নামে কী এসে যায়
ফাগুন, ফাগুয়া, শিগমো, উক্কুলি, মঞ্জুলকুলি— এসবই হোলির নানান নাম। নানা ভাষা নানা পরিধানের ভারতবর্ষে দোল বা হোলি উদযাপিত হয় মহাসমারোহে; তবে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে।
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দোল বা হোলির (Dol Yatra) তাৎপর্য লক্ষণীয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন বৈষম্য ভুলে রঙে, গানে, লিঙ্গ, ধর্ম নির্বিশেষে মেতে ওঠার উৎসব হল রঙের উৎসব।
শেক্সপিয়র তো বলেইছেন নামে কী আসে যায়? উত্তরাখণ্ডের কুমায়নী হোলি, বিহারে ফাগুয়া, ওড়িশায় দোলা, গোয়ায় শিগমো, মণিপুরে ইয়াওং সান কেরলে এবং নেপালে ফাগু। এত বৈচিত্রময়তা নিয়েই অত্যন্ত জনপ্রিয় এই উৎসব।
হোলির উৎস কী
এখন প্রশ্ন হল হোলির উৎস কী? সেই বিষয়ে সন্ধান করতে হলে আমরা দেখি নানা লোককথা পৌরাণিক কাহিনিতে ছড়িয়ে আছে এর উৎস। সংস্কৃত শব্দ হোলক্কা থেকেই হোলি শব্দটি এসেছে বলে অনুমান করা হয়। রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা, কুমারসম্ভব— সব কাব্যেই হোলির বর্ণনা রয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণের অনুরাগে জর্জরিত রাধিকা প্রাণমন এক করে ভেসে ছিলেন কৃষ্ণের ভালবাসায়। সেই প্রেমের রং নিয়েই সূচনা হয় দোলের (Dol Yatra)। আবার পুরাণে এ-কাহিনিও মেলে, সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেবের কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল তিনি আর কোনও নারীর সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হবেন না। কিন্তু পার্বতীর কঠিন তপস্যা মহাদেবকে নিজের করে পাওয়া সে কি বিফলে যাবে? তখন কামদেব মহাদেবের অন্তরে পার্বতীর জন্য প্রেমের ভাব জাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? কামদেব স্ত্রী রতির সাহায্য নিয়ে জোরালো রিপুবাণ ছাড়েন যখন তপস্যায় নিমগ্ন স্বয়ং মহাদেব। তপস্যা ভঙ্গ হয়ে চোখ খুলতেই জ্বলে উঠে দেবাদিদেবের ত্রিনয়ন। সেখান থেকে নির্গত হতে থাকে ভয়ানক অগ্নিবাণ। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যান কামদেব। রতির হাহাকারে বিদীর্ণ হতে থাকে কৈলাসের আকাশ-বাতাস। শিবের রোষানলে কামদেব দগ্ধ হয়েছিলেন। সেই দাহও হয়তো-বা প্রতীকী।
ভালবাসার মানুষের জন্য ব্যাকুল আর্তি এসে পৌঁছয় মানবভূমিতে। এর থেকেই সূচনা হয় কামদহনের। কাম ও রতির বিরহের স্মৃতিতে ‘কামদহন’ দিয়েই শুরু হয় তামিলনাড়ুর হোলি। এখানে হোলিকা নয় অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলেঙ্গানাতে তামিলনাড়ুর মতোই হোলির (Dol Yatra) আগে কামদাহনের পরেই শুরু হয় মূল উৎসব।
হোলিকাদহন
আবার পাশাপাশি হোলিকাদহন নিয়ে রয়েছে নানান কাহিনি। স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত আছে মহর্ষি কশ্যপ ও দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপু ও কন্যা হোলিকা হরিভক্ত প্রহ্লাদকে হত্যা করার সমস্ত ষড়যন্ত্র যখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় তখন হিরণ্যকশিপু অন্য একটি নিশ্চিত অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইলেন।
তার বোন হোলিকা নিয়ম করে অগ্নিস্নান করতেন প্রতিদিন। অগ্নিদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্তা তিনি। তাই অগ্নিস্নানেও তাঁর রূপের হেরফের হত না। তিনি স্থির করেছিলেন প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করার। যেহেতু প্রহ্লাদ অগ্নিদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত নন তাই তাঁরা যা চাচ্ছেন সেটিই হবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় ঠিক তার বিপরীত। ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে ভক্ত প্রহ্লাদের কোনওরূপ অনিষ্ট হয় না। অথচ অগ্নিদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্তা হোলিকাই ভস্মীভূত হয়ে যান।
