শান্তি, স্থিতি, সমৃদ্ধি— এই মূল মন্ত্র নিয়ে ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস-এর মাধ্যমে যে পরিবর্তনের সূর্যোদয় হয় সেখানে একদিকে প্রয়োজন ছিল রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি যার ভিত্তিতে বাংলার মানুষ উন্নয়নের ভাগীদার হয়ে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরুত্থান করবে। তাই জনগণের যে আবেগ নিয়ে ‘‘দিদি”র হাতে বাংলার শাসনভার এসেছিল তা কতটা সফল তারই এক আখ্যান মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ‘‘উন্নয়নের পাঁচালী”র মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন।
আরও পড়ুন-মহানদীর তীরে আজ নতুন চ্যালেঞ্জ সূর্যদের, প্রস্তুতি এড়ালেন হার্দিক, নেটে দু’ঘণ্টা ব্যাট শুভমনের
মানুষের জমির অধিকার (সিঙ্গুর রায়) তথা জমি অধিগ্রহণ আইনের পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থাৎ জবর দখলের বিরুদ্ধে মানুষের ‘‘দিদি” সরকারি কাজের সূচনা করেন। লাল আমলের আমলাশোলের ঘটনা যাতে এই বাংলাকে আর না দেখতে হয় তাই খেটে খাওয়া গরিব মানুষের অন্নসংস্থান সুনিশ্চিত করে ‘‘খাদ্য সাথী” প্রকল্পের সূচনা করেন দিদি। সেই প্রকল্প আবার সকলের দ্বারে পৌঁছানোর জন্য পরবর্তীকালে ‘‘দুয়ারে রেশনে”র ব্যবস্থা আজ সর্বজনবিদিত।
১৪ বছরে রাজ্যে ২ কোটিরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার বাইরে আনা গেছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তথা জিডিপি (Gross Domestic Product) বেড়েছে, এবং কর ও রাজস্ব আদায় ৫.৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলধনী খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৭.৬৭%। নতুন কোম্পানির সৃষ্টি (২০১০ সালে ১২১৪৯৬, ২০২৫ সালে ২৫০৩৪৩) হয়েছে। আবার কেন্দ্রের বঞ্চনা সত্ত্বেও রাজ্যের নিজস্ব উদ্যোগের ফসল— ‘বাংলা সড়ক যোজনা’য় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কিমি গ্রামীণ রাস্তা, ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা, ‘বাংলার বাড়ির’ মাধ্যমে মাথার ছাদের ব্যবস্থা প্রভৃতি। এটাই সরকারের দায়বদ্ধতার ও সংকল্পের প্রমাণ।
এছাড়াও ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘রূপশ্রী’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তরুণের স্বপ্ন’, ‘যোগ্যশ্রী’, ‘মেধাশ্রী’, ‘শিক্ষাশ্রী’, ‘ঐক্যশ্রী’, ‘স্বামী বিবেকানন্দ মেরিটকাম মেন্স স্কলারশিপ’, ‘আনন্দধারা’, ‘জল স্বপ্ন’, ‘নন-নেট ফেলোশিপ’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘স্বাস্থ্য ইঙ্গিত’, ‘টেলিমেডিসিন’, ‘ন্যায্য মূল্যে ওষুধের দোকান’-সহ অসংখ্য জনমুখী প্রকল্প রাজ্যের সামাজিক সুরক্ষার চিত্রটা পাল্টে দিয়েছে। বিশেষত ২.২১ কোটিরও বেশি মহিলা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন, যা মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ। কাজের ক্ষেত্রে বাংলা এখন ভারতের মডেল। ১২ লাখ স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের মধ্যে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অন্যতম দিক। যেখানে দিদির আবেগ হল মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। ঐক্য ও সম্প্রীতির লক্ষ্যেও তিনি সচেতন। দিদির মতে, বাংলায় সব ধর্ম সুরক্ষিত এবং তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাঁর স্পষ্ট বার্তা, “বাংলা কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প হবে না।” এই উক্তিগুলি শুধু কাজ নয়, একটি মানবিক ও সংবেদনশীল সরকার গড়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলে। আসলে দিদি বাংলার সকলকে ভাল রাখার ভাবনা নিয়েই সরকার চালান, যেখানে এক একটি প্রকল্প নিয়ে লিখলে ১০০টি প্রতিবেদনও কম পড়বে।
আরও পড়ুন-মাংসখেকো গাছেরা
