সৌন্দর্যের গাণিতিক প্রমাণ গোল্ডেন রেশিও

আমরা কি সুন্দর? না বলে বলা উচিত আমরা কি গাণিতিকভাবে সুন্দর? প্রশ্নটা উদ্ভট হলেও একেবারে যুক্তিযুক্ত। কারণ সোনালি অনুপাত-এর মানদণ্ডই ঠিক করে সৌন্দর্য। আজ সেই আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

Beauty lies in the eyes of the beholder কথাটি আমাদের সকলেরই জানা। দেশ, কাল, জাতি ও মানুষভেদে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যাও বিভিন্নরকম। তবে আমরা সার্বিকভাবে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ জিনিসকে সুন্দর বলে জানি, যার সবচাইতে বড় উদাহরণ হল গোলাপ। তাহলে এই সৌন্দর্য যদি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর হয়, তবে গণিত তা কেমন করে প্রমাণ করবে? গণিতের এক বিশেষ অনুপাত নির্ধারণ করে সৌন্দর্য। পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তার মান নাকি এই অনুপাতের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কিন্তু এই অনুপাতের কম কোনও মানকে গণিত সুন্দর বলে মানে না, তা সে যতই সুন্দর হোক না কেন। গণিতের মানের ভিত্তিতে সেটিকে সৌন্দর্য্যের তালিকা থেকে বাদ দিতেই হয়। তাহলে কী এই সোনালি অনুপাত— চোখ রাখা যাক তার বৃত্তান্তে।
আবিষ্কার
পাইথাগোরাস এবং প্রাচীন গ্রিসের ইউক্লিড থেকে শুরু করে পিসার মধ্যযুগীয় ইতালীয় গণিতবিদ লিওনার্দো এবং রেনেসাঁর জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার বহু সময় ব্যয় করে এই অনুপাতের জন্ম দেন। যদিও এই অনুপাতের জনক বলতে মূলত ইউক্লিড-কেই বোঝানো হয়।
প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদরা জ্যামিতিতে এই অনুপাতের ঘন ঘন উপস্থিতির কারণে প্রথমে এটি অধ্যয়ন করেছিলেন। আমরা প্রায় সকলেই এই কথাটি জানি যে জ্যামিতিতে পেন্টাগ্রাম এবং পেন্টাগনগুলির ‘চরম এবং গড় অনুপাত’-এর ক্ষেত্রে একটি রেখার বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ। একটি কাহিনি অনুসারে আমরা জানতে পারি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গণিতবিদ হিপ্পাসাস আবিষ্কার করেছিলেন যে সোনালি অনুপাতটি পুরো সংখ্যা বা ভগ্নাংশ নয় (এটি অযৌক্তিক), যা পাইথাগোরিয়ানদের কাছেও এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল। যদিও ইউক্লিডের তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে আমরা এই অনুপাতের একটি দিক খুঁজে পাই। পরবর্তীতে আরও অনেক বিজ্ঞানী গণিতজ্ঞ এই অনুপাত নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং তাঁরা খুব অদ্ভুতভাবে এই অনুপাতের সঙ্গে ফেবোনাচ্চি সিরিজের সংযোগ খুঁজে পান।

আরও পড়ুন-মানবিক পুলিশ, কেন্দ্রে পৌঁছল প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থী

সোনালি অনুপাতের সারমর্ম
Golden Ratio বা সোনালি অনুপাতকে প্রকাশ করা হয় ল্যাটিন অক্ষর Φ/ φ (PHI/ ফাই) দ্বারা যার মান ১.৬১৮০৩৩৯৮৯ (প্রায়)। বলা বাহুল্য এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। আমরা যদি সোনালি অনুপাতের সংজ্ঞা দিতে চাই তাহলে বলতে পারি— দুইটি সংখ্যার মধ্যে বৃহত্তর সংখ্যাটির সাপেক্ষে ঐ দুইটি সংখ্যার যোগফলের অনুপাত যদি ক্ষুদ্রতর সংখ্যার সাপেক্ষে বৃহত্তর সংখ্যার অনুপাতের সমান হয় তবে সংখ্যা দুটি সোনালি অনুপাতে থাকবে বলে ধরে নেওয়া হয়।
যেখানে a বৃহত্তর সংখ্যা এবং b ক্ষুদ্রতর সংখ্যা। a এবং b দুইটি সংখ্যার মধ্যে সোনালি অনুপাত বজায় থাকলে—
a+b/a=a/b=
অথবা, (a/b)+1)/(a/b) = a/b
যেহেতু a/b = φ সুতরাং, (φ+1)/ φ = φ
অথবা, φ +1 = φ ^2
অথবা, φ ^2 = φ+ 1
অথবা, φ ^2 – φ-1 = 0
উপোরোক্ত সমীকরণটি একটি দ্বিঘাত সমীকরণ যার
সমাধান হচ্ছে : φ = (1+ √5)/2 = 1.618033
আবার, (1-√5)/2 = 0.6180
এবার আসা যাক এই ফিবোনাচ্চি সিরিজের কথায়।
ফিবোনাচ্চি সিরিজ
0, 1, 1, 2, 3, 5, 8, 13, 21
এইটা হল ফিবোনাচ্চি সিরিজ। এই সিরিজের যে-কোনও সংখ্যা তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান হয়। যেমন— 0+1=1, 1+1=2, 2+1=3, 3+2=5, 5+3 =8 ………. ইত্যাদি।
ফিবনাচ্চি সিরিজের যে-কোনও সংখ্যাকে তার আগের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাই ফাই (PHI)। প্রথম কয়েকটা ক্ষেত্রে হিসাব কিছুটা বিদঘুটে মনে হলেও ফিবনোচ্চি সিরিজ ধরে যত সামনে যাওয়া হবে তত ক্রমিক সংখ্যাদ্বয়ের অনুপাত ফাই-এর দিকে এগোতে থাকবে এবং মোটামুটি ৩৯তম স্থান থেকে ক্রমিক সংখ্যাদ্বয়ের অনুপাত প্রায় ধ্রুবক হয়ে যাবে। যেমন
2/1=2,
3/2=1.5,
5/3=1.665,
8/5=1.6,
13/8=1.625,
এখানে প্রথম দুটি ভাগফল বাদ দিলে বাকি ভাগফলগুলোর মান প্রায় সমান বা ধ্রুবক।
আবার এটাকে যদি উল্টো করে বলা যায়, তাহলে আমরা বলতেই পারি 1 : 1.618 = 0.6180…। এই 0.6180… কেও কিন্তু গোল্ডেন রেশিও বলা হয়।
সোনালি অনুপাতের প্রয়োগ
প্রাচীনকাল থেকে স্থাপত্যে সোনালি অনুপাত প্রয়োগ করা হয়ে আসছে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হল ভারতের আগ্রায় অবস্থিত তাজমহল। এর স্থাপত্যশৈলীতে সোনালি অনুপাতের ব্যবহার দেখা যায়। তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান জামে মসজিদের (Great Mosque of Kairouan) জ্যামিতিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এটি নির্মাণে সুস্পষ্টভাবে সোনালি অনুপাত প্রয়োগ করা হয়েছে। শুধু এগুলোই নয়, মিশরের পিরামিড হোক বা গ্রিসের পার্থেনোন, লিওনার্দোর আঁকা মোনালিসা হোক বা শামুকের খোলকের প্যাঁচ সবেতেই এই অনুপাতের ছাপ রয়েছে। কেবল দ্য ভিঞ্চিই নয়, মাইকেল আঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো, আলব্রেখট দ্যুরার-সহ আরও অনেক নামকরা চিত্রশিল্পী তাঁদের শিল্পীসত্তায় এই অনুপাতের ছাপ রেখে গেছেন। এখনকার দিনে অ্যাপেল কোম্পানির লোগোতে এমনকী অলিম্পিকের লোগোতেও এই ছাপ মেলে।

