে আক্রমণ করে চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে ২০১৪ সাল থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে, তা এই নিয়োগহীন আর্থিক বৃদ্ধির থেকেও ভয়ানক। সেটা হল, কাজ হারানোর বা জবলসের আর্থিক অঙ্কে বৃদ্ধি। অস্বীকার করার উপায় নেই, তৃতীয় দফার মোদি সরকারের প্রথম ১০০ দিনের শেষে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত সেটা হল, সরকারি স্তরে একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে তা প্রত্যাহার এবং পাশাপাশি দেশের বিশাল বেকারত্বের সমস্যা মোকাবিলায় চরম ব্যর্থতা।

আরও পড়ুন-কানাডা-ভারত দ্বৈরথের মাঝে মুম্বই হামলার চক্রীকে প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু

বেকারত্বের এই সমস্যা মোদি সরকারের নিজেরই তৈরি। সব থেকে বেশি কর্মসংস্থান হয় যে শিল্পে, সেই ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলির (এমএসএমই) সর্বনাশ ডেকে এনেছে মোদি সরকারের নোটবন্দির মতো ‘তুঘলকি’ সিদ্ধান্ত। তাদের ক্ষতি করেছে তাড়াহুড়ো করে চালু করা জিএসটি, অতিমারির সময় পরিকল্পনাহীনভাবে লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া এবং চিন থেকে আমদানি বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি। বড় শিল্পের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কেন্দ্রের আর্থিক নীতিও ছোট শিল্পের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে। যার নিট ফল হিসাবে ২০১৯-’২২ সালের মধ্যে দেশে বেকারত্ব ৪২% থেকে বেড়ে রেকর্ড ৪৫.৪ শতাংশে উঠেছে। বর্তমানে স্নাতক বেকারদের হার ৪২%। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) ২০২৪ সালের রিপোর্টের তথ্য বলছে, প্রতি বছর ৭০-৮০ লক্ষ প্রার্থী কাজ খুঁজতে বেরোচ্ছেন। কিন্তু ২০১২-’১৯ সালের মধ্যে কর্মসংস্থান বেড়েছে ০.০১%। সিটিগ্রুপের রিপোর্ট বলছে, সকলকে কাজ দিতে হলে বছরে ১.২ কোটি চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। আইএলও-র রিপোর্টই জানাচ্ছে, মোদি সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাহীন অতি কম মজুরির কাজের সংখ্যা বাড়িয়েছে। অন্য দিকে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান ২০১৯-’২১ সালের মধ্যে ১০.৫% থেকে কমে হয়েছে ৯.৭%। সিটিগ্রুপও বলেছে, মাত্র ২১% কর্মী বেতনভুক। এক কথায়, নিয়মিত বেতন মেলে, এমন চাকরি ক্রমশ কমছে।

আরও পড়ুন-আইটিআই প্রশিক্ষণের পরীক্ষায় দেশের সেরার মধ্যে ১১ জন বাংলার, শুভেচ্ছাবার্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি ১০ বছরেও। কয়েক মাস আগে শেষ হওয়া লোকসভা ভোটে এই অস্ত্রেই বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়ের স্বপ্ন ভেঙে খানখান করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস-সহ অন্য বিরোধীরা। চন্দ্রবাবু নাইডু আর নীতীশ কুমারের কাঁধে ভর করে তৃতীয়বার সরকারে ফিরেছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সেই ধাক্কার পরও দেশের কর্মসংস্থানের ছবিতে বদল এল না। ফের বাড়ল বেকারত্বের হার। শুধু বাড়েনি, গত আট মাসে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গিয়েছে। এমনই উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র সমীক্ষা রিপোর্টে। তাদের দাবি, গত জুন মাসে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৯.২ শতাংশ। তার আগের মাসে (মে) তা ছিল ৭ শতাংশ। অর্থাৎ একমাসের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। এমনকী ২০২৩ সালের জুনের পরিসংখ্যানকেও (৮.৫ শতাংশ) তা ছাপিয়ে গিয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে দেশের আর্থিক অবস্থার হাল নিয়ে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও বেহাল। তা স্পষ্ট হয়েছে সিএমআইই-র কনজিউমার পিরামিডস হাউসহোল্ড সার্ভেতে। সেই রিপোর্ট বলছে, গত মে মাসে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৬.৩ শতাংশ। জুনে তা একধাক্কায় বেড়ে ৯.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বছর এই মাসে তা ছিল ৮.৮ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের বেকারত্বের হার মে মাসে ছিল ৫.৪ শতাংশ। জুনে তা বেড়ে ৮.২ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা একধাক্কায় পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মে মাসে তা ছিল ১২ শতাংশ। সেটা জুনে ১৭.১ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকারি তথ্য বলছে, শহরকে ছাপিয়ে গ্রামীণ অঞ্চলে রকেটের গতিতে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতি নির্ধারণ কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। তার মধ্যেই এবার রোজগারের সুযোগের অভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সংসারে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার খুব বেশি বাড়েনি। গত মে মাসে শহরে এই হার ছিল ৮.৬ শতাংশ। জুনে তা হয়েছে ৮.৯ শতাংশ। গ্রামের মতো শহরেও মহিলাদের বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়েছে। মে মাসে ছিল ১৮.৫৩। জুনে বেড়ে হয়েছে ২১.৩৬ শতাংশ। সারা দেশের হিসেবে মহিলাদের কর্মহীনতার হার জুনে ছিল ১৮.৫ শতাংশ। এখন নিয়মিত কর্মরতা মহিলাদের হার সাত বছরে কমে কর্মী বাহিনীর ১৫.৯ শতাংশে ঠেকেছে। উল্টে গ্রামে বেড়েছে মজুরিহীন মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা। যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দৈন্য স্পষ্ট করে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন-তদন্ত না করেই সিদ্ধান্ত, হাইকোর্টে ৫৯ ডাক্তারের সাসপেনশন স্থগিত

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে রোজগারের অভাব সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যদিনের সংসার-জোয়াল টানতে রীতিমতো কালঘাম ছুটছে মানুষের। সরকারি তথ্যেই জানা গিয়েছে, পারিবারিক সঞ্চয়ের পরিমাণ রেকর্ড হারে কমেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধারদেনার বোঝা। সম্প্রতি ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের (এনএসও) সমীক্ষাতেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের বেহাল ছবি দেখা গিয়েছে। এমনকী তা কোভিড পর্বের আগের পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি। বেকারত্ব এখন দেশের গভীরতম সমস্যা। যেসব মানুষের কাজ ‘ছিনিয়ে’ নেওয়া হয়েছে, তাঁরা আগামী দিনে সমস্ত নির্বাচনে বিজেপিকে উপযুক্ত জবাব দেবেন। তৈরি থাকুক পদ্মফুল।

Latest article