মোদি জমানার সৌজন্যে দেশের সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে

ভারতের জঞ্জাল পার্টির মহান কীর্তিগুলির পরিণামে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, নির্বাচনী ব্যয়, ইভিএম-এর স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের রায়— সব কিছু ঘিরেই বিতর্ক দানা বাঁধছে। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোর কয়েকটি পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার তিনটি পরিবর্তন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-সব ছোটখাটো পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তন সাংবিধানিক কাঠামোর অন্তর্বস্তুগত পরিবর্তন। যেগুলির মধ্যে এই লেখায় তিনটি পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হবে।
প্রথমত, বলতে হবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের (Election Commission of India) কথা। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিচালনা করে। যে-প্রতিষ্ঠানটি একটি কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি মর্যাদাপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিল। বর্তমানে সেই সংস্থা আর দল-নিরপেক্ষ থাকতে পারছে না। শাসক দলের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। এই প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীন ও স্বচ্ছ ভূমিকা নিয়ে ভোটারদের মধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কমিশনের (Election Commission of India) ‘সাক্ষীগোপাল’ ভূমিকা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা শোনা গিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধীদের অভিযোগগুলি নিয়ে কমিশন কর্ণপাত করেনি।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী প্রচারের খরচ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনী প্রচারের খরচকে কেন্দ্র করে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলি লঙ্ঘনের অভিযোগ অনেক পুরনো। এখন তাকেই একটা সরকারি ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে। সেই ব্যবস্থা হল নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা। কোনও সংসদীয় আলোচনা ছাড়াই ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলিকে অজানা সূত্র থেকে অর্থ পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। কেবলমাত্র সরকার এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এই লেনদেনের কথা জানতে পারে। জনগণের কাছে এর কোনও তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে জানা যায় যে, ৯৫ শতাংশ অর্থ এই বন্ড থেকে শাসকদলের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। ফলে গোটা ব্যবস্থাটাই শাসক দলের অনুকূলে চলে যায়। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এই আঘাত ক্রমশই শাসকদলের হাত শক্ত করে। যা একপাক্ষিক এবং সংবিধান ও গণতন্ত্র বিরোধী। নির্বাচনী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে-ব্যবস্থা এখনও চলছে। যার ফলে প্রশস্ত হচ্ছে দুর্নীতির পথ। আদানি-কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা এর একটা বড় কারণ হতে পারে।

তৃতীয়ত, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করার মধ্য দিয়ে ‘গোপন ব্যালটে’ ভোট ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয়েছে। এক-একটি ভোটযন্ত্রে হাজারখানেক ভোটের চিত্রটি সহজেই জনসমক্ষে চলে আসে। ফলে যে-দল ভোট কম পেল, সেই দল সহজেই বুথগুলিকে চিহ্নিত করতে পারে। ভোট গণনার আগে বেশ কিছু মেশিনের ভোট মিলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া থাকলে কিছুটা গোপনীয়তা বজায় থাকত। সেটাও হতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে ব্যালট পেপার একটা বড় ড্রামে মিশিয়ে দেওয়ার পর গণনা হত। এখন তার কোনও ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করতে পারেনি। ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এক অদ্ভুত সমঝোতার মাধ্যমে চলছে। যে-কোনও মূল্যে নির্বাচনে জেতাটাই এখন মূল লক্ষ্য। ফলে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজে চলেছে। এ-বিষয়ে লেভিট্‌স্কি এবং জিবলাট-এর লেখা ‘হাউ ডিমোক্র্যাসি ডাই’ (২০১৮) বইটিতে গভীর আলোচনা করা হয়েছে।
আলোচিত পরিবর্তনগুলি প্রক্রিয়াগত দিক থেকে গণতন্ত্রের অধঃপতন ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ-বিষয়ে জোরদার চর্চা শুরু করেছেন। যার নির্যাস হল— ২০১৯-এ ভারতীয় জনতা পার্টির বিপুল জয় ভারতীয় নির্বাচনী রাজনীতির শুধুমাত্র এক নতুন পর্বের সূচনা নয়, এটা হল, এক ‘সামগ্রিক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ (Whole new political System)।

ঠিক এভাবেই ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৯-এর ৫ অগাস্ট জম্মু-কাশ্মীর (একমাত্র এই দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য) রাজ্যকে তিন টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। অতীতে এবং বর্তমানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গৃহবন্দি করা হয়েছিল। কাশ্মীরের সমগ্র জনগণের মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন-জ্বলছে মণিপুর, ঘরছাড়া প্রায় ২৫ হাজার, বাংলার পড়ুয়াদের ফেরাচ্ছে রাজ্য

দ্বিতীয়ত, ১৯১৯-এর নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে একটি ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গড়ার নির্দেশ দিয়েছে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদীরা উক্ত মসজিদ ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এই দুটি বিষয় নতুন সরকারের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী অবস্থানকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত। এর ফলে এ-দেশে ২০ কোটি মুসলিম জনগণকে দ্বিতায় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। এরপর ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে সংসদে নাগরিক আইন সংশোধন (CAA) বিল পাশ করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মীদের হাতে এখন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তাঁরা মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারেন বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে।

এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে দ্রুত দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয়। যেহেতু এই সিদ্ধান্তগুলি ভারতীয় সংবিধান নির্দেশিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি-বিরুদ্ধ, তাই এই প্রতিবাদ-আন্দোলনগুলি ব্যাপকতা ও বিস্তারের দিক থেকে দৃষ্টি আকর্ষণকারী ছিল। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা— ‘We the people of India…।’ ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তি যে কথাগুলির মধ্যে উচ্চারিত হয়েছিল।
এই আন্দোলনগুলি যেটুকু আশার আলো জ্বালিয়েছিল, করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে তা হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। তবুও বিজেপি-শাসনে সংবিধানকে যেভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই নাগরিক আন্দোলনগুলি আগামী দিনগুলিতে পথ দেখাবে। বিশেষ করে শাহিনবাগ ও বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনগুলির কথা আমরা ভুলব না। ভুলব না কৃষক আন্দোলনের কথা।

Latest article