হোলিকা দহনের এই হল পৌরাণিক ইতিহাস। অর্থাৎ অমঙ্গল আর অনিষ্টের বিনাশ ও মঙ্গলের জয়ই হল হোলিকা দহন প্রথা। হোলিকা দহনের শেষে সেই ছাই পরস্পরের কপালে ছুঁয়ে সুস্থতা ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। অনেক জায়গায় এটাই রীতি।
বাংলায় এটাই ন্যাড়াপোড়া অথবা চাঁচর হিসাবে খ্যাত। বাংলায় হোলির ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে মিলন বা সম্প্রীতির রং। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের রচনায় এর উল্লেখ রয়েছে।
খেলত ফাগু বৃন্দাবন চন্দ …
সপ্তম শতাব্দীতে রচিত দন্ডিন-এর সংস্কৃত নাটক দশকুমার চরিত ও শ্রীহর্ষের রত্নাবলিতে হোলির কথা আছে। দোল (Dol Yatra) হল বাঙালির উৎসব আর হোলি সর্বভারতীয় রং খেলার উদযাপন। প্রাচীন বঙ্গদেশে দোল উৎসব এমনই এক বিশেষ সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, যা ক্রমশ সর্বসাধারণ বা আমজনতার মিলন উৎসবের রূপ নিয়েছে। দোলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে দোলনা শব্দটা। ঝুলন ঝোলায় রাধাকৃষ্ণের মিলন উদযাপিত হয়। প্রেমিক কৃষ্ণ তাঁর শ্রীমতীর সঙ্গে দোলনায় দোলেন।
এই নিয়ে সেই বিখ্যাত গান …
কুসুম দোলায় দোলে শ্যাম রাই …
কুসুম দোলার রাধা-কৃষ্ণের মিলনের স্মৃতিকে স্মরণ করে মেতে ওঠেন ছোট বড় সকলে। আবার এ-ও জনশ্রুতি যে, বসন্ত পূর্ণিমায় শ্রীচৈতন্যদেব পুরী থেকে ভক্তদের নিয়ে বাংলার বুকে দোল উৎসবের সূচনা করেছিলেন। সেই কারণেই প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশাতেও রঙের জোয়ারে মেতে ওঠে লোকজন।
বিভিন্ন রাজ্যে হোলি
হরিভক্তিবিলাস ও সমকালীন লেখায় এই দোল (Dol Yatra) উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। গোয়া বা কঙ্কন উপকূলে হোলির পোশাকি নাম শিগমো। রঙিন পোশাক পরে, পতাকা উড়িয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, রং খেলে এবং প্রচুর খাবার খেয়ে রাজ্যে জুড়ে পালিত হয় রঙের উৎসব।
কোঙ্কণের দক্ষিণাঞ্চলে হোলি উৎসবকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন উক্কুলি নামে। মালায়ালাম ভাষায় এর নাম উক্কুলকুলি। এর অর্থ হলুদ স্নান। হোলির দিন মূলত হলুদ-গোলা জল দিয়ে একে অপরের গায়ে হলুদ দিয়ে থাকেন সেখানকার মানুষজন। হলুদের প্রাকৃতিক গুণাগুণ নিরাপত্তা ও পবিত্রতার জন্যই তাঁরা এইভাবে উদযাপন করেন রঙের উৎসব।
মহারাষ্ট্রে আবার হোলির দিনে বিশেষ প্রথা পালিত হয়, তা হল— ‘মাটকি তোড়’।
খুব জনপ্রিয় এই উৎসব। মহারাষ্ট্রের অলিতে গলিতে অনেকটা উঁচুতে লস্যি বা ক্ষীরের হাঁড়ি দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাঁড়ির নাগাল পেতে মানববন্ধন করা হয়। এরপর বলীয়ান একজন এদের ঘাড়ে চেপে লাঠি দিয়ে হাঁড়িটি ভাঙেন। হাঁড়ি থেকে গড়িয়ে-পড়া লস্যি বা ক্ষীরের স্বাদ নিতে মেতে ওঠেন আমজনতা। লোকবিশ্বাস, মা যশোদা কৃষ্ণের দুষ্টুমির কারণে উঁচুতে ক্ষীর, দই আর মাখনের হাঁড়ি বেঁধে রাখতেন। কিন্তু দুষ্টু কৃষ্ণও কম যান না। তিনি বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে একজন অনেক জনের কাঁধে চেপে সেই হাঁড়ি ভেঙে খাবার খেতেন। শ্রীকৃষ্ণের নামের জয়ধ্বনি দিতে দিতে এই উৎসব পালিত হয়।
