সন্তানের নাম রেখেছিলেন পত্রিকার নামে

তারাপদ রায় মূলত কবি। পাশাপাশি লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। সম্পাদনা করেছেন দুটি লিটল ম্যাগাজিন। আজ প্রয়াণদিবসে তাঁকে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ঘোরতর সংসারী
কবি ছিলেন। সেইসঙ্গে ঘোরতর সংসারী। নিজেই বলেছেন, তাঁর জীবন কোনও কবির জীবন নয়। বরং আর পাঁচজনের মতোই সামান্য গৃহস্থের সংসার। তিনি তারাপদ রায়। কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন রম্যরচনা, অজস্র গল্প, উপন্যাস। রসসাহিত্যে ও শিশু সাহিত্যে বেশ গতিশীল ছিলেন। তাঁর ‘ডোডো-তাতাই’ বিখ্যাত শিশু চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে সার্থক রম্যরচয়িতা হিসেবে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে ছিলেন সমাদৃত।
বন্ধুদের ছায়ায় ঢাকা
সাহিত্য জগতে তাঁর বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গে করেছেন তুমুল মাতামাতি। আবার ডুব দিয়েছেন সংসারে। মেপে চলা যাকে বলে, সেটাই করেছেন সারা জীবনে। কেউ কেউ বলেন, বিখ্যাত বন্ধুদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন তারাপদ রায়। তাই কি? সত্যিই কি তিনি খ্যাতি পাননি? অবশ্যই পেয়েছেন। আসলে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। তাঁর রচনাও ভিন্ন স্বাদের। তুলনা না টেনেই বলা যায়, মানুষের ভালবাসা যথেষ্টই পেয়েছেন। পেয়েছেন সমঝদার পাঠকের সমাদর। কলকাতা বইমেলায় তাঁকে ঘিরে উৎসাহ চোখে পড়েছে। চেয়ারে বসে দিয়ে যেতেন অটোগ্রাফ।

আরও পড়ুন-স্কুল চলাকালীন পড়ুয়াদের নিয়ে মিছিলেই আপত্তি

তুমুল হুল্লোড়বাজ
সদালাপী মানুষটি বন্ধুমহলেও ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। তুমুল হুল্লোড়বাজ। গলার স্বরে ছিল দাপট। জমিয়ে গল্প বলতে পারতেন। একটা সময় তাঁর বাড়িতেই বসত বন্ধুদের আড্ডা। প্রত্যেকের চোখে স্বপ্ন। কবিতা, গল্প, আড্ডা এবং হুল্লোড়ে জমে থাকত আসর। মাঝেমধ্যে হাজার ভিড়ে একা হয়ে যেতেন। একটা আলাদা জীবনের বৃত্ত রচনা করেছিলেন নিজের ভিতরে। সহজ, সরল যাপনের মধ্যে দিয়ে। লিখতেন সাবলীল ভাষায়। প্রায় প্রতিটি লেখায় বুনে দিতেন নিজস্ব দর্শন।
স্বনামে এবং ছদ্মনামে
কবিতা রচনায় হাতেখড়ি বাল্য বয়সেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার প্রতিমা’। প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তখন মহিম হালদার স্ট্রিটেই থাকতেন। সেই কবিতার বইয়ের ভেতরেই থেকে গিয়েছিল মুদ্রণ প্রমাদ। ‘মহিম হালদার স্ট্রিট’-এর ‘মহিম’ বদলে যায় ‘মহিষ’-এ। যা নিয়ে পরে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি অনেকেই। স্বনামের পাশাপাশি লিখেছেন নক্ষত্র রায় এবং গ্রন্থকীট ছদ্মনামেও। কথ্যভঙ্গি এবং পরিহাস-বিদ্রুপ মিশ্রিত বাক্যধারার সমন্বয়ে বাংলা সাহিত্যে অর্জন করেছিলেন স্বাতন্ত্র্য। সরকারি অতিথি হয়ে ঘুরেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা-সহ বহু দেশে। শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা।
অষ্টাদশ অশ্বারোহী
‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য ছিলেন তারাপদ রায়। তিনি মনে করতেন, ‘কৃত্তিবাস’ শুধু কবিতার পত্রিকাই নয়, তার থেকে আরও অনেকটা বেশি, বেঁচে থাকা কিংবা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অনিবার্য হয়ে উঠেছিল গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে। একবার ‘কৃত্তিবাস’-এর একটি সংখ্যায় আঠারোটা কবিতা লিখেছিলেন তিনি। নাম রেখেছিলেন ‘অষ্টাদশ অশ্বারোহী’। ছাপানোর সময় হঠাৎ দেখা যায়, আঠারো নয়, আসলে সতেরোটা কবিতা আছে সেখানে। এখন উপায়? শেষে ১৮ নম্বর কবিতার ফাঁকা জায়গায় একটি ঘোড়ার ব্লক দিয়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-হয়রানি বাড়াচ্ছে জুনিয়র চিকিৎসকরা, ক্ষুব্ধ মানুষ

