জেলে পাড়ার সঙ

চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলার নানা জায়গা থেকে সঙ বের হয়ে থাকে। এইসব সঙ শিল্পী বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি এবং মুখভঙ্গি করে ব্যক্তিগত সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা গান-ছড়া ইত্যাদির দ্বারা সকলের সামনে তুলে ধরত। বাংলার নানাস্থানে একাধিক সঙের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল জেলে পাড়ার সঙ। আর কলকাতার বুকেই ছিল সেই জেলেপাড়া। এই জেলেপাড়ার সঙদের নিয়েই লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

চৈত্র মাসের সঙেরা এখন শহর এবং শহরতলি থেকে প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে। একসময় বাংলার মানুষজনের মনোরঞ্জনের প্রধান উপাদান ছিল সঙদের অভিনয়। বাংলায় বুকে সেসময় সঙদের বহু দল ছিল। একটা-একটা পাড়া অনুযায়ী সেই দলের নাম একেকটা নাম হত। যেমন— কলকাতার জেলে পাড়ার সঙ, কাছারিপাড়ার সঙ, আহিরীটোলার সঙ, বেনেপুকুরের সঙ, মেদিনীপুরের সঙ, বীরভূমের সঙ, শ্রীরামপুরের সঙ ইত্যাদি ইত্যাদি। একেক জায়গার সঙদের গানের ভাষা এক-এক রকমের হলেও সেগুলো খুব সহজ সরল ভাষায় লেখা হত যেটা সাধারণ মানুষের কাছে খুবই সহজবোধ্য ছিল। সেইসব গান বা ছড়ার ভাষাগুলো ছিল রঙ্গরসে ভরপুর। অনেকে আবার সেই সমস্ত ব্যঙ্গাত্মক রসপূর্ণ বিষয়বস্তুকে আরও কটাক্ষ করার জন্য বাংলার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে দিত।

আরও পড়ুন-আসানসোল জেলা হাসপাতালে চালু মা ক্যান্টিন , সবার সঙ্গে খেলেন মন্ত্রী

‘লেট মি গো ওরে দ্বারী, আই ভিজিট টু বংশীধারী
এসেছি ব্রজ হতে, আমি ব্রজের ব্রজো নারী’

