ধর্ম-সংস্কৃতির মেলবন্ধন এই রাজ্যের প্রাণস্পন্দন

দুর্গাপুজোর কার্নিভাল থেকে ক্রিসমাস কার্নিভাল, দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা থেকে গঙ্গাসাগরে মকর সংক্রান্তির পুণ্যস্নান, আজানের সুর থেকে কীর্তনের বোল— সবকিছুই এই বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈভব। আর সেই মিলনের সুরলহরীকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ করে তুলছেন একজন মমতাময়ী প্রশাসক, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখছেন জিয়ান কর্মকার

Must read

ভারতীয় সংস্কৃতির শিরদাঁড়া নিহিত রয়েছে বাংলার সাহিত্যে, সঙ্গীতে, শিল্পকলায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে ও ধর্মীয় ভাবাবেগে। ঊনিশ শতকে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ছিল সমাজসংস্কার আন্দোলন ও নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে দুর্গাপূজা হোক বা করম পূজা অথবা ইদ, ধর্মকে বারবার মিলিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান পূর্বদিকে সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান থেকে পশ্চিমের শান্তিনিকেতন থেকে উত্তরের দার্জিলিং হিমালয়ান রেল বাংলার ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে বারবার। পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গৌরবময় অতীত, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের সম্ভারের কারণে বিশ্ব দরবারে সাড়া ফেলেছে অসংখ্য বার। দক্ষ স্থাপত্য ও অনন্য শিল্প ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গকে অন্যান্য রাজ্যের থেকে একটু আলাদা করেছে।

আরও পড়ুন-যশস্বীর আউট নিয়ে বিতর্ক, বেল নিয়ে খোঁচা স্টার্কেরও

পশ্চিমবঙ্গের ছোট ছোট অঞ্চলগুলিকে ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব দরবারে এক সুতোয় গেঁথেছে শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতি। পশ্চিম মেদিনীপুরের পটচিত্র গ্রাম যা বহির্বিশ্বের কাছে আশ্চর্যের। একটি ছোট্ট গ্রাম যেখানে ২৫০ পটুয়া বা চিত্রকরের বাড়ি। গ্রাম জুড়ে মাটির দেওয়ালে রয়েছে পটচিত্রের অবর্ণনীয় সুন্দর চিত্রকলা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর এই চারটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে অনন্য সুন্দর ডোকরা শিল্প যা পশ্চিমবঙ্গের এখন আকর্ষণীয় সৃজনশীল শিল্পের মধ্যে অন্যতম। নদীয়া জেলার ঘূর্ণি মৃৎশিল্পের স্বর্গ। এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল পশ্চিমবঙ্গের যে জেলাগুলো একসময়, অর্থনৈতিক ও প্রচারের আলোর থেকে পিছিয়ে ছিল তা নিজস্ব শিল্প দক্ষতায় আজ বিশ্বদরবারে নিজেদেরকে শুধু প্রমাণ করেননি বরং বাংলাকে ‘বিশ্ব বাংলায়’ পরিণত করেছে।
ঐতিহ্য ও কৌশলের মেলবন্ধন ঘটিয়ে কোনও রাজ্য নিজের তৈরি ইতিহাসকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারে তা বোধ হয় পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি দেখলেই বোঝা যায়। বাংলায় একটি প্রচলিত উক্তি আছে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। বহু যুগ যুগ ধরে বাংলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির গড়েছে। তাই তো উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের চূড়ামন রাজবাড়ির দুর্গাপূজা শুরু হয় পিরের দরগার ধ্বজা উড়িয়ে, আবার দশমীতে সেই ধ্বজা উড়িয়ে পালিত হয় বিজয়া। শীত-ঝলমলে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র পাক স্ট্রিটে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন সবধর্মের মানুষ সমানভাবে পালন করে। বর্ষবরণের আগে ক্রিসমাস যেন পশ্চিমবঙ্গকে উৎসবের আবহে আবদ্ধ করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সব ধর্মকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করে শুধু নয়, মিলনের এক মঞ্চ তৈরি করে নেয়। এমনকী রামকৃষ্ণ মঠেও যিশু পুজো মহাসমারোহে পালিত হয়। রেড রোডের ইদের মহামিলন তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ে। বন্ধুত্বের আবহে মিলে মিশে ইদ পালন করে মমতার  বন্ধনে। কথিত আছে ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’। সেই গঙ্গাসাগর মেলার সুখ্যাতি আজ সবত্র। বিভিন্ন ধর্মের মিলনক্ষেত্র আজ গঙ্গাসাগর। যে পযার্য়ের উন্নতিসাধন আজ গঙ্গাসাগর মেলাকে ঘিরে হয়েছে তা এককথায় অবর্ণনীয়।

