মিডিয়া মাফিয়ার খেলা চলছে

বিগত কয়েক বছরে দেশের সামাজিক পরিকাঠামো যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এটা জলের মতো পরিষ্কার যে, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমদের প্রতি আমদানিকৃত ঘৃণার ক্রমাগত চাষই সাবিরদের উপর শিয়রে সমন জারি করে মারছে এই গোরক্ষা-নামক ভণ্ডামি। লিখছেন অশোক মজুমদার

Must read

সাবির মালিককে মনে আছে? বছর ছাব্বিশের ছেলেটি গরুর মাংস খেয়েছে এই সন্দেহে হরিয়ানায় গোরক্ষক বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে লোকজনের সামনেই পিটিয়ে মেরে ফেলে। পুলিশি তদন্তের আওতায় ল্যাবে পরীক্ষা করে জানা গেছে ওটা গরুর মাংস ছিল না। আসলে ওই গোরক্ষক বাহিনীও জানত সাবির গরুর মাংস খায়নি। শুধুমাত্র তীব্র মুসলমান-বিদ্বেষই সাবিরকে মারার একমাত্র কারণ।
সাবিরের খাওয়া মাংস যে গরুর নয় এই খবরটি গতকাল কলম পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম। অন্য কোনও মূল ধারার কাগজে তন্নতন্ন করে খুঁজেও খবরটি দেখতে পাইনি। আজ যদিও নমো নমো করে খবরটি অনেক কাগজই ফলো করেছে। তবে ওই পর্যন্তই।
বিগত কয়েক বছরে দেশের সামাজিক পরিকাঠামো যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এটা জলের মতো পরিষ্কার যে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমদের প্রতি আমদানীকৃত ঘৃণার ক্রমাগত চাষই সাবিরদের উপর শিয়রে সমন জারি করে মারছে এই গোরক্ষার নামক ভণ্ডামি। অথচ এই অমানুষিক ঘটনা ঘটার পরও মিডিয়াকুলের প্রতিবাদ যেমন দেখিনি। তেমনি ঘটনাটির পিছনের কারণটিও যে মিথ্যা সেটা নিয়েও তাদের তেমন প্রতিবাদ দেখার আশা রাখি না। কারণ, খবর এখন নিছক খবর নয় যে সেটা মানুষকে তথ্যসমৃদ্ধ করবে। খবর এখন মানুষকে ভয়, উৎকণ্ঠা, টেনশনে রাখার প্যাকেজ। যে প্যাকেজে ঠিক মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাবি আদায়ের মাফিয়ারাজের মত সান্ধ্য আলোচনাটা যেভাবে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় দিনের পর দিন যে, মানুষ ভাবতে বাধ্য হয় হ্যাঁ, বাংলার মানুষের সমূহ বিপদ। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বিগত আড়াই মাস ধরে চলা আরজি কর-কাণ্ড। ঘটনাটি ন্যক্কারজনক, লজ্জার, অসম্মানের চূড়ান্ত পর্যায়ের সেই বিষয়ে আপামর কোনও মানুষেরই দ্বিমত নেই। আমরা সকলেই অপরাধীর চরম শাস্তির দিন গুনছি। যতটুকু বুঝি তাতে আইন মেনেই তদন্ত চলছে।
কিন্তু মিডিয়ায়? সেখানে তো সংবিধান স্বীকৃত আইনের পথ চলে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের মুকুট পরা তাদের কিন্তু নিজস্ব স্টাইলের আইন রয়েছে। যে আইন চলে ভয়, আতঙ্ককে হাতিয়ার করে। আরজি করের মতো ঘটনাতেও তার ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না।
এরাই প্রতিদিন কয়েকজন ধামাধরা লোকজনদের স্টুডিওতে বসিয়ে কিছু সূত্র মারফত মিথ্যা তথ্যকে বিশ্লেষণ করে। যেমন দেড়শো গ্রাম চটচটে আঠাল তরল থেকে সেই আলোচনা পেলভিক বোন ভাঙা হয়ে সেমিনার রুমে পৌঁছায়। আর সেই গণধর্ষণ যাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য এখনও অবধি সম্পন্ন হয়নি মিডিয়ার কিন্তু বিশ্লেষণের কাটাছেঁড়ার ঘটনাটির গণধর্ষণ চলে রোজ।

আরও পড়ুন- ৬টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন, চলছে জনসংযোগ, প্রচারে সমর্থনের উচ্ছ্বাস

