বিশ্ব ইতিহাসে অমূল্য সম্পদের তালিকা যদি করতে হয়, তবে দ্যুতিমান ধাতু হিসেবে স্বর্ণ এক বিরাট অংশ অধিগ্রহণ করে রেখেছে। স্বর্ণ আবিষ্কারের ইতিহাস আজও সমৃদ্ধ নয়, তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান প্রত্ন-প্রস্তরকালেও স্বর্ণের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে অনেক ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন গবেষণায় এটুকু নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে প্রাচীন মিশর সভ্যতায় মানুষ সোনার ব্যবহার করত নিজেদের দৃষ্টান্তের উদাহরণ দিতে। মিশরীয়রাই আবার প্রথম স্বর্ণমুদ্রার মাধ্যমে বিনিময় প্রথা চালু করেন। প্রাচীন সভ্যতায় গ্রিকরা সোনাকে সামাজিক স্থিতির চিহ্নস্বরূপ দেখত, যা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও সোনার স্থিতি একাংশও কমেনি বরং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে আজও মানুষ ধনতেরাসে সোনাকে লক্ষ্মী রূপে বরণ করে নেয়। সোনার গুরুত্ব সর্বাধিক বোঝা যায় আঠারো শতকে। ১৭৯২ সালে আমেরিকা মিন্ট আ্যন্ড কয়েনেজ আইন পাশ করে মার্কিন ডলারে সোনার ফ্ল্যাট প্রাইজ (সমরূপ দাম) প্রতিষ্ঠা করে। আসলে বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত বিষয় হল হলুদ ধাতুর দাম বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই মুহূর্তে বিনিয়োগের সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প হল সোনা।
পৃথিবীতে যখনই কোনও সংকট দেখা গেছে সাধারণ মানুষ শুধু নয় সরকারও সোনা কেনা শুরু করে। কারণ আমরা জানি সোনা সহজেই নগদ টাকায় রূপান্তর করা যায়। এই সহজলভ্যতার দরুন, শুধু জনগণই নয়, সমস্যায় থাকা সরকারও সোনা লেনদেনের মাধ্যমে অর্থনীতির স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে সমর্থ হয়। এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, স্বর্ণ এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির ভিত তৈরিতে বৃহদাকার অংশ নিয়ে রয়েছে। সাধারণ জনগণ থেকে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ থেকে শিল্পপতি, প্রতেক্যেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, এই প্রাণহীন ধাতু হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সমস্ত জীবকুলকে প্রভাবিত করে চলেছে শুধু নয়, ভবিষ্যতেও এর আধিপত্য বজায় থাকবে স্বমহিমায়। এবার আসা যাক সোনার দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়? বিশ্ব বাজারে সোনার দাম ঠিক করে লন্ডনের বুলিয়ান মার্কেট।
আরও পড়ুন-ভোটার তালিকায় নজরদারির নির্দেশ দিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব
২০১৫ সালের আগে লন্ডন গোল্ড ফিক্স ছিল সোনার দাম নিয়ন্ত্রক, কিন্তু ২০১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে লন্ডন বুলিয়ান মার্কেট আ্যসোসিয়েশন নামে নতুন সংস্থা তৈরি হয়, তারাই এখন সোনার দাম নির্ধারণ করে। ভারতবর্ষে মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বা MCX-এর ফিউচার মার্কেট লন্ডনের বুলিয়ান মার্কেট আ্যসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোনার দাম ঘোষণা করে। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় যেমন, আন্তজার্তিক বাজারে সোনার মূল্য বা ডলারের মূল্য সোনার দাম নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মুহূর্তে সোনার দামের বৃদ্ধি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বিশ্ব বাজারে সোনার দাম ওঠা-নামার পিছনে কিছু কারণ আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— (১) মানুষ যখন সরকার বা আর্থিক বাজার সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকে। (২) মুদ্রাস্ফীতি যখন চরম পর্যায়ে যায়। (৩) ব্যাঙ্কের সুদের হার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোনার দাম বৃদ্ধি পায়। (৪) যখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ হিসেবে প্রচুর পরিমাণে সোনা কেনে, তখন সোনার প্রাপ্যতা দুষ্প্রাপ্য হওয়ার দরুন সোনার দাম বেড়ে যায়। এছাড়াও মুদ্রা বিনিময়ের হার, ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তা ইত্যাদি। যখন মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, তখন সেদেশে মুদ্রার মূল্য কমে যায় এবং সেইজন্য মানুষ সোনা কেনার প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। ভারতীয় অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার যদি দেখি শেষ তিনটি মাসে যথাক্রমে অক্টোবরে ৬.২১, নভেম্বরে ৫.৪৮ এবং ডিসেম্বরে ৫.২২ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ শতাংশের বেশি হলে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানিয়েছে বিগত অক্টোবর মাসে আরবিআই ২৭ টন সোনা কিনেছে আর ২০২৪ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৭৭ টন সোনা কিনেছে, যা গত বছরে এই সময়ে তুলনায় ৫ গুণ বেশি। নভেম্বর মাসে ৮ টন সোনা কিনেছে আরবিআই।
