বায়ুমণ্ডলে ঘন কুয়াশা, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি, প্রচণ্ড বায়ুবেগ ইত্যাদি ঘটনার জন্য যে কোনও যান চলাচলের অসুবিধা হয় ঠিকই কিন্তু শুধুমাত্র তাপমাত্রা পরিবর্তনে একমাত্র প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় মহাকাশযান ও বিমান চলাচলে। তথ্য অনুযায়ী প্রতি মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ১২০০০ থেকে ১৪০০০ উড়োজাহাজ অবিরত আকাশে উড়ছে। সারা পৃথিবীতে প্রতি মিনিট ১৬০টি উড়োজাহাজ বিমানবন্দর থেকে আকাশে উঠছে (takeoff) আর ২৮টি অবতরণ করছে। প্রসঙ্গত, এই ৩টি অবস্থা flightradar24 AAPটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ-এ স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে এর বাস্তব চলমান সততা কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি বাদে সমস্ত পাইলট আবহাওয়ার খবরের ওপর ভিত্তি করেই আকাশে ওঠা (takeoff), উড়ান (ফ্লাইট) এবং অবতরণ (ল্যান্ডিং) করেন। বিরূপ আবহাওয়ার জন্য ভয়ানক অসুবিধায় পড়তে হয়। এর জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর (global warming) প্রভাব মারাত্মক।
আরও পড়ুন-লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনে বদলে যাওয়া বাংলার উন্নয়নের ছবি তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী
টেকঅফ এবং ল্যান্ডিংয়ের সময় পাইলটদের আবহাওয়ার খবর জানা বাধ্যতামূলক, সেটি ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানিজশন (ICAO) এর কোডের নিয়ম অনুযায়ী লেখা থাকে। পাইলট আকাশে থাকা অবস্থায়ও এই খবর জেনে নেন। একটি ভাল আবহাওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ, METAR : VECC 162330Z 17005KT 2800 HZ FEW100 26/24 Q1008 NOSIG এর অর্থ : METAR : মিটিওরোলজিক্যাল এভিয়েশন রিপোর্ট, প্রতি ৩০ মিনিট বাদে পর্যবেক্ষণ করে তৈরি প্রস্তুত করা হয়। এবং পৃথিবীর সমস্ত এয়ারপোর্ট থেকে জানতে পারা যায়, আগে টেলিগ্রাম মারফত, বর্তমানে ইন্টারনেট মারফত।
VECC : কলকাতা এয়ারপোর্টের কোড নাম। এই রকম সমস্ত এয়ারপোর্টের কোড নাম আছে।
162330Z : ১৬ তারিখের ২৩টা ৩০ মিনিট জিএমটি(ভোর ৫টা ভারতীয়) সময়ে তৈরি হয়েছে।
17005KT : ১৭০ বাতাসের দিক (প্রায় দক্ষিণা) এবং ৫ নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘণ্টায়। কলকাতা এয়ারপোর্ট প্রায় উত্তর দক্ষিণ বরাবর। তাই এক্ষেত্রে পাইলটদের কোনও অসুবিধা হবে না। সাইক্লোনের সময় বায়ুর দিক ১০০ ডিগ্রি (পূর্বালি) এবং গতি ২৫ নটিক্যাল মাইল(৪৬ কিমি) প্রতি ঘণ্টা হয়ে গেলে কলকাতা এয়ারপোর্টে বিমানের ওঠানামা একেবারে অসম্ভব। বায়ুর গতি বিমানকে রানওয়ে থেকে ঠেলে ডানদিকে বা বাঁদিকে সরিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে। তাই সাইক্লোনের সময় এয়ারপোর্ট বন্ধ করা হয়। বায়ুর গতি পাইলটদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোডের প্রথমেই দেওয়া হয়েছে।
2800 : ২৮০০ মিটার, এখানে খালি চোখে দৃশ্যমানতা। খুব ভাল অবস্থা। কুয়াশা হলে এই মান কখনও কখনও ৫০ এরও কম হয়ে যায়। দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে, ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম (ILS)-এর সাহায্যে, ভিজিবিলিটি শূন্য হলেও বিমানকে নামাতে পারে। কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরে ভিজিবিলিটি ৩৫০-এর কম হলে এখনও নামানোর ব্যবস্থা নেই।
