উত্তরপ্রদেশের লখনউতে ক্লাস ইলেভেনে পড়া এক দলিত কিশোরীকে ধর্ষণের পর অভিযুক্তেরা গা-ঢাকা দেয়। পুলিশ যখন তাদের একজনকে গ্রেফতার করতে যায়, সেই যুবকটি পাল্টা গুলি ছোঁড়ে পুলিশের দিকে। তার নাম ললিত কাশ্যপ। উচ্চবর্ণের যুবক। বিগত এগারো বছরে মোদি-সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর গোটা দেশের বিজেপি-শাসিত ডবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলোতে দলিতদের উপর আক্রমণ ও অত্যাচারের ঘটনা লাগামছাড়া হারে বেড়েছে। সাম্প্রতিক এনসিআরবির রিপোর্ট অনুসারে ২০২৩ সালে মোট ৫৭,৭৮৯টি দলিত নির্যাতনের মামলা রুজু হয়েছিল সারা দেশে। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা প্রথম চারটি রাজ্যই বিজেপিশাসিত। এদের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ১৫,১৩০টি, রাজস্থানে ৮,৪৪৯টি, মধ্যপ্রদেশে ৮,২৩২টি এবং বিহারে রুজু হয়েছে ৭,০৬৪টি মামলা। দেশের মোট নিবন্ধিত দলিত নির্যাতনের ৭০ শতাংশ এই চারটি রাজ্যে ঘটেছে। ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি গোটা ভারতেই ঘটছে। কিন্তু বিজেপি শাসনে যে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের চাষবাস বাড়ছে তা হল, উচ্চবর্ণের হাতে নিচু জাতের মহিলাদের ধর্ষণ। এটি পুরুষতান্ত্রিক যৌন অত্যাচারের ক্ষেত্রে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি। মধ্যপ্রদেশের সাতারিয়া গ্রামের এক ওবিসি যুবক পুরুষোত্তম কুশওয়াকে স্থানীয় গ্রামীণ বিবাদের জেরে পাঁচ হাজার টাকার জরিমানাই কেবল করা হয়নি। তাকে ব্রাহ্মণ অন্নু পাণ্ডের পা-ধোয়া জল খেতে বাধ্য করা হয়েছে।
আপনি সঙ্ঘের যেকোনও কর্তাব্যক্তি অথবা সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ কিছুটা বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করুন, রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা কি জাতপাতে বিশ্বাস করেন? প্রায় তাৎক্ষণিক উত্তর পাবেন— ‘একেবারেই নয়। হিন্দুসমাজ অখণ্ড। একে টুকরো করতে চায় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল লিবারেলরা।’ এর পাশাপাশি এদের আরেকটি বাঁধা-গতের উত্তর হল— ‘প্রাচীন ভারতে জাতপাতের বিভাজন ছিল না, এগুলো সব ইসলামি শাসনের অবদান।’ কখনও আবার তাঁরা বলবেন—‘বর্ণবিভাজনের কথা বলাই হল হিন্দুধর্মকে দুর্বল করার চেষ্টা।’ বলাই বাহুল্য আরএসএস এক বহুমাথাবিশিষ্ট হাইড্রা— যার এক-একটা মুখ এক-এক রকম কথা বলবে আপনাকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। আসল কথা হল এটি এমন এক সংগঠন যারা চায় রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বাগ্বিস্তারের আড়ালে একটি মনুবাদী উচ্চবর্ণের প্রাধান্যবিশিষ্ট ভারতীয় সমাজ গড়ে তুলতে। এবং তাদের দুই প্রধান তাত্ত্বিক সাভারকার ও গোলওয়ালকার নিজেদের একাধিক লেখায় এবং বক্তৃতায় ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে নিজেদের অকুণ্ঠ ভক্তি ও সমর্থন প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ (১৯২৩) বইতে সাভারকার স্পষ্ট বলেছেন, হিন্দু ‘নেশনে’র বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য ভারতীয় ‘কাস্ট সিস্টেম’ রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য। ১৯২৮ সালের প্রখ্যাত ‘মাহাড়’ আন্দোলনের সময় বাবাসাহেব আম্বেদকার প্রকাশ্যে ‘মনুসংহিতা’ পুড়িয়েছিলেন, কারণ, এই চরম নারীবিদ্বেষী ও শূদ্রবিদ্বেষী শাস্ত্র ভারতীয় সমাজের যুগযুগব্যাপী নিম্নবর্ণের উপর উচ্চবর্ণের অত্যাচারকে বৈধতা দিয়ে এসেছিল। কিন্তু সাভারকার ‘মনুস্মৃতি’কেই ভারতীয় আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নিদান