মজার মানুষ
ভেতরে ভেতরে ছিলেন দারুণ মজার মানুষ। সেই কারণেই লিখতে পেরেছিলেন দুর্দান্ত রম্য রচনাগুলো। বন্ধুদের লেখা চিঠির ভেতরেও ভরে দিতেন মজার কথা। সেই লেখাও হয়ে উঠত পড়ার মতো। হাসির মধ্যেও কেমন একটা কাব্যময়তা ছড়িয়ে থাকত সেখানে। ১৯৬৫ সালে টাঙ্গাইল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতেই মেলে তার ইঙ্গিত। আগে তারাপদ রায় বেশ অসুস্থ ছিলেন, চিঠি থেকে সেটা বোঝা যায়। তিনি সুনীলকে লিখছেন ‘এখন দু-একটা নীরস সংবাদ দিতে পারি। মধ্যে চৌদ্দদিন যাকে বলে মনে হচ্ছিল সারা শরীরে যেন পঁচিশটা মৌমাছির চাক বসেছে। বর্তমানে ভালো হয়ে গেছি, তবে একেবারে চিতাবাঘের মতো, পাকা কাঁঠালের মতো চিত্রবিচিত্র হয়ে গেছি। ইচ্ছে হলে নিজেকে এখন সচিত্র তারাপদ রায় বলে বিজ্ঞাপিত করতে পারি।’ নিজের শরীরের অবস্থার এমন ‘সচিত্র’ বর্ণনা দিতে একমাত্র তিনিই পারতেন। প্রসঙ্গত, তারাপদ রায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর, টাঙ্গাইলে।
আগ্রহী এবং কৌতূহলী
কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় শিক্ষকতা করেছেন। তারপরে যোগ দেন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে। ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নেন। সম্পাদনা করেছেন দুটি লিটল ম্যাগাজিন, ‘পূর্ব মেঘ’ ও ‘কয়েকজন’। দুটি পত্রিকাই পাঠকমহলের ভালবাসা পেয়েছে। তবে তাঁর জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল ‘কৃত্তিবাস’। নিজের সন্তানের নামও রেখেছিলেন প্রাণাধিক প্রিয় পত্রিকার নামে। স্ত্রীর কথা নানা সময় তাঁর নানা কবিতায় এসেছে। তিনিও তো জীবনেরই অংশ ছিলেন। ‘ভালোবাসার কবিতা’ও উৎসর্গ করেছিলেন স্ত্রী মিনতি-কে। ছিলেন খাদ্যরসিক। খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসতেন। ২০০৭-এর ২৫ অগাস্ট, ৭০ বছর বয়সে প্রয়াত হন তারাপদ রায়। তাঁর বিভিন্ন রচনা আজও আগের মতো উৎসাহের সঙ্গে পড়েন পাঠকরা। নতুন প্রজন্মও তাঁকে নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী, কৌতূহলী।

Latest article