‘কুড়িয়ে এনেছি মাথা, ফুলের বদলে- পলাশ ফোটেনি ভাল এ-বছর দোলে’

গত শনিবার যাদবপুরে যে নিন্দাজনক ঘটনা ঘটল, আগামী শনিবার দোল উৎসবের আগে, আজ এই শনিবার, শ্রীজাতর কবিতার এই লাইনগুলোই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেছিল ওয়েবকুপার বার্ষিক সম্মেলন। কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চল থেকে তো বটেই, আলিপুরদুয়ার, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ-সহ বিভিন্ন জেলার প্রায় তিন-চার হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সামনে সেদিন কিছু ছাত্র সংগঠন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করেলেন। সার্বিক অরাজকতা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হিংসাকে উসকানি দেওয়া হল। মুখ পুড়ল যাদবপুরের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার নিজেদের প্রমাণ করে গবেষণা তথা পঠনপাঠনের নানা পরিকাঠামো অর্জন করতে হয়। অথচ এরকম নানা ধরনের অনভিপ্রেত প্ররোচনায় যাদবপুরকেই ভুগতে হয় বা যাদবপুরের ভাবমূর্তি খারাপ হয়। কেন বারবার এমন কাণ্ড ঘটে? কারা থাকে এ-সবের পেছনে? এবার যাদবপুর কোন পথে? উত্তর খুঁজলেন ডাঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার

Must read

বিশ্ববিদ্যালয় : জ্ঞানের আলো না হিংসার আঁধার?
একদা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (jadavpur university), প্রেসিডেন্সি কলেজ আর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (JNU) ছিল ভারতীয় শিক্ষার গর্ব। মুক্তচিন্তা আর প্রগতির প্রতীক হিসেবে এদের নাম উঠত বিশ্বমঞ্চে। কিন্তু আজ? সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যেন এদের গৌরবময় অতীতের উপর কালো ছায়া ফেলেছে। যখন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা হার্ভার্ড গবেষণা আর বৌদ্ধিক তর্কের জোয়ারে বিশ্বকে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক অরাজকতা আর হিংসার জাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে। প্রশ্ন জাগে— বিশ্ববিদ্যালয় কি এখনও জ্ঞানের মন্দির, নাকি হিংসার রণক্ষেত্র?
বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শুধু পড়াশোনা বা গবেষণা নয়, মুক্ত মত প্রকাশের এক অমোঘ আঙিনা। কিন্তু যাদবপুরের সাম্প্রতিক দৃশ্যপট যেন অন্য গল্প বলছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর প্রতি অশোভন আচরণ, উপাচার্যের উপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, প্রশাসনিক ভবনের দখল— এ কি ছাত্র রাজনীতির নামে হিংসার উৎসব? অক্সফোর্ড বা হার্ভার্ডে যেখানে বিতর্কের ধারালো অস্ত্রে সমস্যার সমাধান খোঁজা হয়, সেখানে যাদবপুরের কিছু ছাত্র হাতে লাঠি আর মুখে স্লোগান নিয়ে নামছে। হার্ভার্ডের ডিবেট ক্লাব বা কেমব্রিজ ইউনিয়ন যখন চিন্তার সীমানা প্রসারিত করছে, আমাদের ছাত্ররা কেন হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে?

বিনামূল্যের শিক্ষা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
যাদবপুরের (jadavpur university) মতো প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্র বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। জনগণের করের টাকায় চলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সুযোগের অপব্যবহার করে কিছু ছাত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলছে। মাওবাদীদের সমর্থন, কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুংকার, ভারতকে ‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা— এ কি ছাত্র রাজনীতির নামে ষড়যন্ত্র? যদি ভারত এতই নিপীড়ক হয়, তবে কেন এরাই এখানে পড়ছে? কেন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে যাচ্ছে না? উত্তর সহজ— রাষ্ট্র তাদের বিনামূল্যে শিক্ষা, ভর্তুকিযুক্ত হোস্টেল আর গবেষণার পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু তারা সেই সুযোগকে বিদ্রোহের হাতিয়ার বানাচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতি গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হতে পারে, কিন্তু হিংসা বা সন্ত্রাসের পথে হাঁটলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ভল্টেয়ার বলেছিলেন, “আমি তোমার কথার সঙ্গে একমত নই, কিন্তু তুমি যাতে তা বলতে পারো, তার জন্য প্রাণপণ লড়ব।” এই মুক্তচিন্তার আদর্শ কি হিংসার ছায়ায় ম্লান হয়ে যাবে? বামপন্থী দলগুলো দশকের পর দশক ধরে যাদবপুর, JNU, প্রেসিডেন্সিকে নিজেদের দুর্গ বানিয়েছে। ফল? এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান আর বিশ্বমর্যাদা ধূলিসাৎ। JNU একদিন বিশ্বের শীর্ষ ২০০-তে ছিল, আজ তা স্মৃতি। যাদবপুর গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে। অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড উদ্ভাবনে বিশ্বকে এগিয়ে নিচ্ছে, আর আমরা গাড়ি ভাঙচুর আর রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগানে ব্যস্ত।

আরও পড়ুন- খড়ের গাদায় ব্যবসায়ীর অগ্নিদগ্ধ দেহ! চাঞ্চল্য হেমতাবাদে

কোন পথে ভবিষ্যৎ?
যখন বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার পরিবর্তে হিংসাকে আলিঙ্গন করে, তখন তা জ্ঞানের মন্দির থেকে ধ্বংসের আখড়ায় পরিণত হয়। বিশ্ব র‍্যাঙ্কিয়ে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পতন শুধু অর্থের জন্য নয়, রাজনৈতিক অরাজকতার জন্যও। গবেষণার পরিবেশ বিষাক্ত হলে, শিক্ষকরা নিরপেক্ষভাবে পড়াতে না পারলে, ছাত্ররা পড়াশোনা ছেড়ে দলীয় পতাকার তলায় দাঁড়ালে— অধঃপতন অনিবার্য।

পথ বদলের সময়
যাদবপুর (jadavpur university), প্রেসিডেন্সি, JNU-কে দলীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। হিংসার বদলে যুক্তি আর গবেষণার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড যদি গৌরব ধরে রাখতে পারে, ভারত কেন পারবে না? শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে— মেধার জায়গায় হিংসা অচল। রাষ্ট্রের টাকায় পড়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিছক ভণ্ডামি। দুই পথ খোলা— বিশ্বমানের গবেষণায় দেশকে এগিয়ে নেওয়া, নাকি মাওবাদী-বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিতে শিক্ষার মর্যাদা বিসর্জন দেওয়া। কোনটা পছন্দ, বেছে নিতে হবে ছাত্রছাত্রীদেরই।

Latest article