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই কলকাতার বুকে সঙযাত্রা বের হত। চৈত্র মাসের চড়ক বা গাজনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই সঙ-সংস্কৃতি। সঙ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ভাঁড় তথা কৌতুক অভিনেতা হলেও এই সঙ আজকের বাঙালিদের কাছে ভুলতে বসা এক অধ্যায়। যেহেতু এই সমস্ত উৎসবের সূচনা গ্রাম-বাংলাতেই হত সেই কারণে সেইসব জায়গার প্রান্তিক সমাজের হাত ধরেই সঙের প্রচলন শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই প্রান্তিক সমাজের লোকজন যখন কাজের সন্ধানে কলকাতায় এসে উপস্থিত হয় তখন এদের হাত ধরেই কলকাতাতেও সঙদের আগমন ঘটে। প্রথমদিকে কলকাতার ভদ্র তথা বাবুসমাজ এই সঙ-শ্রেণির মানুষজনদের উপেক্ষা করলেও পরবর্তীকালে সেটা অনেকটাই সহজ-সরল ও স্বাভাবিক হয়ে যায়। আসলে এই সমস্ত প্রান্তিক শ্রেণির নিম্নবিত্ত মানুষরা কাজের খোঁজে কলকাতায় এসে জমিদার বাড়িগুলোর আশেপাশেই বসতি গড়ে তুলেছিল, আর তাদের সমস্ত উৎসবে তৎকালীন জমিদারদের যেমন উৎসাহ ছিল ঠিক তেমনি তাদের আর্থিক সাহায্যও করত। আসলে তৎকালীন জমিদাররা তাদের নিজস্ব প্রচারের জন্য এই সমস্ত সঙদের অভিনয়ের মাধ্যমকে ব্যবহার করত। আর সেই কারণে গ্রামীণ প্রান্তিক সমাজের এই সঙ-সংস্কৃতি শহরাঞ্চলে ব্যাপকতার রূপ নেয়।
কলকাতাতে সেইসময় এক-এক এলাকাতে এক-এক জীবিকার মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। কলকাতা শহরের জেলেপাড়া বলতে বোঝাত বউবাজার এবং ক্রিক রো-র মধ্যবর্তী অঞ্চল। পরবর্তী কালে এই সমস্ত জেলে সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তারা যে-যে জায়গা দিয়ে সঙ-মিছিল নিয়ে ঘুরত, সেই সমস্ত জায়গার নাম হয়ে গিয়েছিল জেলেপাড়া।
ঐতিহাসিক উপেন্দ্রনাথ বসুর লেখা থেকে জানা যায় প্রাচীন কলকাতার একটি ক্রিক, যাকে খাল বলা হয়, তার থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল ক্রিক রো। অনেক বছর আগে একটি খাল ক্রিক রো, ওয়েলিংটন স্কোয়্যার, বেন্টিং স্ট্রিট দিয়ে গিয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিশত। আর এই ক্রিক রোয়ে জেলেদের বসতি গড়ে উঠেছিল তার কারণ মনে করা হয় যে এখান যে খালটি ছিল তাতে এক সময়ে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত। আবার হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের কলকাতার সেকালের ও একালের বইটি থেকে জানা যায় যে এই খালটি ধাপা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরও জানা যায় যে সেই খালে শুধুমাত্র নৌকা নয়, জাহাজও চলত। জেলে পাড়ার জেলেরা শুধুমাত্র নৌকা করে গঙ্গায় নয়, জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরেও পাড়ি জমাত।
জেলে পাড়ার অনেক জেলেই সারেঙ অর্থাৎ জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল। সারেঙ শব্দটা ফরাসি সরহংগ থেকে এসেছে। মনে করা হয় এই সারেঙ থেকেই সঙ শব্দটা এসেছে। এই সমস্ত সারেঙ তথা সঙ-রা সমুদ্রযাত্রার পর ফিরে এসে তাদের অভিজ্ঞতার কাহিনি পাড়া ঘুরে ঘুরে গানের মাধ্যমে লোককে জানাত। এর সঙ্গে থাকত সমাজের অবক্ষয়ের কিছু বিদ্রোহী বুলি, যেগুলো তারা গানের স্লোগানের মাধ্যমেই দিয়ে থাকত। সমুদ্রযাত্রা শেষে ঘরে ফিরে চৈত্র সংক্রান্তিতে এই সঙরা জেলেপাড়া থেকে সঙযাত্রা বার করতেন। কালের বিবর্তনে সমুদ্রযাত্রা বন্ধ হলেও চৈত্র সংক্রান্তিতে সঙদের পরিক্রমা বন্ধ হয়নি।