দিদির এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে চলেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা আমাদের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি উন্নয়নের পথে যৌবনের জোশ এবং আধুনিক রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে এসেছেন। অভিষেক দিদির বাড়ির লোক বলে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে এজাতীয় কথা যে রাজনৈতিক বিরোধীরা প্রচার করেন তারা নিশ্চয়ই ভোলেননি যে তিনি তৃণমূলের তথাকথিত শক্তিশালী ঘাঁটি দক্ষিণ কলকাতা থেকে ভোটে লড়ে আসেননি। বরং ২০১৪ সালে সরকার আসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি ডায়মন্ড হারবার থেকে ভোটে লড়ে জিতেছেন। মনে রাখতে হবে, সিপিএম তখনও শূন্য নয় এবং যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। এবং বারংবার সাংসদ এলাকার উন্নয়নের খতিয়ান প্রকাশ তৎসহ ‘‘সেবাশ্রয়ের” মাধ্যমে মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এটাই তৃণমূলের সংস্কৃতি। তার সঙ্গে যেভাবে ‘‘তৃণমূলের নব জোয়ার”-এর মাধ্যমে বুথে বুথে কর্মী সংযোগ বৃদ্ধি করেছেন তাতে মানব পরিষেবার পথ আরো প্রশস্ত হয়েছে।
ক্ষমতায় থাকা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ, কাজের ঘাটতি খোঁজা, কোনও ভুল থাকলে তার দ্রুত সংশোধন প্রভৃতি অভিষেকের সংগঠন পরিচালনার মূলমন্ত্র। তেমনি ইন্দ্র সরকার যেভাবে বাংলাকে প্রমাণ নয় বঞ্চনা করেছেন তাকে রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরা এবং মানুষের অধিকার আদায়ে দিল্লিতে রাজনৈতিক অবস্থান ও কেন্দ্র সরকারকে চ্যালেঞ্জ— তার অনন্য ভূমিকার অন্যতম দিক। রাজনৈতিক লড়াইয়ে হেরে বা জিততে না পেরে বিজেপি যখন দুর্নীতির অভিযোগে আমাদের দলকে কালিমালিপ্ত করে চক্রান্তে ব্যস্ত তখন তিনি সদর্পে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সামনাসামনি হয়েছেন এবং বলেছেন, এক পয়সার দুর্নীতির প্রমাণ হলে কোনও সাজা ঘোষণার প্রয়োজন নেই, তিনি সকলের সামনে ফাঁসিতে ঝুলবেন! এই সাহস ও দৃঢ়তা সমসাময়িক রাজনীতিতে বিরল।
তিনি প্রতিনিয়ত তথ্য ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে দল ও সরকারের বার্তা মানুষের ও দলের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ এখন মানুষের কাছে “উন্নয়নের হাব” হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি অভিষেকের বক্তব্যে আবেগের মূল সুরটি হলো সম্প্রীতি এবং অখণ্ডতা। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “কেউ কেউ চায়, বাংলায় যাতে আগুন জ্বলে। অনেকে রাজনৈতিকভাবে উন্নয়নের পরিসংখ্যানের মোকাবিলা না করতে পেরে ধর্মের নামে ভেদাভেদ করে বাংলাকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে।” একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীকে যথাযথ সম্মান তার সাংগঠনিক দূরদর্শিতার অন্যতম পরিসর। তিনি সকলকে সতর্ক করে বলেছেন, বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং সম্প্রীতি যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্য সজাগ থাকতে হবে। ‘উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গ বলে কিছু নেই, একটাই বঙ্গ, সেটা হলো পশ্চিমবঙ্গ’— এই বার্তা দিয়ে তিনি বাংলা ভাগের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন, যা রাজ্যের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও অখণ্ডতার আবেগ জাগিয়ে তোলে।
স্বাভাবিকভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌশল ও সাংগঠনিক দক্ষতার মিশেলে বাংলা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা এবং মহিলাদের ক্ষমতায়নে এমন স্থান করে নিয়েছে যা মানুষের জীবনে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এটি কেবল সংখ্যা নয়, মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে এমন একটি “পরিবর্তনের আখ্যান”, যা নতুন পশ্চিমবঙ্গের আবেগ তৈরি করেছে। এই আবেগ হল, সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজ্যের মানুষের পাশে থাকার এবং তাদের স্বপ্নের বাংলা গড়ার অদম্য জেদ। যার ফলে তৃণমূলের শাসন আগামী ২৫ বছর (নূন্যতম) নিশ্চিত বলে রাজনৈতিক টীকাকারগণ মনে করেন।