আরও পড়ুন-চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ১০ মাসে আয় ৩৮, ৪০০ কোটি টাকা
সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সোনা কেনার অন্যতম লক্ষ্য হল, অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে পিছনে ফেলা, মুদ্রাস্ফীতি হটাতে, বৈদেশিক বাণিজ্যকে বজায় রাখতে সোনা কিনে মজুত রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্যও সোনা রিজার্ভ বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে তেলের দামের বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে। শক্তিশালী ডলার সূচক, তেলের দামের বৃদ্ধি, বন্ড মার্কেট থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণে টাকার দর পড়েছে। এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীরা ভারতের মতো বাজারের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করছে, তার ফলে টাকার মানের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। যদি একটু পরিসংখ্যান দেখি, টাকার মানের অবমূল্যায়নের সঙ্গে সোনার দাম কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বছরের পর বছর।
২০২১ সালে ১ এপ্রিল ১ ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্য ছিল ৭৩.৪৪১, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য ছিল প্রায় ৪৪৩৭০ টাকা। ২০২২ সালে ১ ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্য ছিল ৭৫.৯৫৪, আর ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য ছিল প্রায় ৫১,৯৮০ টাকার মতো, ২০২৩ সালে তা দাঁড়ার ১ ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্য ৮২.১৮০, আর ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য ছিল প্রায় ৬০০৪০ টাকার মতো, ২০২৪-এ ১ ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্য ছিল ৮৩.৪১৩, তখন ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য ছিল প্রায় ৬৯,৪৭১ টাকার মতো (প্রতিটি তারিখ ১ এপ্রিল)। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ১ ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার মূল্য কম- বেশি ৮৭ টাকা, আর ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য প্রায় ৮৭,০০০ টাকা। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে সোনার দামের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে।
আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়, মধ্যবিত্ত মানুষেরা বিশেষ করে যাঁরা পেনশনভোগী তাঁদের জীবিকা নির্বাহের একটা বড় অংশ আসে ব্যাঙ্কের জমার ওপর সুদ থেকে। যাঁরা সরকারি চাকরিজীবি অথবা যাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন তাঁরা তাঁদের সঞ্চয়ের সিংহভাগ অংশই সরকারি ব্যাঙ্কে জমা রাখেন ভবিষ্যতে কিছু বেশি পরিমাণে অর্থ পাবার আশায়। ইদানীংকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যাঙ্কের সুদের পরিমাণ কোন পর্যায়ে এসে নেমেছে। সেভিংস হোক বা ফিক্সড ডিপোজিট সর্বক্ষেত্রেই সুদের হারের তথৈবচ অবস্থা। ফলে সাধারণ মানুষের একটা অংশ সঞ্চয়ের ক্ষেত্র হিসেবে সোনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাতে খুচরো বাজারে সোনার চাহিদা আগের থেকে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ভারতীয় জনসংখ্যার তিন চতুর্থাংশের বেশি মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে সোনাকে বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে, এক চতুর্থাংশ মানুষ সোনাকে অলংকরণের জন্য বেছে নিয়েছেন। এই মুহূর্তে শেয়ার মার্কেট যখন দিনের পর দিন অনিশ্চয়তায় ভরে উঠেছে, সাধারণ মানুষের গন্তব্য তখন সোনার বাজার। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ তাঁদের ভবিষ্যৎ-এর সঞ্চয় নিয়ে সন্দিহান, এতে আগামী দিনে সোনার দামের যে কী পরিণাম হতে চলেছে তা বলাই বাহুল্য।