HZ : এটি বায়ুমণ্ডলের অবস্থা : বৃষ্টি হলে RA, কুয়াশা হলে FG, বজ্রপাত হলে TS ইত্যাদি লেখা হয়। TS থাকলে পাইলট ২ বার চিন্তা করবে। কেননা বজ্রপাতের সময় বায়ুর গতি ওপরের দিকে অথবা নিচের দিকে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বজ্রপাত বিপজ্জনক। এই জন্য এয়ারপোর্টে বজ্রপাতের পূর্বাভাস থাকলে, ১ ঘণ্টা আগে সতর্ক করা হয় এবং তারপর বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং পদ্ধতি কাজে লাগবে না।
FEW100 : এটি আকাশে কতটা মেঘ আছে তা বলে দিচ্ছে। সামান্য মেঘ আছে যার নিম্ন প্রান্ত মাটি থেকে ৩ কিমি ওপরে। বিমানের রানওয়ে দেখতে কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু যদি BKN012 থাকত, অর্থাৎ আকাশ ভর্তি মেঘ, যার নিম্ন প্রান্ত মাটি থেকে ৩৬০ মিটার উপরে। কালবৈশাখী বা সাইক্লোনের সময় এরকম হতে পারে। এক্ষেত্রে পাইলট রানওয়ে দেখতে পাবেন না, তাই ওই বিমানবন্দরে নামার পরিকল্পনাও করবেন না।
26/24 : খুব গুরুত্বপূর্ণ, বলছে, রানওয়ের কাছাকাছি তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা ৯০ শতাংশ। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর ঘনত্ব নির্ভর করে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বাড়বে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব তত কমবে। বিমানের ভারোত্তোলন ক্ষমতা কমে যাবে। আবার ঘনত্ব কম হলে, বিমানের ওঠবার ও নামার সময় অনেক বেশি রানওয়ের ওপর দৌড়ানোর প্রয়োজন হবে। এই দুই কারণে, ICAO-এর নিয়ম অনুযায়ী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড থেকে বেড়ে ৪৪ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড হলে বিমানের যাত্রী সংখ্যা ২০ শতাংশ কমাতে হবে। আবার ৪৪ ডিগ্রি থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড হলে যাত্রী সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। আর ৪৮ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড হলে, ওই সময়ের জন্য সমস্ত বিমানের ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। তাই মরুভূমির আশপাশের বিমানবন্দরে দুপুরের দিকে ওঠানামা বন্ধ থাকে।
Q1008 : এটি রানওয়ের ওপর বায়ুমণ্ডলের চাপের পরিমাণ। বিমান কত উঁচুতে আছে প্রতি মুহূর্তে জানা প্রয়োজন। ICAO নিয়ম অনুযায়ী দুটি বিমানের উচ্চতার ব্যাবধান ১০০০ ফুটের বেশি হতে হবে, আর সামনে বা পেছনে বিমানের ব্যাবধান ৬০ কিলোমিটারের বেশি হতে হবে। এই কারণে ইউরোপ, আমেরিকার ওপর এত ঘন ঘন বিমান থাকে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের হিমশিম অবস্থা হয়।
NOSIG : এটি বোঝাচ্ছে পরবর্তী ২ ঘণ্টার মধ্যে আবহাওয়ার কোনও বিশেষ কোনও পরিবর্তন হবে না।
সাবধানতা ও প্রতিকার : আবহাওয়ার পরিবর্তন তাপমাত্রার ওপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। আবার বিমানযাত্রা, তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নের (global warming) প্রভাবে অদূর ভবিষ্যতে অনেক এয়ারপোর্টে দুপুরের দিকে বিমান চালানো বন্ধ রাখতে হতে পারে। সমুদ্রের কাছে এয়ারপোর্ট তৈরি হলে সমস্যা কম হবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের (global warming) প্রভাব কমাতে গাছ লাগানো এবং গাছ বাড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।