‘আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে, সালটা ২০১৬। ১৬ নভেম্বর পুরো দিল্লি এনসিআরে বায়ুদূষণের কারণে সূর্যের কোনও আলো দেখা যাচ্ছিল না, ঘন কালো কুয়াশার আস্তরণ সমগ্র দিল্লি শহরকে গ্রাস করে নিয়েছিল। শহরের সব স্কুল-কলেজ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
আরও পড়ুন-পরিস্থিতি অনুকূল মঙ্গলেই বর্ষার প্রবেশ দক্ষিণে
উক্তিটি দিল্লি-নিবাসী ভভরিন কান্ধারির। ভভরিন ১৯৯৫ সাল থেকেই দিল্লির বায়ুদূষণের প্রাবল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মাঝেমধ্যেই যখন নিউ ইয়র্ক যেতেন তখন তিনি চনমনে হয়ে উঠতেন। বুঝতেন এটা সেখানকার পরিস্রুত জল আর হাওয়ার গুণ। কিন্তু ২০০২ সালে প্রি-ম্যাচিওর যমজ শিশুর জন্ম দেওয়ার পর তাঁর জীবনটাই বদলে যায়। বহুদিন বাচ্চাদের নিয়ে হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে। জন্মের প্রথম বছর থেকেই বাচ্চাদের কাশি, সর্দি লেগেই থাকত। অথচ ছুটি কাটাতে ভভরিন যখন বাচ্চাদের নিয়ে প্রত্যেকবার নিউ ইয়র্ক চলে যেতেন তখন কোনও সমস্যা হত না। এর কারণ ছিল বাতাসের গুণমানের তফাত। এই ঘটনা ভভরিনকে ভাবায়। তিনি উপলব্ধি করেন দূষণ প্রতিরোধের সচেতনতা মূলক কর্মসূচি গড়ে না তুললে সমূহ বিপদ। ইতিমধ্যেই ভভরিন প্যান ইন্ডিয়ার বহু পরিবেশ সচেতনতামূলক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরিবেশ বাঁচাতে সমাজের, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। একবার ভভরিন-সহ অনেক সংগঠন মিলে সংসদ ভবনের অদূরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এরপরেই দেখা গেল কোভিড-১৯-এর সময় সবকিছু বন্ধ থাকায় বায়ুদূষণ-সহ অন্য দূষণের মাত্রাও অনেক কমে গেছে। শুধু ভভরিন নয়, তাঁর মতোই ওই এলাকার অনেক মা-ই একইসঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন যে সন্তানকে সুস্থ নীরোগ ভবিষ্যৎ দিতে হলে সচেতনতার এবং প্রচারাভিযান জরুরি। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বিপন্ন হবে লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন।
তাই শুধু নিজের সন্তান নয়, গোটা ভারতের শিশুদের জন্য দূষণমুক্ত পরিষ্কার বাতাস বা ক্লিন এয়ার জোগানের লক্ষ্য আর ভাবনা থেকেই দশজন যোদ্ধা মা গড়ে তোলেন ‘ওয়ারিয়ার মম’স । প্রায় ২০ বছর আগে দশজন মহিলা সদস্য নিয়ে তৈরি হওয়া ভলান্টারি অরগাইনাইজেশন ‘ওয়ারিয়ার মম’স-এর লক্ষ্য, তাঁদের আন্দোলন একদিন ভারতবর্ষের ১৩টির বেশি রাজ্যের ৭৫টা গ্রাম এবং শহরাঞ্চলের ১৭০০-র বেশি মহিলার লক্ষ্যে এবং আন্দোলনে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন-রাজ্যের কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্প এবার মিলবে দুবাইয়ে
ভভরিন ছাড়া ‘ওয়ারিয়ার মম’সের কোর গ্রুপের অন্যতম সদস্যা হলেন নীনা সুব্রুমানি। যিনি একজন ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার। ছাত্রজীবন থেকেই বায়ুদূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন নীনা। হঠাৎ করেই হাঁপানিতে আক্রান্ত হন। শুধু তাই নয়, নীনার মেয়েও শৈশব থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যার শিকার। ফলে এই সংগঠন তাঁকে একটা প্ল্যাটফর্ম দেয় মা হিসেবে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে কিছু করার।
ওয়ারিয়র মম’স-এর অপর কো-ফাউন্ডার মিধিলি রবিকুমার দীর্ঘদিন যাবৎ বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। পরিবারের এক নিকট-আত্মীয়ের ক্যানসার ধরা পড়ার পরে তিনি উপলব্ধি করেন বায়ুদূষণ এবং পরিবেশগত অনেক কারণ রয়েছে যা ক্যানসারকে ত্বরান্বিত করে। বায়ুদূষণ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলাই এখন তাঁর একমাত্র প্রচেষ্টা।
‘ওয়ারিয়র মম’স শেরবানু বা শেরি একজন সাইকেল আরোহী। পরিবেশ দূষণ আটকাতে এই দ্বিচক্রযানটির গুরুত্ব বোঝাতে সারাক্ষণ সাইকেল নিয়ে চলাফেরা ছিল তাঁর। এছাড়া নিজের কমিউনিটির খুব অ্যাকটিভ কর্মী শেরি। বিভিন্ন সমাজসচেতনতামূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন শুরু থেকেই। দুই সন্তানকে অদূর ভবিষ্যতে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন শেরি।
