একদিনে সমস্ত লোকসভার প্রার্থী ঘোষণা করেছিল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস। ৪২টি আসন। প্রথম দফার ভোটের আর বেশি দেরি নেই। এখনও বড় বড় দল সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি। প্রার্থী নিয়ে বহু রকমের রঙ্গ চলছে তাদের মধ্যে। সংবাদমাধ্যমে তা ফলাও করে দেখানো হচ্ছে। সেসব নিয়ে আবার ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টাদেড়েক হচ্ছে! প্রায় সব প্রচারমাধ্যমের লক্ষ্য তৃণমূল কংগ্রেস, তার নেতা-নেত্রীদের সময়ে অসময়ে, যে কোনও প্রকারে হেনস্থা করা। অসত্য এবং অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদের নামে ভুয়ো গল্পের অবতারণা করা। পশ্চিমবাংলায় এখন তাই হচ্ছে।
একজন প্রাক্তন বিচারপতির কথা বলি। তিনি তো কাগুজে বাঘ। প্রচারমাধ্যমগুলি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন চওড়া করল যে সে ফেটে গিয়ে আসল সত্যটা বেরিয়ে পড়েছে। তিনি এজলাসে বসে অহরহ রাজনৈতিক মন্তব্য করতেন আমরা সবাই জানি। প্রত্যেকটা মন্তব্য ছিল তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি এবং তার নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে। কোনও সময় তিনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে কিছু বলতেন না। তাঁর এসব কথাতে সংবাদপত্রগুলিতে প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হত। এখন তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। ঝুলি থেকে ১টা নয় ৩টে বিড়াল বেরিয়ে গিয়েছে। তিনি বলেছেন বিজেপির যোগ তাঁর অনেক আগে থেকে। তিনি বিজেপিতে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বিজেপিও তাঁকে প্রস্তাব দেয়। তাহলে এটা প্রমাণিত যে, এজলাস থেকে যত রায় বা নির্দেশ তিনি দিয়েছেন তা বিজেপি-র প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে। আর প্রচারমাধ্যম বিষয়টা সঠিক না জেনে তাঁকে তোল্লা দিয়ে গিয়েছে। সংবাদপত্রের প্রতি আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের কুৎসিত চেহারা বাংলাবাসীকে হতাশ করে। কোনও কোনও সময় ভাবি এরাই হরি মুখুজ্যে আর বিবেকানন্দ মুখুজ্যের উত্তরসূরি। নিদেনপক্ষে বরুণ সেনগুপ্ত। প্রাক্তন বিচারপতি মহাশয়কে জানাতে চাই, তিনি এটা বোধহয় জানেন না, তাঁর বর্তমান দলের প্রয়াত নেতা মন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, বিচারপতিরা প্রাক্তন হয়েই রাজনৈতিক দলে যোগ দিচ্ছে। এটা বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতি দু’টোর ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক প্রবণতা। অন্তত ৫ বছর ‘কুলিং পিরিয়ড’ থাকা প্রয়োজন। বিজেপির তমলুক কেন্দ্রের প্রার্থী সম্মাননীয় বিচারব্যবস্থার কি মারাত্মক ক্ষতি করেছেন তা আজ সবাই জানছেন। আর সংবাদমাধ্যমের তো কথাই নেই তারা নিজেদের তথাকথিত টিআরপি বাড়াতে যা নয় তা করে গেছেন। বিখ্যাত কবি তারাপদ রায়ের কথাটিই বলতে হবে— কৃষ্ণচূড়া ভেবেছিলেন যাকে সে আসলে বাঁদরলাঠি।
আমরা সংবাদমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ করার নিন্দা করি। তাঁদের কাজ তাঁরা করবেন। গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁরা অন্যতম স্তম্ভ সেটার ঘোরতর বিশ্বাসী। কিন্তু নিজেদের তখন খুবই অসহায় মনে হয় যখন দেখি নামকরা বাহুবলীদের ধরে এনে দূরদর্শনের পর্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখানো হচ্ছে। কথোপকথনের নামে তাদের প্রচার করা হচ্ছে। কোন নীতিতে এটা সম্ভব? সত্যি আমরা বুঝতে পারি না। আমরা জানি ২৪ ঘণ্টা চ্যানেল চালু রাখা খুব