মিথ্যে কথা বলতে বলতে এমন অবস্থা হয়েছে গদ্দার-কুলের লোডশেডিং অধিকারী ও তাঁর দলবলের যে আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়েও তাঁরা দেখছেন অন্ধকার, বুঝে উঠতে পারছেন না বাস্তবতা। এ-বারের রাজ্য বাজেটের পর এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়
একটা ছবি দেখিয়ে শুরু করা যাক। আমাদের এই রাজ্যের নয়। সমগ্র দেশের। সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সঙ্কটজনক অবস্থা অথবা সমস্যার সমাধান হয়। আমাদের দেখা যাচ্ছে উল্টো। ২০০৫ সালে ভারতের ১৭ শতাংশ প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এবং সাব-সেন্টার চলত ডাক্তার ছাড়াই। এই অবস্থার তো উন্নতি হওয়া উচিত! তা তো হল না! ২০২১-’২২ সালের হিসেবে দেখা যাচ্ছে এখন ডাক্তারহীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ২২ শতাংশ। ২০০৫ সালে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার স্পেশালিস্ট ডাক্তারহীন ছিল। এখন কত? ৬৮ শতাংশ! ডবল ইঞ্জিন সরকার নাকি এগিয়ে নিয়ে চলে । তাই বুঝি মধ্যপ্রদেশের ৯৫ শতাংশ কমিউনিটি সাব সেন্টার চলে স্পেশালিস্ট চিকিৎসক ছাড়া!
ভারত সরকার দাবি করে কাশ্মীরের সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করেছে। গ্রামে গ্রামে সোলার প্যানেল আছে। কিন্তু সমস্যা হল বছরে অন্তত ৬ মাস মেঘলা, তুষারপাত। তখন সোলার প্যানেল দিয়ে কী হবে? সূর্যই তো নেই! অতএব হারিকেন ভরসা। তবে নিয়ম হল ইনভার্টার কেনা। সেটা চার্জ করার জন্য জেনারেটর। ভারতের ১০০ শতাংশ বাড়িতেই নাকি বিদ্যুৎ যাচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে। আবার বলা হচ্ছে, সেই বিদ্যুতের বিল হবে জিরো। এই স্লোগানের অস্ত্রের নাম সোলার বিদ্যুৎ। কিন্তু সেই বিদ্যুতের এই হাল যখন, তখন কাশ্মীরের এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ কী করে? বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এই প্রবল শীত আর বিদ্যুৎহীন ঘর ছেড়ে দিয়ে ৬ মাসের জন্য মাইগ্রেশন হয় গ্রামের পর গ্রামের।
এসব নাকি বিকশিত ভারতের নমুনা! অন্য দিকে এই রাজ্যের দিকে তাকান। বাজেট পেশের পর গদ্দার অধিকারী ও তাঁর দলবল বিধানসভার ভেতরে বসে অভব্যতার চূড়ান্ত নমুনা দেখাল গত বৃহস্পতিবার। আর সেই বাজেট আমাদের, আপামর রাজ্যবাসীকে কী দিল, দেখে নিন। চমকে যাওয়ার মতো বাজেট প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করলেন মা-মাটি-মানুষের সরকার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে দ্বিগুণ অনুদান, জবকার্ড হোল্ডারদের জন্য ৫০ দিনের কাজ, আলুচাষিদের শস্যবিমার প্রিমিয়াম ‘মকুব’, স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড়, পাঁচ লক্ষ সরকারি নিয়োগ, সব মিলিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের জন্য যে বাজেট পেশ হয়েছে তার থেকে একটা কথাই স্পষ্ট। চরম কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, হাজারো আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিছিয়ে আসেননি। বরং মূল্যবৃদ্ধির এই আবর্তে সাধারণের হাতে নগদের জোগান বাড়ানোর যে ফর্মুলা দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা, তাও মান্যতা পেয়েছে মা-মাটি-মানুষ সরকারের এই বাজেটে।
সামাজিক সুরক্ষা চিরকালই মা-মাটি-মানুষের কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে। এবারের বাজেটেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাজেটে সবথেকে জোর দেওয়া হয়েছে নারী ক্ষমতায়নে, মা-বোনদের হাত মজবুত করার বিষয়ে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মাসিক অনুদান ৫০০ থেকে বেড়ে হচ্ছে ১,০০০ টাকা। তফসিলি জাতি-উপজাতির মহিলা এখনই এই খাতে হাজার টাকা পান। তা বেড়ে হবে ১,২০০ টাকা। এর জন্য বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার দায়ভার চাপছে সরকারের