ভূমিকম্প (Earthquake) নিয়ে কিছু বলতে গেলেই প্রথমেই মনে আসে এই পৃথিবীর কেন্দ্র-বরাবর কতটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা গেছে। এর বেশির ভাগ কাজ করা হয়েছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ পদার্থ অনুসন্ধানের জন্য। রাশিয়া ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালে ১২২৬২ মিটার গভীর কূপখনন করতে সক্ষম হয় যা এখনও গভীরতম কূপ (Kola Superdeep Borehole)। সেখানকার তাপমাত্রা ২৬২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের থেকেও বেশি। পৃথিবীর কেন্দ্রের গভীরতা ও তাপমাত্রা যথাক্রমে ৬৩৭৮ কিমি ও ৬০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ১২২৬২ মিটারের বেশি গভীরতার তথ্য, সবই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প প্রসূত অনুসন্ধান থেকে পাওয়া। চৌম্বকত্ব ছাড়া মহাজাগতিক কোনও অনুসন্ধান পদ্ধতি পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রযোজ্য নয়। তাই এখনও অধরা ভূমিকম্পের বাস্তব পূর্বাভাস। ভূমিকম্পের পর্যালোচনা টেকটোনিক প্রকল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়।
প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব
ভূমিকম্পের কারণ হিসাবে প্লেট টেকটোনিক তত্ত্ব সর্বসম্মত। মানুষের মাথার খুলি যেমন ২২টি টুকরো দিয়ে গঠিত, তেমনি পৃথিবীর সর্বোপরি শক্ত তল লিথস্পিয়ার ১২টি বড় টুকরো ও অসংখ ছোট ছোট ভাঙা টুকরো দিয়ে গঠিত। এগুলিকে প্লেট বলে। সমস্ত প্লেটের গঠন অনিয়মিত আর এগুলির সীমানা মহাদেশের সীমানার সঙ্গে কোনও মিল নেই। এই প্লেটগুলি কোনওটি স্থির নয়, সব প্লেটের একটি নির্দিষ্ট চলমান গতি আছে যা ২ থেকে ১০ সেন্টিমিটার প্রতি বছর। প্লেটগুলি অনন্তকাল ধরে বিভিন্ন দিকে বহু দূর অতিক্রম করছে। এই ভাবে যখন যেখানে ২টি প্লেটের সংঘর্ষ হচ্ছে সেখানেই ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে।
রিং অফ ফায়ার কি?
যে-সমস্ত জায়গায় ভূমিকম্প বেশি হয় তাকে সিসমিক বেল্ট বলে। সমগ্র পৃথিবীতে ৩ প্রকার সিসমিক বেল্ট আছে। যে অঞ্চলগুলি প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে আছে তাকেই রিং অফ ফায়ার বলে। এখানে প্রচুর আগ্নেয়গিরি আছে এবং ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়।
ভারতের ভূকম্পপ্রবণ জায়গা
হিমালয় পর্বতমালা সংলগ্ন জায়গা। এটি ইউরোপ এবং এশিয়া প্লেটের সংযোগ স্থান। অরুণাচল প্রদেশ থেকে শুরু করে লে-লাদাখ পর্যন্ত বিস্তৃত। উপরিউক্ত প্লেট দ্বয়ের বিষম অনুভূমিক গতির জন্য প্রতি বছর উলম্বদিকে ৪ সেন্টিমিটার করে হিমালয়ের উচ্চতা বাড়ছে। তবে নানা ছোট ছোট ভূমিকম্পের জন্য এই উচ্চতা বৃদ্ধি পরিবর্তনশীল। এই মুহূর্তে উচ্চতা ৮৬ সেন্টিমিটার বেশি রয়েছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সিকিম ভূমিকম্পের (Earthquake) জন্য কিছুটা উচ্চতা কমে গেছে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে নেপাল ভূমিকম্পের পর হিমালয়ের উচ্চতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়। রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৮। একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর ব্যাপকতা কলকাতা ছাড়িয়ে দিঘা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করা হয়। কেননা, বর্ণনা অনুযায়ী ১০০ বছর আগে ব্রিটিশরা দিঘার যে অঞ্চলে সমুদ্রভ্রমণ করতে যেত, সেই জায়গার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান করা হচ্ছে ১৯৩৪-এর ভূমিকম্পের সময় দিঘার ওই সমুদ্রতট সমুদ্রে সমাধিস্থ হয়েছে।
