কারা যেন ভালবেসে আলো জ্বেলে ছিল

রেড রোড ফেরত এক দর্শক। হাতে জলের বোতল। কাঁধে ক্যামেরা। পিঠে ব্যাগ। আকাশবাণীর কোল ঘেঁষে এগিয়ে চলেছেন ব্রেবোর্ন রোডের দিকে।

Must read

অভিজিৎ ঘোষ: রাত দশটা। রেড রোড ফেরত এক দর্শক। হাতে জলের বোতল। কাঁধে ক্যামেরা। পিঠে ব্যাগ। আকাশবাণীর কোল ঘেঁষে এগিয়ে চলেছেন ব্রেবোর্ন রোডের দিকে। গলা ছেড়ে গান ধরেছেন ‘কারা যেন ভালবেসে আলো জ্বেলেছিল/ সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল।’ রেড রোডের পাঁচ ঘণ্টার বেশি পুজো কার্নিভালের সার সত্যটা ঠিক যেন গানের দুটি লাইনেই স্পষ্ট।

আরও পড়ুন-ঐতিহ্য-শিল্প-সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনে বিস্মিত বিদেশিরাও, রেড রোডে উৎসবের বিশ্বায়ন

নিঃসন্দেহে বাংলার সেরা উৎসব দুর্গাপুজো। কলকাতার পুজো গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষ দেখতে আসেন। কেন আসেন? তার কারণ একদিকে বৈচিত্র্য, অন্যদিকে আধুনিকতা। আবার তার সঙ্গে মিশে যায় বাংলার ঐতিহ্য, ভারতের ঐতিহ্য। ফুটে ওঠে শিল্প-সংস্কৃতির মূল ভাবনা। অজানা বহু কিছু। কিন্তু ২০২২-এ পুজো কার্নিভালের পর নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে প্রতি বছর মানুষ এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকবেন। এটাও এখন বাংলার উৎসবের আকর্ষণের সেরা কেন্দ্রবিন্দু।

আরও পড়ুন-ভূতের গল্প নয়

ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর বিদেশিরা দল বেঁধে শনিবার এসেছিলেন পুজো কার্নিভালে। কেউ পাজামা-পাঞ্জাবিতে, কেউ আবার শাড়িতে। হাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ছোট্ট উপহার। কখনও ক্যামেরায় চোখ রেখেছেন। কখনও হাততালি দিয়েছেন। কখনও তালে তাল মিলিয়েছেন। কেউ কোমরও দুলিয়েছেন। দেবী দুর্গার যে এত রূপ হয়, তা দেখে বিস্মিত। মূর্তি কিংবা মূর্তিকে ঘিরে থিম-ভাবনা যে
এমন বৈচিত্র্যময় হয়, তা কল্পনাতেও
আসেনি। বারবার শোনা গিয়েছে, মার্ভেলাস, ফ্যাবিউলাস, স্‌প্লেনডিড, বিউটিফুল, গর্জিয়াস, অসাম।
দেখার সুযোগ ছিল হাজার বিশেক মানুষের। তার চেয়ে দেড়গুণ বেশি মানুষ রেড রোড ঘিরে ভিড় করেছিলেন। যারা বুদ্ধিমান তারা চলে গিয়েছিলেন ইডেনের দিকে। কারণ, মিছিলগুলো ওই দিক দিয়ে বেরিয়েই বাবুঘাটে বিসর্জনের জন্য যাচ্ছিল। ফলে রথ দেখা, কলা বেচা দুই সাধই মিটেছে এক যাত্রায়।

আরও পড়ুন-গর্জন তেল

রেড রোড জুড়ে অনুষ্ঠান। পুলিশের চ্যালেঞ্জ ছিল শহরকে সচল রাখা। অন্যদিকে উৎসবকে সফল করা। ধর্মতলা থেকে রবীন্দ্র সদন, ব্রেবোর্ন রোড থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু, প্রতি মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের টিম। এতটুকু কোথাও তর্ক-বিতর্ক, ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা কিংবা মনোমালিন্যের দৃশ্য ছিল না। পুলিশের কথা মানুষ শুনেছেন। গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুলিশও নির্দেশ দিয়েছেন ঠাণ্ডা মাথায়। আবার ধুমপানে যারা অভ্যস্থ তাদের হাতজোড় করে বলেছেন, প্লিজ লাইটারটা রেখে যাবেন।
পুজো কমিটিগুলো প্যান্ডেলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। দশ মিনিটের রেড রোড যাত্রায় প্রমাণ করার ছিল আমরাও আলাদা। এই তাগিদেই দর্শকরা কলকাতা শহরতলির সেরা ৯৪টি প্রতিমা তো দেখলেনই সেইসঙ্গে শুনলেন এবং দেখলেন তিন মিনিটের পুজোর থিম। যা গোটা উৎসবকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলেছিল।

আরও পড়ুন-রেড রোডে বিদায় বেলায় আনন্দের সুর

এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা উৎসবের নিউক্লিয়াস। এর আগে বাংলার কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ কাঁসর-ঘণ্টা, করতাল কিংবা ঢাক বাজাতে দেখেননি। আদিবাসী নৃত্যের তালে তালে পা মেলানোর কথাও ঘুনাক্ষরে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ব্যতিক্রমী, তাই মানুষের বুকের ‘লাবডুব’ অনুভব করতে পারেন। তাই পুজো কার্নিভালের মতো অনুষ্ঠানের কথা ভাবতে পারেন, বাস্তবায়িত করতে পারেন, সফল করতে পারেন, তাকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিতে পারেন এবং ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায় করে পুজো কার্নিভালের মঞ্চকে বর্ণময় করে তুলতে পারেন। ২০২২-এর ৮ অক্টোবর দিনটি রেড লেটার হিসেবে বাংলার উৎসব ঐতিহ্যে থেকে যাবে।

Latest article