কাঁধে। পাশাপাশি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য অনুদান বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা দু’বছর ধরে বন্ধ রেখেছে কেন্দ্র। এই পরিস্থিতিতে জবকার্ড হোল্ডারদের মজুরি বাবদ ৩,৭০০ কোটি টাকা চলতি মাসেই মিটিয়ে দেবে রাজ্য। পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ৫০ দিনের কাজের গ্যারান্টির ‘কর্মশ্রী’ চালুর কথাও ঘোষণা হয়েছে বাজেটে। এছাড়া রয়েছে ক্ষুদ্রশিল্পে উৎসাহ দিতে উদ্যোগপতিদের জন্য কোনওরকম ‘জামানত’ ছাড়া ১০০ শতাংশ ঋণ, মৎস্যজীবীদের জন্য নয়া প্রকল্প ‘সমুদ্রসাথী’, সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিসের ১০০০ টাকা সাম্মানিক বৃদ্ধি, সরকারি দপ্তরের পাঁচ লক্ষ পদে চাকরির মতো আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপও। অনলাইনে পড়াশোনার জন্য এবার একাদশ শ্রেণি থেকে পড়ুয়াদের ট্যাবলেট/স্মার্টফোন দেওয়ার ঘোষণা করে গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে নিজেদের ফারাক বুঝিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকার যে বাজেট এদিন পেশ করা হয়েছে, তাতে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ মাত্র সাত কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার সবথেকে বড় শিকার গ্রামীণ অর্থনীতি। এই বাজেটের ফোকাসও তাই গ্রাম-বাংলার অর্থনীতি। আবাস যোজনায় বঞ্চিত উপভোক্তাদের কথা উঠে এসেছে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বাজেট বক্তৃতায়। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আর একমাস অপেক্ষা করবে রাজ্য সরকার। তার মধ্যে কেন্দ্র টাকা না মেটালে, ১১ লক্ষ উপভোক্তাকে রাজ্যের কোষাগার থেকেই অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
এখানেই শেষ নয়। নতুন বছরের শুরু থেকেই ৪ শতাংশ অতিরিক্ত মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) পাচ্ছেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা। একমাস যেতে না যেতে আবার নতুন কিস্তির ঘোষণা। মিলবে আরও ৪ শতাংশ ডিএ। রাজ্য সরকারি কর্মীরা শুধু নন, এতে উপকৃত হবেন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মী, পুরসভা-পঞ্চায়েতের কর্মী এবং পেনশন প্রাপকরা। রাজ্য বাজেটে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি দপ্তরে চুক্তিতে নিযুক্ত গ্রুপ ডি ও সি কর্মচারীদের মাসমাইনে বাড়ছে যথাক্রমে ৩,০০০ এবং ৩,৫০০ টাকা। একইভাবে চুক্তিতে নিযুক্ত তথ্য-প্রযুক্তি কর্মীরাও পদ অনুযায়ী বর্ধিত বেতন পাবেন। ডি এ নিয়ে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার শোনা যায়। তাই, বিষয়টির বিস্তৃততর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জানুয়ারি থেকে ১০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পান রাজ্য সরকারি কর্মীরা। বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী, মে মাসে তা বেড়ে হবে ১৪ শতাংশ।
আরও পড়ুন- গরম পড়ার আগেই তৎপরতা কলকাতা পুরসভায়, পানীয় জল উৎপাদনে বাড়তি নজর
শুধু মহার্ঘ ভাতা নয়, চুক্তিতে নিযুক্ত গ্রুপ ডি এবং সি কর্মীদের ন্যূনতম মাসিক বেতন যথাক্রমে ১২,০০০ ও ১২,৫০০ টাকা। তা যথাক্রমে ৩,০০০ এবং ৩,৫০০ টাকা বাড়বে বলে বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে। ৫০ হাজার কর্মীকে এই সুবিধা দিতে আগামী আর্থিক বছরে সরকারের খরচ বাড়বে ২৮৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন শ্রেণির চুক্তিতে নিযুক্ত ১২ হাজার তথ্য-প্রযুক্তি কর্মীর বেতনও পদ অনুযায়ী বাড়ছে। আগামী আর্থিক বছরে সেই খাতে ১৩২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করবে রাজ্য সরকার।
সব মিলিয়ে এই বাজেট গরিব ও মধ্যবিত্তের বাজেট। এই বাজেট মা-বোনদের হাত শক্ত করার বাজেট। নারী-বিদ্বেষী, বাংলা-বিরোধী গদ্দার অধিকারীরা বরং দাদ-চুলকানির মলম লাগিয়ে নিন। আরাম পাবেন!