গুজরাতে হোলি চলে দু’দিন ধরে। হোলিকার আগুনে নারকোল এবং ভুট্টা আহুতি দেওয়া হয়। এই সময়ে রবিশস্য পেকে ওঠে। তাই তাকে আহুতি দিয়ে খাওয়াদাওয়া নাচ-গান নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠা।
হোলির মূল সুর কিন্তু মথুরা বৃন্দাবনে। এখানে ফুল দিয়ে দোল উৎসব পালিত হয়। আবার রাধার জন্মস্থান বারসেনায় পালন করা হয় প্রসিদ্ধ ‘লাঠ মার উৎসব’। মহিলারা পুরুষদের আদর করে মৃদু অভিযোগ জানিয়ে কপট রাগে মারধর করে। আর ছেলেরাও সেই আদরের মার খেয়ে গান গায়। এখানেও প্রতীকী বিশ্বাস যে, রাধা ও তাঁর সখীরা শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে এই লীলা করতেন।
বারাণসীতে কাদামাটি মেখে কুস্তি লড়ে এই উৎসব পালন হয় তারপর অনুষঙ্গ হিসেবে ভাঙ-শরবত পান ও নাচ-গান চলে।
বিবিধের মাঝে
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই ভারতীয় উৎসব ইউরোপ আমেরিকাতেও বেশ জনপ্রিয়। পশ্চিমি দুনিয়ায় হাজার হাজার সাহেব-মেম রং খেলার উৎসাহ উদযাপনে ভারতীয়দের থেকে কোনও অংশে কম যান না। জল ও রং দিয়ে তাঁরা খেলায় মেতে ওঠেন। গোটা দেশ এবং বিদেশের হোলি নিয়ে তো অনেক কিছু জানা গেল। এবার বাঙালির দোলে ফেরা যাক।
দোল মানবসভ্যতার অতি প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণে এর উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা যায়, তিনশো খ্রিস্ট-পূর্বের শিলালিপিতে আছে যে, হর্ষবর্ধনের সময় হোলি উৎসব ছিল। আল-বেরুনির লেখাতে পাওয়া মধ্যযুগে কোনও কোনও অঞ্চলে মুসলিমরা হোলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
অযোধ্যার নবাব আসফ উদ দৌল্লা, নবাব সুজাউদদ্দৌলার আমলে হোলির উৎসব হত। শোনা যায় সম্রাট আকবর তেরো দিন ধরে হোলি খেলতেন।
ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে বৃন্দাবনের নন্দনকাননে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে তেত্রিশ হাজার গোপিনীর সঙ্গে রং-ছোঁড়াছুঁড়ির খেলায় মাততেন। এর স্মরণে এই শুভদিনে সকালে ভগবান কৃষ্ণ-রাধার বিগ্রহকে আবিরে স্নান করিয়ে, দোলনায় চড়িয়ে, কীর্তন গান সহকারে শোভাযাত্রা বের হয় অনেক মন্দির বা বাড়িতে। মথুরা-বৃন্দাবনে তো বটেই।
এরপরই কৃষ্ণভক্তরা আবির নিয়ে পরস্পরে রং মাখামাখি করেন। দোলকে (Dol Yatra) কেন্দ্র করে রাধা-কৃষ্ণের নানা কাহিনি প্রচলিত। সবচেয়ে যেটা বেশি শোনা যায় তা হল— বৃন্দাবনের রাধা এবং তাঁর সখীদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। সেসময় রাধা এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। পোশাক গা থেকে খুলে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণ মুঠো মুঠো আবির দিয়ে রাধার লজ্জানিবারণ করেন। তাই আবির দোলখেলার প্রধান অনুষঙ্গ।
বাংলা দোল উৎসবের সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের কাহিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পুরাণে এ-ও বর্ণিত আছে, বাসন্তী পূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোশি নামক অসুরকে বধ করেন।
অত্যাচারী দুষ্ট এই অসুরকে বধ করার পর অন্যায়ের শক্তির বিনষ্ট হওয়ার আনন্দে সকলে মেতে ওঠে ও রং খেলে উৎসব পালন করে।
পুরাকালে বিবাহিত নারীরা তাঁর পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন।
অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায়। হোলিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্যর দেখা মেলে।
বছরভর নিস্তরঙ্গ জীবনে বসন্তই আনে রঙের ছোঁয়া। সাদামাঠা, বিবর্ণ আটপৌরে জীবন ভরে ওঠে রঙে, রূপে, লীলায় বাসন্তী পূর্ণিমার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।