আজকাল বলতে নিজেরই বিতৃষ্ণা লাগে যে, আমিও এই মিডিয়া জগতেই ত্রিশ বছরের বেশি কাজ করেছি। কিন্তু মিডিয়ার এমন মাফিয়াগিরি কখনও দেখিনি। একসময় দাউদের ভয়ে মুম্বইয়ের কোটিপতিরা যেরকম ভয়ে ভয়ে দিন কাটাত ঠিক সেইভাবেই বাংলার মিডিয়াও ভয়াল বিচার বিশ্লেষণের গোলকধাঁধায় মানুষকে আতঙ্কের প্রহর গুনতে বাধ্য করছে।
এই তো ক’দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ডানা নিয়েও যেরকম মিডিয়া ট্রায়াল চলল তাতে মনে হচ্ছিল, এক ঝড়েই উপকূলবর্তী বাংলার ধ্বংস আটকায় কার সাধ্য!
এই তিল নামক ঘটনাটিকে নিত্যনতুন ফিকির খুঁজে তাল বানানোর ড্রামায় রূপান্তরিত করে দর্শক টানাই বর্তমান মিডিয়া হাউসগুলোর একমাত্র দায় ও দায়িত্ব। তাই আমাদের মতো সেকেলে কাগুজে বৃদ্ধরা সন্ধেবেলায় খবর শোনার চিরাচরিত নেশাতে টিভি খুললেই মনে হবে গোটা বাংলা জুড়ে জুজুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রসঙ্গত বলি, আমার এক আত্মীয় আরজি কর নিয়ে মিডিয়ায় যেন নিউক্লিয়ার বম্ব পড়ছে মুহুর্মুহু সেই সময় তারিখটা সম্ভবত পনেরোই আগস্ট সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ লোকাল ট্রেনে বর্ধমান যাচ্ছিল। ওর কথায়— যখন ট্রেনে উঠি প্রচণ্ড ভিড় ছিল। বর্ধমানের চারটে স্টেশন আগে লেডিস কম্পার্টমেন্ট সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়। লাস্ট যে দুজন ছিলেন ওঁরা নেমে যাচ্ছে দেখে আমি ভাবলাম জেনারেলে চলে যাই। কিন্তু ওরাই বারণ করল শুধু নয় রীতিমতো আশ্বাস দিল যে, কিছু হবে না। আমরা রোজ আসা-যাওয়া করি। কোনও ভয় নেই। এবং কোনও সমস্যা হয়নি সেদিন বর্ধমান পৌঁছাতে। সমস্যা তো তখন হয় যখন এইকথা লিখে সে পোস্ট করে ফেসবুকে। সেটি পড়ে তার আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনের অনেকেই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন ও মেসেজ করে যে এটা করা তার উচিত হয়নি। কারণ চারপাশের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
আমার আত্মীয়টি আফসোসের সঙ্গে বারবার একটিই কথা বলছিল, এই মিডিয়া মানুষকে মানসিক রোগী করে দেবে। সবার মানসিক দৃঢ়তা সমান নয়, অনেকেই ভিতু, নরম স্বভাবের। তাদেরকে এই মিডিয়া ক্যাম্পেইন আরও আতঙ্কিত করে দিচ্ছে। এই আতঙ্কে না কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়! গত পরশুই কাগজে দেখলাম, এক মা তার ক্লাস এইটের মেয়েকে হত্যা করেছে, কারণ টিভিতে রোজ আরজি কর কাণ্ড দেখে তার মনে হয়েছে চারপাশের পরিবেশ তার মেয়ের জন্য সুরক্ষিত নয়।
বলুন তো এই মাফিয়াগিরির দায় কি নেবে মিডিয়া? তিলোত্তমার ক্ষেত্রে মিথ্যার ফুলঝুরি ছিটিয়েও ক্লান্তিহীন সাংবাদিককুল সাবিরকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারার প্রমাণ দেখেও নীরব নিশ্চুপ? এক্ষেত্রে কেন হয় না একটিও ঘণ্টাখানেক? আপনাদের কাওকে এটাও বলতে শুনি না, সাবিরের পরিবারটি কীভাবে বাঁচবে? সাবিরের জাস্টিসের কী হবে?
আচ্ছা, তিলোত্তমার ঘটনা আর সাবির মালিকের ঘটনা— দুটোই তো সামাজিক অবক্ষয়ের চরম নিদর্শন। কেন এই বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতা সম্বন্ধে আলোচনা করে না মিডিয়া? টিআরপির ব্যবসায়িক লাভ নেই… বাংলার মাটি সাম্প্রদায়িক নয়… আর সাবির গরিব… তাই না? অথচ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে হরিয়ানা সরকারের কাছে সাবিরের মৃত্যুর দায় কার এই প্রশ্ন প্রেস মিডিয়ার সাংবাদিকদের রাখাটা কি দায়িত্ব নয়? হয়তো নয়। তাই জন্যই কাগজের সাত-আট নম্বর পাতার এককোণে কয়েক লাইন শুধু লেখা থাকে, ওটা গরুর মাংস ছিল না। ব্যাস ওটুকুই।
সাংবাদিক হিসাবে আমি হয়তো বিশাল কিছু কেউকেটা নই। কিন্তু এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, যবে থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসেছে তখন থেকেই সাংবাদিকতার সলিলসমাধি ঘটেছে। আর তার ফলাফল হিসাবে সামাজিক অবক্ষয়তার নিদর্শন প্রতি পদে অনুভূত হচ্ছে। এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার সমৃদ্ধ মিডিয়া ট্রায়ালের জন্যই সত্য থেকে মানুষ দূরে চলে যাচ্ছে। মিথ্যকেই আঁকড়ে ধরছে। জানি না এই মাফিয়ারাজের শেষ কোথায়?
এরই মাঝে আমি একটাই আলো দেখি… ওই যে যেদিন নবান্নের চোদ্দোতলার ঘরে সাবিরের তিন বছরের বাচ্চাটা ঘরে থাকা অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে যেতে চাইছিল। ওখানেই একটা সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা তার মাকে সান্তনা দিতে দিতে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে মাছগুলো দেখাচ্ছিল।
মাছ সে দেখেছে কিন্তু রঙিন মাছ দেখেনি। খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠছিল তার চোখমুখ। এই আলোটিরই নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিডিয়ার মাফিয়ারা যতই আঁধারের কালিমা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন তিনিই বাংলার প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনের দোসর।

Latest article