আরও পড়ুন-কিছুই যেন ঠিক হচ্ছে না, হতাশ রোহিত, অবসর জল্পনার মধ্যেই হিটম্যানকে খোঁচা অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সহায়তায় কপিল মুনির আশ্রমের সংস্কার, সাগরের পাড় বাঁধানো, রাস্তা নির্মাণ ও সৌন্দর্যায়ন দর্শকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এখন গঙ্গাসাগর। যোগাযোগের উন্নতিতে ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুড়িগঙ্গার উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা, উন্নয়নের মাত্রাকে যেন আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশ্ব ঐতিহ্যে বাংলার নবতম সংযোজন দিঘার ‘জগন্নাথ ধাম’। যা শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলনক্ষেত্র হতে চলেছে। তীর্থক্ষেত্র হোক বা পর্যটন ক্ষেত্র বা শিল্প ক্ষেত্র, জগন্নাথ ধাম যে সব ধর্মের মানুষকে একসূত্রে বাঁধতে চলেছে তা ধ্রুবসত্য। ২০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতিমধ্যে মন্দিরের কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে। আসলে ধর্মীয় জিগির যেখানে বিশ্ব সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে, সেইখানে শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্মকে কীভাবে একসূত্রে গাঁথা যায় তা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চোখে চোখ রেখে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘জগন্নাথ ধাম’ শুধু একটা মন্দির ভাবলে ভুল হবে, বাংলার উৎসব যে কত মানুষের কর্মসংস্থানের সু্যোগ করে তা কিন্তু পূর্বে আমরা দেখেছি। সুতরাং ধর্ম যদি মানুষকে বাঁচার নতুন পথ দেখায়, তাহলে সেই ধর্মকে আপন করে নিতে মানুষের কোনও অসুবিধা হয় না। আর জগন্নাথ ধাম শুধু হাজারো লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে তাই নয়, পর্যটন মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গকে এক নতুন দিশা দেখাবে। সারাবছর অগণিত ভক্তের সমাগম হয় পুরীধামে, তাতে ওড়িশার কতটা উন্নতিসাধন হয়েছে তা সেখানকার মানুষ একবাক্যে স্বীকার করবে। আর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা একটা রাজ্যকে কতটা অগ্রসরের পথে নিয়ে যেতে পারে তা রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনাতেই স্পষ্ট। আসলে ঈশ্বরের স্থান তো সর্বত্র, আর প্রশ্ন যদি অনুকরণের হয় তবে সেই অনুসরণ অবশ্যই জনকল্যাণের হওয়া উচিত। মাননীয়ার মস্তিষ্কপ্রসূত কন্যাশ্রী হোক বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আজ মডেল। বিভিন্ন রাজ্য তাকে অনুসরণ করছে জনকল্যাণে। সেখানে ধর্মের জিগির ছাড়াই মানুষের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে মনুষ্য ধর্মকে কীভাবে আপন করে জনকল্যাণ করা যায় তা অবশ্যই মাননীয়ার কাছে শিক্ষণীয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানের সংস্কার বা স্থাপনের জন্য হিডকোর সঙ্গে ৭০০ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। মানুষের আবেগ ও কর্মসংস্থানের এক নতুন দিশা দেখাবে এই বিনিয়োগ।

আরও পড়ুন-গম্ভীর জমানায় মোটে ৩ টেস্টে জয়, লাল বলে আলাদা কোচের দাবি উঠল

উৎসব কীভাবে মানুষের জীবন পাল্টাতে পারে বিরোধী দল কথিত খেলা-মেলার সরকার তা বারংবার প্রমাণ করেছে। ধর্ম যেমন সমাজের ভিত্তি, তেমনি সামাজিক বিভাজনের একটি প্রাথমিক উৎস বলা যেতে পারে। সমাজের ভিত্তি এবং সামাজিক বিভাজনকে এক ছাতার তলায় আনতে পারে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে সর্বজনবিদিত চর্চা হল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও তার সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষজন। সাম্প্রদায়িকতা ভুলিয়ে উন্নয়নের জোয়ার আনার যে প্রচেষ্টা সরকার করতে চায় তার অনন্য উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার। উৎসবের আবহে বাণিজ্যের আগমন হোক বা ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে শিল্পরচনা তা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অদম্য পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ এই রাজ্যকে অন্যান্য রাজ্য থেকে অনেকটাই আলাদা করে দিয়েছে।

Latest article