এছাড়া ‘ওয়ারিয়র মম’স কোর গ্রুপে অন্য কারিগররা হলেন অনুজা, লীনা বুদ্ধে, আশা, গশামিতা, মনোরমা এবং গার্গী। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য এক— ক্লিন এয়ার।
বায়ুদূষণ কেন এত গুরুতর সমস্যা? বিভিন্ন গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে বায়ুদূষণ যত বাড়বে, ততই নাকি কমবে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি। বিশেষ করে শিশুদের। গবেষকদের দাবি, শব্দদূষণের প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি প্রকট বায়ুদূষণের প্রভাব। বায়ুদূষণ বাড়লে শিশুদের মানসিক এবং মস্তিষ্কের বিকাশ অনেকটাই কমতে থাকে সেই সঙ্গে কমতে থাকে তাঁদের বিপাকীয় হারও। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাথন গ্রিগ এবং তাঁর সহকর্মীরা ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে মানবভ্রূণে বায়ুবাহিত দূষিত কণার উপস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন। পরে তা প্রমাণিতও হয়।বায়ুদূষণে গর্ভস্থ শিশুরাও বিপন্ন।
আরও পড়ুন-পর্যটকদের উদ্ধারে সেনা তলব সিকিমে
শুধু তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এমন নয় গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে ফুসফুস এবং যকৃতের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উল্লেখ করেছে পাঁচবছরের কমবয়সি শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও ভয়ের বিষয় হল, বিশ্বের দূষণ তালিকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। আবার বায়ুর গুণমানের নিরিখে নয়াদিল্লি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী। যার প্রভাব পড়ছে রাজধানীর নাগরিকদের স্বাস্থ্যে। সমীক্ষা অনুযায়ী সেখানকার বিষাক্ত বাতাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর ফুসফুস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু দিল্লি নয়, ভারতের প্রায় ৯৮ শতাংশ শিশু বিষাক্ত বাতাস নেয়। যার ফলে ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিস জাতীয় অনেক অসুস্থতা বাড়ছে তাঁদের মধ্যে। শিশুদের যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত রাখতে হবে এই সাবধানবাণী দিয়েছেন বিজ্ঞানী মহল।
সেই প্রাণঘাতী বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে এবং শিশুদের জন্য পরিষ্কার বাতাস এবং সবুজায়নের পক্ষে ‘ওয়ারিয়র মম’স হল যোদ্ধা মায়েদের এক অনন্য লড়াই বা অভিযান। এই সংগঠনের প্রাথমিক কাজ হল বায়ুদূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে গণ-সচেতনতা তৈরি এবং সেই পদক্ষেপ নিতে প্রথমে শিক্ষিত নাগরিক তৈরি করা।
আরও পড়ুন-নিট মামলায় এনটিএকে নোটিশ সুপ্রিম কোর্টের
‘ওয়ারিয়র মম’স-এর যোদ্ধা মায়েরা বুঝেছিলেন যে বায়ুদূষণ কেবল শহুরে সমস্যা নয়। এটা গ্রামীণ সমস্যাও। তাই তাঁরা গ্রামীণ ভারতের এমন মহিলাদের কাছে পৌঁছে যান যাঁরা ইতিমধ্যেই স্বচ্ছভারত অভিযানে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। ওই মহিলাদের বায়ুদূষণ, শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব, খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানোয় ক্ষতিকর প্রভাব, ঘরের মধ্যেও বায়ুদূষণের মোকাবিলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। সেই সঙ্গে সৌর চুল্লি, এলপিজি গ্যাস, ধোঁয়াবিহীন চুল্লির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করান। যাতে সেই মহিলারা গ্রামের বাদবাকিদের এই বিষয়ে সচেতন করতে তুলতে সক্ষম হয়।
এই মুহূর্তে দিল্লি, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড,পাঞ্জাব, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, কোচি, পুণে, হায়দরাবাদেও গড়ে উঠেছে ‘ওয়ারিয়রস মম’স-এর দল। শহর থেকে গ্রামীণ ভারতের ভ্রমণ এবং বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে শিশুর ভবিষ্যৎ রক্ষাই যাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য।