দিয়ে গেছেন তাঁর লেখায়—‘Manusmrriti is that scripture which is most worship-able after Vedas for our Hindu nation and which from ancient times has become the basis of our culture-customs, thought and practice. This book for centuries has codified the spiritual and divine march of our nation…Today Manusmriti is Hindu law. That is fundamental’ [Women in Manusmriti, Savarkar Samagra, Vol. 4, Delhi, Prabhat Publication, pp.416] তাঁর অন্যতম উত্তরসূরি গোলওয়ালকারও ‘মনুস্মৃতি’-অনুসারী ছিলেন, তিনিও ‘কাস্ট সিস্টেমে’ তাঁর অনড় আস্থা প্রকাশ করে গেছেন একাধিক লেখা ও বক্তৃতায়। তাঁর বিখ্যাত ‘বান্চ অফ থটস’-এ গোলওয়ালকার লিখছেন—‘Brahmin is the head, King is the hands, Vaishya the thighs and Shudra the feet. This means that the people who have this fourfold arrangement, i.e. the Hindu people, is our God’. [Bunch of Thoughts, Bangalore, Sahitya Sindhu, 1996, pp.36f]
আরও পড়ুন-দীপান্বিতায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন মা হংসেশ্বরী
এই অবধি পড়েই যদি এমন সরল সিদ্ধান্তে আসেন, আরএসএস-বিজেপি অবিকল এই কেতাবি ‘মনুবাদী’, ব্রাহ্মণ্যবাদী, শূদ্রবিদ্বেষী পদ্ধতিতেই আজও রাজনীতি করে, তাহলে ভুল করবেন। বিগত চার দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির যে উল্কার গতিতে উত্থান, তা কখনোই সম্ভব হত না, এই কেতাবি বর্ণমালায় আবদ্ধ থাকলে। সেই আশির দশকের শেষে যখন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর নেতৃত্বে ‘মণ্ডল রাজনীতি’র উত্থান, গোটা উত্তর ও মধ্যভারত জুড়ে ‘রথযাত্রা’-র মধ্য দিয়ে বিজেপি উদ্ভাবন করে ‘কমণ্ডলু’ রাজনীতি, ১৯৯২ সালে আম্বেদকারের মৃত্যুদিনে, ৬ ডিসেম্বর, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তাদের জয়যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে এবং আরএসএস-এর প্রভাব বাড়াতে তারা সরাসরি নিচু বর্ণ অর্থাৎ ‘দলিত’-‘ওবিসি’ ও বিভিন্ন মধ্যমবর্ণকে নিজেদের দিকে টেনে নেয় এবং তাদের ক্রমশ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করতে থাকে। অনেকেরই মনে থাকবে গুজরাতে ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা, যখন বিজেপি সরকারের উচ্চবর্ণ-তোষণনীতির তীব্র বিরোধিতা করে ৪৮ জন বিধায়ককে নিয়ে দল ছাড়েন শঙ্কর সিং বাঘেলা। ২০০২ সালে উত্তরপ্রদেশেও মায়াবতীর ‘বহুজন সমাজ পার্টি’র সঙ্গে জোট করে সরকারে যায় তারা। অর্থাৎ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিচু জাতকে দূরে ঠেলে না রেখে, দলিতদের মধ্যেকার উচ্চাকাঙ্ক্ষী অংশটিকে নিজেদের দিকে টেনে নেবার কার্যকরী লাইন নেয় তারা। এই প্রত্যেকটি পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে বিজেপি। আর বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছে সেই দলিত পার্টিগুলো, যারা বিজেপির মতো বর্ণবাদী, দলিতবিদ্বেষী দলের মুখোশকে বিশ্বাস করেছিল। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর দল আজ অস্তমিত। সেই জায়গায় দলিতদের নতুন আইকন হিসেবে উঠে আসছেন ‘ভীম আর্মি’র নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ ‘রাবণ’, যিনি একক শক্তিতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাংসদ হয়েছেন ‘নাগিনা’ কেন্দ্র থেকে। তবে এই দলিত-পিছড়েবর্গকেও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশলেরও উদ্ভাবক সাভারকার-গোলওয়ালকার। সেই কথাটাও না হয় সুযোগ মতো বুঝিয়ে দেওয়া যাবে একদিন।