আরও পড়ুন: ভুয়ো খবরের দাপট বেড়েছে ফেকুবাবুদের জমানায়
কম্পাঙ্ক সূত্র
প্রতিটি রেল ব্রিজের কাছেই ট্রেনের গতি কত হবে লেখা থাকে। ট্রেনচালক সেতুতে ওঠার আগে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়। প্রতিটি স্থাপত্যের (এক্ষেত্রে সেতু) ভর, দৈর্ঘ্য, প্রশস্ত ও উচ্চতা অনুযায়ী একটি বিশেষ কম্পাঙ্ক থাকে। ট্রেনের ভর ও গতির জন্য একটি কম্পন তৈরি হয়। এই দুই কম্পন সমান হয়ে গেলে অনুনাদ তৈরি হবে এবং সেতু ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভূমিকম্পরোধক স্থাপত্য
পৃথিবীর ওপরের আস্তরণ যা লিথোস্ফিয়ার বলা হয়, এই আস্তরণের একটি কম্পাঙ্ক বা দোলনকাল আছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেছে এই দোলনকাল শূন্য দশমিক ৮ সেকেন্ড। এখন কোনও স্থাপত্যের দোলনকাল যদি এমন হয় যে লিথোস্ফিয়ার-এর দোলনকালের সাথে অনুনাদ সৃষ্টি না করে, তখন ওই স্থাপত্যকে ভূমিকম্পরোধক স্থাপত্য বলা হয়। এতে ভূমিকম্প (Earthquake) হলেও স্থাপত্য নষ্ট হবে না। একমাত্র উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তা সম্ভব। হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্রসেতু এই শ্রেণির অন্তর্গত।
উচ্চতা বৃদ্ধি ও ভূমিকম্পের প্রকল্প
ইউরোপ ও এশিয়ার টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংযোগস্থান হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালা। ২ থেকে ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত অনুভূমিক দিকে একে ওপরের কাছে আসছে। এর ফলে হিমালয়-সংলগ্ন জায়গার উচ্চতা বাড়ছে ৪ সেন্টিমিটার প্রতিবছর। প্রতি বছর এই সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধি, সমষ্টিগত ভাবে হিমালয়ের ভর (মাস) ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই হিমালয় পর্বতমালাকে একটি বিশাল স্থাপত্য হিসাবে দেখা হয়, তবে এই ভর বৃদ্ধি এই বিশাল স্থাপত্যের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন করে দেবে। এইভাবে একসময় লিথোস্ফিয়ারের কম্পাঙ্কের সাথে অনুনাদ তৈরি হবে এবং এতে হিমালয় পর্বতমালা ২ টুকরো হয়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই অতি-ভূকম্পের মান রিখটার স্কেলে ৮ থেকে ১০-এর মধ্যে থাকবে। যেহেতু হিমালয়ের বর্তমান উচ্চতা ৮৬ সেন্টিমিটার বেড়ে গেছে। ভূমিকম্পের (Earthquake) প্রকল্প অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রমাদ গোনার সময় শুরু হয়ে গেছে।
প্রতিকার ও সাবধানতা
পৃথিবী লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঠান্ডা হচ্ছে। এই ঠান্ডা হওয়ার গতি যেন কোনওভাবেই বাধা না পায়। এর জন্য ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, উষ্ণতা বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করা হয় এবং এটি মানুষের কার্যক্রমের প্রভাবে ঘটেছে। এটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনেরই একটি অংশ। যেহেতু ভারতীয় ভূখণ্ড পৃথিবীর সবথেকে বেশি জনবহুল অঞ্চল, তাই জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এখানে সবথেকে বেশি হবে। সুপরিকল্পিতভাবে প্রশস্ত রাস্তা সমেত অনেক বেশি সংখ্যক নতুন নতুন নগর প্রণয়ন করতে হবে। পাহাড়-সংলগ্ন অঞ্চল থেকে দূরে সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলের দিকে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য দ্বীপপুঞ্জ ও সমুদ্রকে নানাভাবে ব্যবহার করতে হবে।