চাপের কাজ। কিন্তু তাই বলে এমন কুৎসিত পরিবেশনা— ভাবা যায় না। তার উপর এখন একটা দূরদর্শনে নতুন পদ হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সারাদিন নিজের কাজকর্ম শেষ করে। খেয়ে। দুপুরে ঘুমিয়ে। গাল ফুলিয়ে। পাউডার মেরে দূরদর্শনের পর্দায় আসেন। যে কোনও ব্যাপারে তাঁরা বিশেষজ্ঞ। একজনকে হঠাৎ রেগে গিয়ে বলতে শুনেছি, জানো আমি অধ্যাপক! আসলে এসব ভাড়া করা সৈনিক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আনুগত্য নিয়ে তাঁরা আসেন। একমাত্র লক্ষ্য তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করা। এবং ভঙ্গিমা অতীব কুৎসিত। সম্প্রতি সন্দেশখালিতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ফিরে তাকাতে পারি। ৫ জানুয়ারি ঘটনার সূত্রপাত। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয় তাদের কাজ করতে গিয়ে। সংবাদপত্রের বন্ধুরাও উন্মত্ত জনতার হাতে লাঞ্ছিত হন। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর হয়। এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল না। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যম ও ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের নেতারা। সবাই জানাতে থাকেন নানারকম রোমহর্ষক কাহিনি এবং সেটা নাকি বহুবছর ধরে চলছে। আমার বিনীত নিবেদন, সংবাদপত্রের কাছে, আপনারা ৫ জানুয়ারির আগে কী করছিলেন? কাউকে জানাননি তো? পিঠ বাঁচাতে এই এলাকার পুরনো কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেটার গভীরতা এক্ষেত্রে বোঝা যায় না। মা-বোনদের দূরদর্শনের পর্দায় মুখ ঢেকে এনে এক ভূতের গল্প ফাঁদা হয়। সংবাদমাধ্যমের এত নিম্নরুচির কাজ অতীতে কোনওদিন দেখা যায়নি। পুরোটা রাজনীতি। তৃণমূল কংগ্রেসকে এবং তার নেতা-নেত্রীদের অপমান করাটা এর উদ্দেশ্য। আর একটি মহৎ (!) উদ্দেশ্য নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপিকে কিছুটা অক্সিজেন সরবরাহ করা।
সংবাদমাধ্যমের এমন রাজনীতিকরণ অতীতে দেখা যায়নি। আমরা জানি সারা ভারতে সংবাদমাধ্যমগুলির উপরে বিজেপির মারাত্মক চাপ আছে। প্রায় প্রতিটি সংবাদ সংস্থাকে বিজেপির ধনী বন্ধুরা নগদ দামে কিনেছেন। যারা প্রাথমিকভাবে রাজি হয়নি তাদেরকে ইডি বা সিবিআইয়ের ভয় দেখানো হচ্ছে। আয়কর দফতর থেকে ৩০ বছর আগেকার হিসাবপত্র দেখতে চাওয়া হচ্ছে। ২/১ যাঁরা বেঁচেবর্তে আছেন তাঁদের অবস্থা সঙ্গিন।
সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ রক্ষার জন্য সতত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় বহু কুপ্রচেষ্টা চালিয়েও বিজেপি সফল হতে পারেনি। একসময় দিল্লির নেতারা কলকাতার দৈনিক যাত্রী ছিলেন। কোনও কাজ হয়নি। এখন নির্বাচনের সময় আবার শুরু হয়েছে। নইলে পাঁচদিনে তিনবার প্রধানমন্ত্রী আসেন কেন? সন্দেশখালির মা-বোনেদের সঙ্গে কথা বলে অর্ধসত্য বলবেন কেন? আর সংবাদপত্র আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পটা আরও বেশি করে চাউর করবেন কেন? মা-মাটি-মানুষের সরকারের জনমুখী কাজ প্রত্যন্ত গ্রামের কুটিরে কড়া নেড়েছে। কোটি কোটি মানুষ উপভোক্তা হয়েছেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সরকারি পরিষেবা মানুষকে জড়িয়ে আছে। এ-সবের প্রচার বা ইতিবাচক ব্যাখ্যা সংবাদপত্রে নেই। তারা ব্যস্ত ছিদ্রান্বেষণে। তাই তারা কৃষ্ণচূড়া আর বাঁদরলাঠির পার্থক্য বোঝে না। মনে করে তৃণমূল বিরোধিতা করলেই তাদের মোক্ষলাভ আর গুরুভজনা হবে। কিন্তু এই পথেই তাদের কুৎসিত মনভাবের গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে। সময়ের অপেক্ষা।