আরও পড়ুন-প্রথম বাঙালি-মহিলা হিসেবে ইন্ডিয়ান আইডল কি মানসীই

এই জেলে পাড়ার থেকেই যে সঙদের মিছিল ঘুরত তাদেরকে জেলে পাড়ার সঙ বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই জেলে পাড়ার সঙদের অভিনয়ে কিন্তু শুধুমাত্র হাস্যরস ছিল না, এরা অভিনয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক দুর্নীতি ও অনাচার ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরত। আর তাই এদের অভিনয়ে প্রকাশ পেত এক ব্যতিক্রমী বার্তা। এরা যেমন দুর্নীতি ও অনাচারের উপর তীব্র ব্যঙ্গাত্মক আক্রমণ করতেন, ঠিক তেমনি এদের অভিনয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, উচ্চবর্ণের শোষণ এগুলো তুলে ধরা হত। আর সেই কারণে বারবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়েছে এই জেলে পাড়ার সঙদের। সেই সময়ে ঘটা নানা রকমের ঘটনা উঠে আসত জেলেপাড়ার সঙদের গান পথ-অভিনয়ের মাধ্যমে। এরা যেমন পণপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, ঠিক তেমনি সমাজের অবিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দায়িত্বশীল মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতেন। সে-সময় ইংরেজদের কুশাসন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধেও এই সঙ সমাজ গর্জে উঠেছিল। ১৯১৭ সালের চৈত্রসংক্রান্তির দিনে জেলে পাড়ার সঙেরা তাদের পালাগানের ছড়া ছাড়াও আরেকটি বিশেষ গান রচনা করেছিল। গানটির নাম ছিল ‘বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ’। সেইসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র চুরি হয়ে গিয়েছিল আর এই প্রশ্নপত্র চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল এই গানটি। গানটি ছিল—
‘বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে, সখিরা নেকি নাকি পড়ল ফাঁকি, কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে, গুণসিন্ধুযুত নব যুব রায় এই শহরে, মশান ভাসে নয়ন ঝোরে।’
এছাড়াও তীর্থস্থানগুলোতে থাকা নেশাখোর আর লম্পটদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এই জেলে পাড়ার সঙেরা। তাদের গানের মাধ্যমে এরা বলেছিলেন, ‘আগুনের জ্বালা ধরে অঙ্গে, দেখে দেখে পুণ্যভূমি সাধের বঙ্গে, রঙ্গিনী ভঙ্গিনী সঙ্গিনী সঙ্গে, ভদ্দর মদ্দরা যায় সাগরসঙ্গম স্থানে’।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ-বিরোধিতা করে লেখা হয়েছিল—
‘বিলিতি বেলয়ারি কর লো চুর, পুষনা পুষনা বিলিতি কুকুর, বিলিতি বাবুরে বাঁধলো চেনে’।
দুর্গাচরণ কুণ্ডুর আর্থিক সহায়তায় ও উদ্যোগে ১৮৮২ সালে শুরু হয়েছিল জেলে পাড়ার সঙদের সঙযাত্রা। এই জেলে পাড়ার সঙদের জন্য গান লিখতে শুরু করেছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী, গোপাল উড়ে, রসরাজ অমৃতলাল বসু, দাদাঠাকুরের মতন বিখ্যাতরা। অমৃতলাল বসু তাঁর কৌতুকপূর্ণ এবং সরস গান রচনার ভিতর দিয়ে জেলে পাড়ার সঙের আকর্ষণ ও গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৯০২ সালে বাংলার বুকে প্লেগ জাঁকিয়ে বসেছিল। আর সেই কারণে কয়েক বছর বন্ধ হয়ে যায় এই জেলে পাড়ার সঙদের সঙযাত্রা। এই সঙযাত্রা পুনরায় শুরু হয় ১৯১৩ সালে। এই সময় ফকিরচাঁদ গড়াই, জ্যোতিষচন্দ্র বিশ্বাসরা তৈরি করেন জেলেপাড়া সঙ সংগঠন সমিতি। জেলেপাড়ার সঙেরা উত্তর কলকাতার পুরোটাই গোল করে ঘুরত।
জেলেপাড়ার সঙদের জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে, সেকালে কলকাতার বিত্তবানেরা নিজেদের বাড়ির বারান্দাগুলো এই সঙযাত্রা দেখার জন্য ভাড়া দিতেন। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনেরা ভিড় করত এই সঙযাত্রা দেখার জন্য। বাড়ির ছাদে টাঙানো হত শামিয়ানা। সেখানে আবার বড়দের জন্য শরবত এবং বাচ্চাদের জন্য দুধের ব্যবস্থাও করা হত। বাবু শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় এই সঙযাত্রার বাড়বাড়ন্ত ঘটলেও পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে তাদের কারণেই এই সঙযাত্রার তাল কাটতে শুরু করে।

আরও পড়ুন-শোভাযাত্রা নিয়ে বর্ধমানে এসপির নেতৃত্বে রুট মার্চ

এরপর প্রায় ৫০ বছর কলকাতা তথা জেলেপাড়ার সঙরা সেইভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি কারণ সে-সময় ক্রমশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রত্যক্ষ হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আশির দশকে পুনরায় জেলে পাড়ার সঙকে কলকাতা কৈবর্ত সমিতি আবার নতুন ভাবে উপস্থাপিত করে। দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপরে ডক্টর প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে ১৯৯৩ সাল থেকে আবার ‘জেলেপাড়া সঙ সমিতি সংঘ’ শুরু হয়, মিছিল বের করেন শঙ্করপ্রসাদ দে। আর এঁদের মতন কিছু মানুষের উদ্যোগে আজও বাংলা লোক বিনোদনের এই মৃতপ্রায় মাধ্যমটি বেঁচে রয়েছে।
১৫০ বছর আগে বউবাজার অঞ্চলের শশীভূষণ দে স্ট্রিট, রমানাথ কবিরাজ লেন, অক্রুর দত্ত লেন— এই এলাকাগুলোতেই ছিল জেলে পাড়া। এখনও এইসব অঞ্চলে গেলে কোনও কোনও পুরনো বাড়ির দরজার সামনে লেখা ঠিকানায় জেলে পাড়ার অস্তিত্ব আজও ফিকে হয়ে তার ইতিহাসকে স্মরণ করে চলেছে।

Latest article