আরও পড়ুন-ভুয়ো ভোটার কার্ড চক্রান্তের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি তৃণমূলের

মানবদেহে সোনালি অনুপাতের অস্তিত্ব
সকল বয়সের নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেই, কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং হাঁটু থেকে পায়ের আঙুলের মাথা পর্যন্ত দূরত্বের অনুপাত ফাই, দেহের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ও নাভির নিচ থেকে বাকি অংশের দৈর্ঘ্যের অনুপাত হল 1.618। বাহু-র সাথে সম্পূর্ণ হাত-এর অনুপাতের মান হল 1.6180। আঙুলের অগ্রভাগ থেকে কনুই-এর দৈর্ঘ্য এবং কবজি থেকে কনুই এর দৈর্ঘ্যের অনুপাত 1.6180। মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত 1.6180। ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ও নাকের প্রস্থের অনুপাত 1.6180। আসলে গণিত মতে আমাদের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে এই মানকে স্বাভাবিক মান হিসেবে ধরা হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বিচ্যুতি দেখা যায়। আর যেখানে এই মানের বিচ্যুতি থাকে না তাই হয়ে ওঠে সুন্দর। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে— আমরা সাধারণত মুখ দেখেই কোনও মানুষ সুন্দর না অসুন্দর সেটা বিচার করি তাই মুখমণ্ডলের মাপের ক্ষেত্রে এই অনুপাত বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়।

জীবকুলে সোনালি অনুপাতের অস্তিত্ব
শুধু মানবদেহই নয়, গোটা প্রাণিকুল ও উদ্ভিদকুলে সোনালি অনুপাত বিদ্যমান। মৌচাকে স্ত্রী মৌমাছি ও পুরুষ মৌমাছির সংখ্যার অনুপাত ফাই। ফুলের ভেতর প্রতি স্তরের রেণুর সঙ্গে পরের স্তরের রেণুর অনুপাত ফাই। গাছের শাখা-প্রশাখার বৃদ্ধি তাতে পাতার বৃদ্ধির অনুপাত ফাই। মাছি, ওয়াইল্ড ডগ ইত্যাদির চলাফেরার পথ কিংবা আক্রমণের পথ হয় সোনালি প্যাঁচ অনুযায়ী (মানে ফাই)। এমনকী শামুক-ঝিনুক-সী-শেল এসবেও তাদের খোলকের প্যাঁচে রয়েছে ফাই।
আসলে মানুষের চোখে কোনও বস্তুকে খুব সহজে উপভোগ্য করে তুলতে তাকে যেরকম আকারের হতে হয় বা যেরকম আকার দেখলে আমরা সেই জিনিসকে সুন্দর বলে মানব তারই এক হিসাব হল এই অনুপাত। সে-জন্যই বিখ্যাত অনেক শিল্পীই তাঁদের কাজে ফাই-এর প্রয়োগ করেছেন। যেমন আগ্রার তাজমহলে, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারে। মনে করা হয় এই অনুপাত মেনেই সৃষ্টি করা যায় সৌন্দর্যের। শুধু পৃথিবীই কেন এরকম আরও অসংখ্য ফাই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে সৌরজগতে ও মহাবিশ্বের আনাচে কানাচে।
আমাদের ধারণায়, কল্পনায় যা কিছু সুন্দর তাই নাকি থাকে স্বর্গে। আর এজন্যই একে বলা হয় The number of life, The divine proportion (স্বর্গীয় অনুপাত)।

Latest article